×

সাময়িকী

তিমির হননের শিল্পী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৫৬ পিএম

তিমির হননের শিল্পী

যে বই আমার কেনার কথা ছিল না সন-তারিখের বিস্মৃতি দূর করতে একালের ফোন কিছুটা সাহায্য করে। কলরেকর্ডস অনেক কিছু মনে করিয়েও দেয়। মাত্র ক’দিন আগে অক্টোবরের ৯ তারিখ হাসনাত ভাই ‘অহাসনাতসুলভ’ একটি কথা বললেন। বললেন, তিনি আমার জন্য একটি বই রেখেছেন। যে দিন বাসা থেকে বেরোবেন, আমাকে ফোন দেবেন। আমি বইটা নিয়ে আসব। বইটার নাম : ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’। তিনি বললেন, ‘বইটা পড়বেন আর ভালোমন্দ যেমন মনে হয় একটা রিভিউ লিখবেন’। শেষ কথাটিই ‘অহাসনাতসুলভ’ নিজের বই নিয়ে লেখার কথা তিনি কাউকে বলেছেন, আমর জানা নেই, আমাকে আগে কখনো বলেননি। সত্তরের দশকের শেষভাগ এবং আশির দশকের শুরুর দিকটাতে বিনে পয়সায় একটি বই পাওয়া যাবে এই লোভেই বিশেষ করে বাংলাদেশ অবজার্ভার এবং ইত্তেফাকে অনেক বই নিয়ে লিখেছি। তারপর এক সময় কাজটা প্রায় একেবারে বন্ধ করে দিই। যখন সায় দিলাম, কিন্তু হাসনাত ভাই হাত বাড়িয়ে আমাকে একটা বই দিতে পারবেন, সেই সম্ভাবনা যে চিরদিনের মতো ফুরিয়ে গেছে নভেম্বরের প্রথম দিন। যে বইটি আমাকে দিতে চেয়েছেন কিন্তু বৈরী এ করোনাকালের কারণে দিতে পারেননি সে বই আমার কাছে থাকবে না, তা তো হয় না। আমি কিনে আনি জার্নিম্যানের প্রকাশনা রফিকুন নবীর প্রচ্ছদে, আবুল হাসনাতের ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’। এই বই কি আমাকে পড়তেই হবে? না পড়লে সমস্যা কী? তিনি তোর জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। তা ছাড়া আমার কেনা এবং মোটেও পাতা না-উল্টানো আরো কিছু বইও তো আছে। থাকুক না আমার কেনা কিন্তু না পড়া বইয়ের একটি হয়ে। কিন্তু তা হবার নয়, এই বই নিয়েও একসময় লিখব- শিরোনাম হবে : আবুল হাসনাতের ঢাকা। আমারই সৌভাগ্য তার হাত দিয়ে বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত শেষ বইটি আমারই। কয়েক বছর আগে মাতিলদে উরুটিয়ার লেখা ‘মাই লাইফ উইথ পাবলো নেরুদা’র তিন পর্বের এক পর্ব আমি অনুবাদ করি এবং তা ঈদ সংখ্যা বণিক বার্তা ‘সিল্করুট’-এ প্রকাশিত হয় এবং তার নজরে পড়ে। তিনি আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি বাকি অংশটুকুর অনুবাদ শেষ করে আমাকে দিন, বেঙ্গল ছাপবে। আমি খানিকটা অনুবাদ করি, খানিকটা এখানে ওখানে, খানিকটা কালি ও কলমে ছাপা হয়। ২০১৯-এর নভেম্বরে তিনি আল্টিমেটাম দেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুবাদ শেষ করতে হবে, ২০২০-এর ফেব্রæয়ারির বইমেলাতে প্রকাশিত হবে। ডিসেম্বরেই আমার হাত থেকে হাতে লেখা অনূদিত কিছুটা অংশ হারিয়ে যায়। আমি হাসনাত ভাইকে বলি, এবার সম্ভব নয়, ২০২১-এর বইমেলায় বের হোক। তিনি বললেন, ২০২১ অনেক দূর, আমরা তখন কে কোথায় থাকব কে জানে। তাড়াতাড়ি শেষ করে দিন। ফেব্রæয়ারি শেষ দিকে কাজ শেষ করলাম, শিল্পী ও কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ বইটির অঙ্গসজ্জা নিয়ে বেশ খাটাখাটনি করলেন। ততদিনে করোনা ভাইরাস পৃথিবীকে ছেয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশও লকডাউনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে। হাসনাত ভাই ফোন করলেন, এক্ষণ চলে আসুন পাবলো নেরুদা আমার হাতে। আমি ছুটে যাই। না বই নয়, ডামি। জিজ্ঞেস করলেন আমার আর কোনো পরামর্শ আছে কি না? হাসনাত ভাই যেখানে খেটেখুটে বই প্রকাশ করছেন সেখানে আমার পরামর্শ! আমি দু’চার লাইন লিখতে জানি, কিন্তু প্রকাশনার তো কিছু জানি না। হাসনাত ভাই লিখতে