×

মুক্তচিন্তা

মৃত্যুদণ্ডের বিধানেও ভীত নয় ধর্ষককুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৬:৪২ পিএম

মৃত্যুদণ্ডের বিধানেও ভীত নয় ধর্ষককুল

ছবি: সালেক নাছির উদ্দিন,

মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণায়ও ভয় পাচ্ছে না ধর্ষক দুর্বৃত্তরা। কী ভাবছে তারা? আইন তার জায়গায় বহাল তবিয়তে থাকুক, তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। আইনের প্রয়োগ আর অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তি বিধানের জটিলতায় অনেক ফাঁকফোকর আছে, এর মধ্য দিয়ে বেরিয়ে পড়া যাবে। ‘শাস্তি এত সহজ নয়। নাকি আরো অন্য কিছু কথা যা তাদের বেপরোয়া মনোভাব তৈরি করেছে। ধর্ষক পুলিশের হেফাজতে চাপের মুখে (রিমান্ডে) ধর্ষণ অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে থাকে, কিন্তু কেন অকারণে শিশু বা বিভিন্ন বয়সি নারীকে ধর্ষণ, তার কারণ খুলে বলে না, পুলিশেরও তাতে প্রয়োজন নেই। তার জন্য অপরাধের স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু সামাজিক প্রয়োজনে এর মনস্তাত্তি্বক কারণ জানা খুবই জরুরি। কেন জরুরি সেকথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে- শিশুকন্যা বা নারী ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য এই মনস্তাত্তি¡ক কারণ উদঘাটন অপরিহার্য। ধর্ষণ মানসিকতার যেমন তাত্তি¡ক দিক আছে, তেমনি রয়েছে এর রাজনৈতিক-সামাজিক, এমনকি পারিবারিক দিক, সর্বোপরি ধর্ষকামী মানসিকতার দিক। এখানেই দায়িত্ব এসে পড়ে মনস্তত্ত¡বিদ চিকিৎসকের এবং নীতিগত দিক থেকে প্রশাসনেরও। ধর্ষণের অপরিহার্য এ দিকটি সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা মন্ত্রণালয়কে যেমন সচেতন হওয়া দরকার, তেমনি দরকার বিজ্ঞানসম্মত গবেষণামূলক কর্মসূচি গ্রহণ যাতে ধর্ষণের অন্তর্নিহিত কারণের শিকড় গোড়ায় পৌঁছানো যায় এবং প্রতিরোধমূলক সঠিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যায়। এর অর্থ নিয়মতান্ত্রিক, প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা বর্জন নয়, এ পরামর্শ সংশ্লিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংযোজন ব্যবস্থা, যেহেতু সম্প্রতি করোনা দুর্যোগের মধ্যেও শিশু ও বিভিন্ন বয়সি নারী ধর্ষণ বিস্ফোরক প্রকাশ এবং শিশু ধর্ষণের ব্যাপকতায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ ঘোষণা- ঘটনার তাৎক্ষণিক বিচার। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এবং ঘটনার পরিহাস যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ক্ষুব্ধ ঘোষণা এবং পরে বীভৎস নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা দেশে উত্তাল প্রতিবাদ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণবিরোধী মৃত্যুদণ্ড সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরও প্রতিদিন নানা মাত্রায় নারী ধর্ষণ ঘটে চলেছে। এমনকি পৈশাচিক শিশুকন্যা ধর্ষণও বাদ থাকছে না। বিস্ময়কর ঘটনা হলো স্কুল শিক্ষার্থী-অশিক্ষার্থী কিশোর, তরুণ, যুবক, মধ্যবয়সি থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ ধর্ষকদের অন্তর্ভুক্ত। এরা সমাজের শ্রেণি-নির্বিশেষ। মার্কসকথিত বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির সদস্যও এর বহিভর্‚ত নয়। বরং বাংলাদেশের পরিবহন খাতের শ্রমিক, যেমন বাস-ট্রাক চালক ও তাদের সহযোগী অনেক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের নায়ক- দৈনিক পত্রিকাগুলোর সংবাদ এমন সাক্ষ্য দেয়। এ সম্বন্ধে একাধিক ঘটনা আদালতে জঘন্য ইতিহাসের নজির তৈরি করে রেখেছে। ঘটনা এত পরিচিত যে উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। অথচ সেগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির শেষ পরিণাম সব ক্ষেত্রে আমাদের জানা নেই মূলত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ধারাবাহিকতা রক্ষার অভাবে।

