×

সাময়িকী

জীবনের গল্প চলে চক্রাকারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৮:২৯ পিএম

জীবনের গল্প চলে চক্রাকারে

কত কিছুই তো পড়া হয়, সব কি মনে থাকে? কিছু কিছু মনে থাকে। উজান নদীর ঢেউ হয়ে জেগে থাকে। কিছু কিছু পড়া ভুলতে দেয় না মনকে, মগজ তা ধরে রাখে অনেক দিন। এর নামই হয়তো সুখপাঠ্য। সদ্য পড়া ‘জলজীবন’ তেমনই একটি গল্পগ্রন্থ। মোট এগারোটি ছোটগল্পের যুথবদ্ধতায় মলাটবদ্ধ ‘জলজীবন’ গ্রন্থ। ছোটগল্পের মর্মার্থ আরেকবার অনুধাবিত হলো গল্পগুলো পড়ে। শেষ হয়েও যেন হইলো না শেষ। নিত্য নির্মিত জীবনের পরোতে যে-জীবন, যে-বাস্তবতা, যে-নিষ্ঠুরতা, যে- নির্মমতা আর নিত্যনৈমিত্তিক শ্বাস-দীর্ঘশ্বাস লেপ্টে থাকে প্রশ্নহীন, তারই একখণ্ড জলছাপ এই জলজীবন।

এখানে গ্রামীণ পটভূমি থেকে মফস্বল জীবন হয়ে নগরকেন্দ্রিক যাপিত যাপনের অব্যক্ত ভাষা, ব্যঞ্জনার সুর মহাপ্রাণধ্বনিসম সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পড়তে গিয়ে নিজেকেই মনে হয়েছে গল্পে বর্ণিত সময়ে উপস্থিত একজন, মনে হয়েছে এ-তো আমারই আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রকাশ। মর্মন্তুদ বেদনার যেমন অঙ্কন আছে এখানে, দর্শনেরও দৃষ্টিভঙ্গি আছে; আছে সমাজ সচেতন এক বিশ্লেষকের ভাব, আবেগ; আছে প্রতিবাদী উচ্চারণ। ‘জলজীবন’ এর গল্পকার ‘শ্রাবণী প্রামানিক’ গল্পে কল্পনার মিশেল দিয়েছেন কিন্তু অভিজ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র কাহিনী তৈরি করেননি আবদ্ধ ঘরে বন্ধ থেকে। প্রতিটি গল্পের যে পথ তিনি এঁকেছেন, বাঁক নির্মাণ করেছেন তাতে প্রতীয়মান হয়, তিনি বহু পাঠ ও নিরীক্ষার বিপরীতেই সংকল্পাবদ্ধ হয়েছেন সমাজ নিংড়ানো নুন-নামতা টুকে আনতে। খালি চোখে যা আমাদের পাশঘেঁষে চলে যায় প্রতিদিন, যা আমরা ধরি, ধরি না; ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই অন্যের জীবন বলে তা’ই এই লেখক নিজের নাকছাবি বলে তুলে ধরেছেন গল্পের অবকাঠামোর ভেতর। দেখাতে চেয়েছেন, এই যে আমি, এই যে আমার ঘর, এই যে আমার সংসার, এই যে আমার সমাজ, এই যে আমার দেশ, এই যে আমার রাষ্ট্র তারই ছবি।

গল্পকার বয়ানে কোথাও সঙ্কোচিত হননি, সাহস উজিয়ে চালিয়েছেন চেষ্টার প্রয়াস। ‘উঠান যখন বাতাবির সুগন্ধে ভরে উঠতো; তখন মায়ের রান্নার জাদুতে ভাতও হয়ে উঠতো সুগন্ধী। আজ সেই মায়ের জন্য পচা খাবার বরাদ্দ করে শিখা! মায়ের চার চারটি সন্তান কি আজ কেবল ভাগ্যনির্মিত ‘খোঁড়া-মানব?’ (স্বাদ অথবা গন্ধহীন)। গ্রন্থস্থ আরেক গল্প ‘জলাবৃত্ত চাঁদ’। এ গল্পে যেমন ভেসে উঠেছে বুক টনটন করা এ-দেশমাতৃকার শেকড়ে গাঁথা এক পরিবারের দেশ ত্যাগের নিঝুম বেদনার বেদনার্ত আর্তি তেমনি ‘চিহ্ন’ গল্পে আছে ভ‚তের মতো জেঁকে বসা এক কুসংস্কার, যা এই শতকে এসেও ভয় পাইয়ে দেয় আমাদের। পুরুষতান্ত্রিকতার জটাজাল কী করে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে গৃহ-গেরস্থালির মেঝ তা ‘চিহ্ন’ পাঠেই ধরা পড়ে। এ যেন এতকাল পরে এসেও বহুকাল পূর্বের নিশি জড়ানো কালের হাহুতাশ।

‘অতীশ আর বিনু। অতীশের উল্টো যানে চড়ে বসে বিনু। আঁকড়ে ধরতে চায় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে। বিনু তো তখনও জানতো না উল্টো যানে চড়া অতীশকে আঁকড়ে ধরলেও উল্টো পথে হাঁটা খুব সহজ নয়! তাই তো অতীশ বলতে বাধ্য হয়Ñ আমাকে বদলাতে যেও না বিনু। তোমার এতদিনের চেনা অতীশ বদলে গেলে, তুমি সহ্য করতে পারবে তো?’ (উল্টো যান)। হিতৈষী এক যুবকের জীবন চরিত্রের আলোকে আঁকা এ ‘উল্টো যান’ কতদিন আঁচড় হয়ে থাকবে জানি না। তবে এমন যুবকদের মিথ্যা আর বানোয়াট সত্য-মিথ্যার কাচের চাকচিক্যে যদি আমরা খুন করে ফেলি তবে আদতে আমাদের আত্মধ্বংসের পথ হবে প্রসন্ন। পাঠান্তে দেখি, গল্পকারের সুনিবিড় দেখায় আর দর্শনে প্রতিষ্ঠিত এই ‘জলজীবন’। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পগুলো পড়তে পড়তে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। কোথাও হঠাৎ থামতে হয় না। অকারণ ভাব-ভারিক্কিরও আরোপ নেই কোনো একটি গল্পের শরীরে।

সাহিত্য যে শুধুই বিনোদন নয়, প্রচল সমাজের ছবি; তা প্রামাণ করে ‘শ্রাবণী প্রামানিক’ এর দক্ষ অভিজ্ঞতার এই গল্পগ্রন্থ। ‘আমাদের চারপাশের এই লড়াই, এই ক্ষুধা, এইসব হারানোর গল্প বড়ো একঘেয়ে, তাই তো? ফুল-পাতা, বৃষ্টি বা নদী, নারী, প্রেম এসব ছাড়া গল্প হয়? না, হয় না। একটাই জীবন। এক জীবনের মানুষকে তাই সবগুলো ধাপ পেরিয়েই শিখরে পৌঁছতে হয়। গল্পের জীবন, জীবনের গল্প তাই চক্রাকারে চলতে থাকে....’ গল্প যদি হয় সমাজ ও জীবনের দর্পণ তবে ‘জলজীবন’ সেই দর্পণ। ‘জলজীবন’ পৌঁছাক পাঠকের হাতে। এমন গ্রন্থ পাঠ হোক আরও আরও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App