জানেন, সম্পাদনা করতে জানেন, অপরকে প্রকাশ করতে জানেন। লকডাউন একেবারে আসন্ন, তারিখও ঘোষণা হয়ে গেছে। হাসনাত ভাই ফোন করলেন, বললেন এবার ডামি নয়, বই এসে গেছে। আমি আবার ছুটি। হাসনাত ভাই আরো কাজ করেছেন, প্রচ্ছদ বদলেছেন- নেরুদা ও মাতিলদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি প্রচ্ছদে এসেছে। আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমার বন্ধুকে বইটা উৎসর্গ করে ভালো করেছেন, ভীষণ নেরুদা ভক্ত। অনূদিত বইটি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে উৎসর্গ করা। টাকার অংকে বড় একটি পুরস্কারের নাম বলে বললেন, ‘পাবলো নেরুদার সঙ্গে আমার জীবন’ অনুবাদ গ্রন্থ হিসেবে সেই পুরস্কার পেতে পারে। তিনি আমাকে আরো দুটো অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন : চে গুয়েভারার স্ত্রী হিল্ডার লেখা ‘রিমেম্বারিং চে : মাই লাইফ উইথ চে’ এবং মার্ক শাগালের স্ত্রী বেল্লা শাগালের লেখা ‘ফাস্ট এনকাউন্টার’ অনুবাদ করতে হবে। তিনি ধারাবাহিকভাবে কালি ও কলমে প্রকাশ করবেন, তারপর বেঙ্গল থেকে বই। হাসনাত ভাই বললেন, সম্ভব হলে নেরুদাকে নিয়ে আর একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করুন, নেরুদার প্রিয়জনেরা তাকে নিয়ে অনেক লিখেছেন, সেগুলো অনুবাদ করুন। বেঙ্গল থেকেই প্রকাশিত আমার অনূদিত ‘ভাইস চ্যান্সেলর ও অন্যান্য গল্প’ বইটির ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ে বললেন, একেবারেই আমাদের ভাইস চ্যান্সেলরদের মতো মেরুদণ্ডহীন। এমন একটা চরিত্র নিয়ে উপন্যাস হলে ভালো হতো। তিনি ভিএস নাইপলকে তেমন বড় লেখক মনে করতেন না, তবুও বললেন, তার একটি ইন্টারেস্টিং উপন্যাসের অনুবাদ পেলে ভালো হতো। তার প্রতিষ্ঠানও দুর্যোগের মধ্য দিয়েই এগোচ্ছিল, করোনার দুঃসংবাদগুলো তাকে ভীষণ বিচলিত করছিল। একদিন বল, যে ফোন এলে আশঙ্কা হয়- খারাপ কোনো খবর নয় তো। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, তুলনামূলকভাবে তার সাথে কম ঘনিষ্ঠদের একজন আমি- তিনি আমাকে যে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন তা শেষ করতেই পাঁচ বছর লেগে যাবার কথা; যারা ঘনিষ্ঠ তাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন সে সবের বাস্তবায়ন দেখে যেতে হলেও তাকে তো আরো এক কুড়ি বছর ভালোভাবে বেঁচে থাকতে হতো। এ কেমন কথা, হাসনাত ভাই চলেই গেলেন। আবুল হাসনাতকে হারিয়ে দূরপ্রসারী ক্ষতির হিসাব থাক- তাৎক্ষণিক কি কি ক্ষতি হলো? বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি প্ল্যাটফর্ম হারালো- এই ক্ষতিটা পূরণ হবার নয়। তিমির হননের গান আর ঘণ্টাধ্বনি অনেকটা সঙ্গত কারণে মাহমুদ আল জামান কবিতার আলোচনায় তেমন উঠে আসেননি। যারা জানতেন, ভালো। কিন্তু আমি কখনো তাকে বলতে শুনিনি, আমি মাহমুদ আল জামান। তার প্রান্ত থেকে বলতেন, আমি হাসনাত কিংবা আবুল হাসনাত। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো কবির কবিতা নিয়ে লেখার যে সংস্কৃতি তা এখন আর বিরাজ করে না। যেসব আলোচনা কদাচিৎ চোখে পড়ে তার অধিকাংশই ফরমায়েসি কিংবা তুষ্ট করা রচনা, তাতে দেয়া-নেয়ার একটা সম্পর্ক মূর্ত হয়, শিল্পের জন্য বাড়তি কিছু পাতা ছাড়া তেমন কিছু সংযোজিত হয় না। ‘ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়’ নামের একটি শিশুতোষ কিশোরতোষ গ্রন্থ দিয়ে আমি প্রথম মাহমুদ আল জামানকে চিনি এবং সবশেষে ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’ কিনতে গিয়ে ‘নির্বাচিত কবিতা’-ও কিনি। সুন্দর এ দুটো প্রকাশনাই এসেছে জার্নিম্যান থেকে। কবিতার