×

সাময়িকী

ছদ্মনামের কবি ও স্বনামে সাহিত্য সম্পাদক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২৭ পিএম

ছদ্মনামের কবি ও স্বনামে সাহিত্য সম্পাদক

আবুল হাসনাত ভাই কবিতা লিখতেন ‘মাহমুদ আল জামান’ ছদ্মনামে। পোশাকি নাম তার আবুল হাসনাত। এই নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন তিনি। প্রথমে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক,পরবর্তী ২০০৬ সাল থেকে সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘কালি ও কলম’-এর বিচক্ষণ সম্পাদক হিসেবে। ছদ্মনামে সাহিত্য সৃষ্টির ইতিহাস এ দেশের বহু পুরনো একটি সংস্কৃতি। ১৮ শতকে রাজা রামমোহন রায় লিখতেন শিবপ্রসাদ নামে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত টি মোথি পেনপোয়েম নামে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ছিল কমলাকান্ত। প্যারীচাঁদ মিত্র ব্যবহার করতেন টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভানুসিংহ কখনো বা আন্নাকালি পাখড়াশি। কাজী নজরুল ইসলাম নাম নিয়েছিলেন ধুমকেতু এবং ব্যাঙাচি।

এছাড়া ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী নিজেই ‘বীরবল’ ছদ্মনামে চলিত ভাষায় ‘বীরবলের হালখাতা’ নামক কলাম লিখে ১৯১৪ সালের মধ্যে সাধু ভাষার পরিবর্তে সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে চলিত ভাষাকে প্রতিষ্ঠিতও করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১০৬ বছর আগে। তিরিশের কবি জীবননান্দ দাশ লিখেছেন ‘শ্রী’ ছদ্মনামে। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন সত্যপীর নামে, হালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম হিসেবে নীললোহিত খুবই পরিচিত সবার কাছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘রূপচাঁদ পক্ষী’ হয়ে উড়েছেন কাব্যের আকাশময়। কবি শামসুর রাহমান আবার বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছদ্মনাম নিয়েছেন, যেমন সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক প্রভৃতি।

আবুল হাসনাত ভাইয়ের ছদ্মনামটি কোনো প্রতীকী নাম নয়, কেবলমাত্র ধুলো-মাটি-কাদায় সিদ্ধ নিজের প্রকৃত নামের আড়ালে অন্য এক অশরীরী কবিসত্তার স্পর্শ পেতেই বোধ করি মাহমুদ আল জামানের বুকে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন পলায়নপর এই কবি। ‘মাহমুদ আল জামান’-এর রূপকে কবিসত্তা বিনির্মাণে সঞ্চরণশীল এই নামটির প্রতি তার কোনো মানুষি দুর্বলতা ছিল কিনা আজ আর তা জানবার কোনো অবকাশ নেই। এই ছদ্মনামেই প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে ‘জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক’, ‘কোনো একদিন ভুবনডাঙায়’, ‘ভুবনডাঙার মেঘও নধর কালো বেড়াল’ ও ‘নির্বাচিত কবিতা’। তার সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ও গল্প সংকলন দুটি ঐতিহাসিক দলিল।

আবুল হাসনাতের আত্মস্মৃতি ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে’ এবারের একুশে গ্রন্থমেলার শেষ দিনে প্রকাশিত হয়েছে কবি তারিক সুজাতের জার্নিম্যান বুকস থেকে। বইটি পড়বার সুযোগ হয়নি আমার। ধারণা করি কবির আত্মজীবনীমূলক বইটিতে লুকানো রয়েছে তার সারা জীবনের সঞ্চয় কিংবা পাওয়া না পাওয়া ধনরতেœর সেই মহা-সিন্দুক, যা খুললেই বেরিয়ে আসবে কোহিনুরের দ্যুতি নয়তো শত সহস্র দীর্ঘশ্বাসের দহন। এই সব কিছু ছাড়িয়ে তিনি আজ যে অনন্তলোকের বাসিন্দা হয়েছেন, সেখানে এসব বাহুল্য কথার কানাকড়ি মূল্য নেই।