দুই এই কলামটি যখন ক্ষুব্ধ চিত্তে লিখছি, তখনো প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় পড়তে হচ্ছে শিশুকন্যা ধর্ষণ, নারী ধর্ষণের ঘটনা, একের পর এক বিচিত্র তার রূপ। নিশ্চয়ই পাঠকমাত্রেই শিউরে ওঠেন এসব ঘটনাক্রমের প্রতিক্রিয়ায়। শাস্তি ঘোষণার পরবর্তী কয়েকটি ধর্ষণ-ঘটনার শুধু সংবাদ শিরোনাম উদাহরণ হিসেবে এখানে উল্লেখ করছি। ‘শিশুকে তুলে নিয়ে ধর্ষণে কিশোর গ্যাং’ (প্রথম আলো, ২৩.১০.২০২০)। ঘটনা নারায়ণগঞ্জের অন্তর্গত সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলীতে। শিশুটিকে ৭ ঘণ্টা আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়। ‘দরজা ভেঙে ঢুকে অস্ত্রের মুখে প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ।’ ঘটনা নোয়াখালীর চাটখিলে। ‘এছাড়াও সাত জেলায় নয় জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ’ (প্রথম আলো, ২২.১০.২০২০)। নারী তার ঘরেও নিরাপদ নয়। একাধিক ঘটনাদৃষ্টে মনে হতে পারে, নোয়াখালী ও ফেনী এলাকা বুঝি ধর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। একই সময়ে পত্রিকায় আরো একটি খবর-‘গোপালপুরে কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় মামলা’ ঘটনাস্থল টাঙ্গাইলের গোপালপুর। ধর্ষক পাঁচজন (ভোরের কাগজ, ২২.১০.২০২০)। ‘নোয়াখালীতে ফের দুই নারীকে ধর্ষণ ‘ভিডিও ধারণ’ (দেশ রূপান্তর, ২২.১০.২০২০)। এখানেই শেষ নয়। প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকায় নারী ও শিশু ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, যেমনটা ইতোপূর্বে উল্লিখিত। নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রচলিত আইন সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান নির্ধারণ করার খবর প্রকাশিত হয়েছে ১৪ অক্টোবরের দৈনিক পত্রিকায় (যেমন ভোরের কাগজ)। একই সঙ্গে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য : ‘ধর্ষণ থেকে নারীকে রক্ষা করতেই মৃত্যুদণ্ডের সাজা।’ বিস্তারিত বিবরণে না যেয়ে কথা একটাই : বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ নারী ও শিশুকে। ২৫ অক্টোবরের প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম : ‘নোয়াখালীতে আবার দরজা ভেঙে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ’।/‘ধর্ষণের শিকার আরো ৬’। প্রথমটি কিশোরী ধর্ষণ। স্থান চৌমোহনীর পৌর এলাকা। এর অর্থ শুধু আইন প্রণয়নে ধর্ষণ বন্ধ হবার নয়। দরকার কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি-বিধান এবং তা অতি দ্রুত সম্পন্ন করা। একটি দৈনিকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে- ‘একটি অনন্য দৃষ্টান্ত’। /‘ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার সম্ভব’ (২১.১০.২০২০)। দৃষ্টান্তটি হলো বাগেরহাটে আদালতে মাত্র সাত কর্মদিবসে এলো শিশু ধর্ষণ মামলার রায়। এ রায়ে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। হতে পারে ঘটনা মৃত্যুদণ্ড বিধানের পূর্বে বলেই ধর্ষক অপরাধীর যাবজ্জীবন সাজা। কিন্তু এ দৃষ্টান্তও ধর্ষণরোধে কাজে আসছে না। স্বভাবতই প্রশ্ন, ভয়ঙ্কর এ অন্যায়, অপরাধের অবসান ঘটানোর উপায় কি, কোথায় এই সামাজিক দূষণের সমাধান নিহিত? শুধুই কি কঠোর শাস্তি, নাকি আরো কিছু ব্যবস্থা, যা নিয়ে ইতোপূর্বে কিছু আলোচনা করা হয়েছে? \তিন\ ভয়ঙ্কর এ অপরাধ করোনাকালেও বিস্ফোরক চরিত্র অর্জন করায় এ সম্পর্কে পত্রিকার পাতায় বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ লেখালেখির পরামর্শ। তাতে এবং ঘরোয়া আলোচনায় প্রকাশ্যে জনসমক্ষে চরম শাস্তির কথাও উঠে আসছে। মানবিক চেতনার মানুষের পাল্টা যুক্তি তাতে মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুরতার উদাহরণ সৃষ্টি হবে, যা এ আধুনিক যুগে মোটেই কাম্য নয়। তাহলে কি করা যাবে? ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের যে বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করা তো অপরিহার্য এটা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা সমাজে সুস্থ, মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানো এবং ঐক্যবদ্ধ সামাজিক শুভশক্তির প্রকাশ ঘটানোর কর্মসূচি গ্রহণ। এখানে সরকারি তৎপরতার চেয়েও প্রয়োজন দেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মতাদর্শ নির্বিশেষে বিষয়টিকে প্রধান ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করে কর্মতৎপর হওয়া। এটা সংস্কৃতি চর্চার দায়বদ্ধতা বলা চলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর এ সম্বন্ধে আদর্শিক দায়িত্ব রয়েছে। একটি সুস্থ সামাজিক শক্তির (আপাতত ধর্ষণবিরোধী সামাজিক শক্তি) বিকাশ ঘটানো অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন এদিক থেকে ইতোমধ্যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে নির্যাতিত বিবস্ত্র জননীর পক্ষে দাঁড়িয়ে। এদের কাজে বাধা দেয়া প্রশাসনের উচিত নয়। সরকারের নীতি-নির্ধারকদের প্রতি আমাদের আহ্বান শুধু আইন পাসই নয়, তারা অবিলম্বে পূর্বকথিত এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে বসে এমন কিছু নীতি-নির্ধারণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করুন যাতে আমাদের নারীকুল ঘরে-বাইরে নিরাপদে অবস্থান ও চলাফেরা করতে পারে, ধর্ষকের থাবা যেন তাদের দৈহিক-মানসিক অশান্তি ও যন্ত্রণার কারণ না হয়। পরিস্থিতি বিচারে বিষয়টি অতীব জরুরি।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App