পাতা উল্টাতেও চোখ পড়ে : ‘মুখোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার চৌমাথায়’। এতো করোনাকালের কবিতা নয়, বহু বছর আগের। এত এন৯৫ মুখোশ নয় যা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন কলঙ্কিত- এ মুখোশ সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে। তিমির হননের গান আর ঘণ্টাধ্বনি কোনোদিন শুনব না বলে মুখোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার চৌমাথায়। সাম্যবাদী রাজনীতির সৃষ্টিশীল মানুষদের অনেকেই কাস্তে হাতুড়ি কিংবা লালসূর্য দিয়ে উপসংহার টানবেন বলে আগে থেকেই নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে শিল্পের নিজস্ব গতি ও স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ান। মাহমুদ আল জামান সেই রাজনীতি থেকেই উঠে এসেছেন বটে- কিন্তু হাতুড়ি-কাস্তের গায়ের জোর বাড়াবাড়ি কি তার কবিতায় কারো চোখে পড়েছে? খুব সহজভাবে বলতে চাই- তিনি শিল্পকে শিল্পের মতো করেই ধারণ করেছেন, লালন করেছেন। ‘উৎসমুখ’ পুরোটাই উদ্ধৃত করছি : খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে বন্ধ দরোজা তুমি কি যাবে, তুমি কি নেবে? দ্যাখো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে নদীর কাছে আশা আর নৈরাশ্যে দুলতে দুলতে একটি মানুষ যাচ্ছে উজানে। ব্যাকুলতায় তার কণ্ঠ অন্তিম ইচ্ছার মত আছড়ে পড়ছে। কিসের ইচ্ছা? সন্তানকে বুকে নেবার আর সমুদ্র দেখবার ইচ্ছাও মরে উঠছে খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে বন্ধ দরোজা। একটি কবিতায় আমি যা কিছু পেতে চাই তার পুরোটাই পাই ‘একটি মৃত্যু’ কবিতায় আছে আমি ভাবি আবুল হাসনাত কিংবা মাহমুদ আল জামানের মৃত্যুও কি আমার কাছে ‘রাহেলার মৃত্যুর মতো’ নয় : আমার দুঃখের জন্ম আছে, আমার আনন্দের মৃত্যু আছে! রাহেলা, শবাধার কাঁধে নিয়ে যাবো ছোব না তোমার শরীর। এমন অসাধারণ পঙ্ক্তিমালা একালে খুব বেশি পাবার কথা নয়। ‘শরণার্থী শিবিরে এক কবির সঙ্গে আলাপ’ কবিতাটি যাদের পড়া হয়নি তারা যদি উদ্বাস্তু মানুষের যাতনা কিছুই বুঝতে চান, একাত্তরের বাংলাদেশের শরণার্থী হোক কি আশির সাবরা-শাতিলা কিংবা কঙ্গো-কিনশাশার, তারা যদি জীবন্ত মাহমুদ দারবীশকে কথোপকথনরত অবস্থায় দেখতে চান, শরণ নিন এই কবিরÑ মাহমুদ আল জামান। এমন কিছু কবিতাই একজন কবিকে টিকিয়ে রাখে দশকের পর দশক : চুয়াত্তরে আল-সাঈদা শরণার্থী শিবিরে কবি মাহমুদ দারবীশের সঙ্গে যখন আলাপ তখনও এখানে ওখানে বোমায় বিধ্বস্ত, আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়ানো। দু’জন ফিদেল ক্যাস্ক্রোর মতন তরুণ মারণাস্ত্র কাঁধে নিয়ে ঝড় বৃষ্টির জলে দিগন্ত রেখার দিকে চেয়ে আছে- একাত্তরের যোদ্ধা কবিও এভাবেই দিগন্ত রেখার দিকে চেয়ে থাকতেন- একাত্তরের স্বপ্নগুলো দূর থেকে অতিদূরে চলে যাচ্ছে। এমনকি একাত্তরের যুদ্ধটার উপরও একচেটিয়াত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে ফন্দিবাজ আরো কিছু মানুষ, যাদের আনুগত্য যতটা না দেশ ও মানুষের প্রতি তার বেশি আনত তারা ক্ষমতার কাছে, সবকালেই। মাহমুদ আল জামানের মর্ত্যলোক ও কল্পলোকের সবিতা হালদারের সন্ধানে যখন একজন পাঠক তার কবিতায় প্রবেশ করবেন, দেখবেন একালের একজন অন্যতম রোমান্টিক কবিই তাকে পথ দেখাচ্ছেন, ঐ তো আলেয়া- ঐ তো সবিতা হালদার। আমার মনে হয় এখন থেকে আমি রাস্তার চৌমাথার মানুষটিকে খুঁজব। ঐ তো মুখোশ হাতে তিনি আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, আমি নিশ্চিত তিনিই মাহমুদ আল জামান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App