একজন সম্পাদক হিসেবেই মৃদুভাষী হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আশির দশকে সেই দৈনিক সংবাদের অফিসে। নবীন কবি হিসেবে লেখা দিতে যেতাম খুব ভীরু পায়ে। সন্তোষদাকে দেখেছি, তার সঙ্গে কথা বলব, তার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। কবিতাটি কোনো রকম হাসনাত ভাইয়ের হাতে গছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতাম। এরপর অনেক জল গড়িয়ে পদ্মা-মেঘনা-যুমনা পেরিয়ে আমি পৌঁছে গেছি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। উত্তরাধিকার পত্রিকার অপর বিখ্যাত সম্পাদক রফিক আজাদ আমার কবিতা ছাড়াও জীবন সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন এক ঋজু ভঙ্গিমায় জীবন-সংগ্রাম ও কাব্যযাত্রা দুই-ই এগিয়ে চলছিল। এই সময়টায় সম্পাদক হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার, কবিতার অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কুশল বিনিময়Ñ কখনো রবিদার বাসার নিমন্ত্রণে, কখনো আবার বেঙ্গলের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা উপলক্ষে মৃদু ভাষায় কুশল বিনিময়। এভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেছে সময়।

অনেক পরে জেনেছি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে ছাত্রনেত্রী নাসিমুন আরা হক আবুল হাসনাত ভাইয়ের স্ত্রী। কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের প্রয়াণের পরে আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে মনে হয় অক‚ল সমুদ্রে-পথের একলা যাত্রী যেন, নোঙরবিহীন জাহাজে। যে ক’জন ব্যক্তি-মানুষের নির্ভরতা, যাদের কেউ কেউ মাথায় বৃক্ষ-পত্রের ছায়া হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী ছাড়া যেমন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যার- দুজনেই চলে গেছেন। আরো যারা পাশে ছিলেন অভয়াশ্রমের মতো, তাদের মধ্যে কবি রবিউল হুসাইন এবং সর্বশেষ চলে গেলেন কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাত। এই দুজনেই কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের জন্য ছিলেন অঙ্গীকারাবদ্ধ ভালোবাসার অপর নাম। এছাডা বাংলার শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের মননশীল সব নক্ষত্র পতনের শূন্যতা আমাদের অসহায় করে তুলেছে। যাদের অনেকেই আজ বিগত। একাকিত্বের ঘোর কেটে আলোর মৃদু উদ্ভাসন দেখতে পেতাম যাদের মুখ দেখে, তারাও সব এক এক করে সময়ে-অসময়ে চলে যাচ্ছে দ্রুত। কিছুতেই থামছে না।

সর্বশেষ হাসনাত ভাইয়ের অন্তর্ধানের খবর শোনার পর থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসেছিলাম কতক্ষণ মনে নেই। কিছু লেখার কথা মনে হলেও হাত কাঁপছিল। কোনো কোনো শোক সংবাদ বিস্ময়ে বিমূঢ় করে তোলে, উদাসীন আকাশের দিকে তাকিয়ে তখন অসীমের হাত-পা, নাক-মুখ খুঁজতে থাকি যেন কেবলি। শোকাগ্নিতে আচ্ছন্ন করে রাখে দুচোখের নিদ্রা। তখন ঘুম-ঘোরের আশ্রয়ে পালাতে চেয়েও কিন্তু পারি না।

দুদিন আগে মিনু আপার সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে কথা হলো। মিনু আপাকে কী করে বলব, আমরা তো হাসনাত ভাইয়ের জন্য প্রার্থনার হাত তুলেই অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম, বাড়িতে ফিরে আসার সংবাদ পাব বলে। যেহেতু করোনা নয়, সেজন্য আশা ছিল কিছুতেই তিনি হারাবেন না। ১৯৭২-৭৩ সালে মিনু আপা আমাদের শামসুন্নাহার হলে কী দাপুটে ছাত্রনেত্রী। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী আমরা, দূর থেকে তাকিয়ে দেখি তার মায়াবী চোখ-মুখের অঙ্গীকার।

সারাজীবন একই পথে হাঁটলেন। কতজন কতভাবে বদলে গেল আমাদের চোখের ওপর দিয়ে। তারা দুজন রয়ে গেলেন একই চিন্তা-চেতনায়। দেশ, দেশপ্রেম, অসম্প্রদায়িক চেতনার নবরূপায়ণ ও বাস্তবায়নে- সাহিত্য ও সংস্কৃতির কর্মক্ষেত্রকে লক্ষ করে দুজনেই দুর্মরভাবে কাজ করে গেলেন সারাজীবন।

‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকী পাতার সম্পাদক কবি মাহমুদ আল জামান ওরফে হাসনাত ভাইকে পেলাম সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা ’কালি ও কলম’-এর অভিনব যাত্রার সারথি হিসেবে। একজন মেধাবী, দক্ষ ও বিচক্ষণ সম্পাদক হিসেবে হাসনাত ভাই সেই মাসিক কালি ও কলমকে নিয়ে গেলেন তিনি, এমন এক উচ্চতায় যে, মননশীল শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকার নাম বলতে হলে প্রথম সর্বশেষ সংখ্যাটিও তিনি করলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। যিনি ছিলেন এই পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। হাসনাত ভাই ছিলেন তার বিচক্ষণ সম্পাদক। এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কবি রুবী রহমানও।

মাসখানেক আগেও হাসনাত ভাইকে একটা লেখা পাঠিয়ে ফোনে কথা বলে জানলাম, স্যারকে নিয়ে যে সংখ্যাটি হচ্ছে, কাগুজেপত্রস্থ এটি আপাতত করোনাকালে শেষ সংখ্যা। এরপর যে সংখ্যাটি বেরুবে, সেখানেই আমার লেখাটি ছাপবেন বলে জানালেন। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘দুই দেশ এক মঞ্চ’। কলকাতায় অনুষ্ঠিত এই আয়োজন করেছিল কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে ড. আনিসুজ্জান স্যারকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে সর্বশেষ। কবি রবিউল হুসাইন, আবুল হাসনাত, আনোয়ারা সৈয়দ হক, তারিক সুজাত, মাহমুদ হাফিজ এবং আমিও আমন্ত্রিত কবি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম সেখানে। কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়ের আতিথেয়তায় একই হোটেলে সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে যে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম তিন দিনÑ সেইসব স্মৃতিকথন নিয়ে লেখাটি পাখা মেলেছিল উড়বে বলে।

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন হাসনাত ভাই। তিনি ছিলেন গবেষণা সম্পাদক। ২০২১ সাল থেকে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পুরস্কার প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে স্মৃতি পর্ষদ, সেই নেপথ্য সহায়ক শক্তি ছিলেন হাসনাত ভাই। তাকে আহ্বায়ক করেই তিন বা পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।

পুরস্কারের নিয়মাবলি কেমন হবে, সবই তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। বিশেষভাবে কালি ও কলম পুরস্কার প্রদানের ব্যাপক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি পুরস্কারের মর্যাদা ও মানদণ্ডকে কীভাবে নিরপেক্ষ রাখা যায়, সেই বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন, এই সেদিনও। ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’-এর জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের একজন বিচারক হিসেবে বেশ ক’বার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছি। ধারণা করি, তিনি হয়তো সাহিত্য বিচারের যোগ্য মানুষ হিসেবে আমাকে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু কোনোদিনও তাকে তা জিজ্ঞেস করা হয়নি। তিনি এতটাই নিভৃতচারী এবং প্রয়োজনীয় কথা বলার মানুষ যে, তার সঙ্গে কখনো সেই প্রচুর বৃষ্টির মতো ব্যাপক আলাপ হয়নি।

২০১৮ সালে মুক্তধারা বইমেলায় নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি এলেন বাংলাদেশ থেকে, বাংলাদেশ থেকে সে বছর আরো এলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ডক্টর শামসুজ্জামান খান, শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সয়ীদ, নাট্যশিল্পী রামেন্দ্র মজুমদার, ছড়াশিল্পী আমিরুল, সংগীতশিল্পী লিলি ইসলামসহ প্রকাশকরাও ছিলেন অনেকেই। আমি গেলাম টরন্টো থেকে। লন্ডন থেকে এলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। অটোয়া থেকে লুৎফর রহমান রিটন। চমৎকার প্রাণবন্ত আড্ডায় ও আয়োজনে কেটেছে সময় বেশ কটা দিন। অসম্প্রদায়িক চেতনা বিধৌত শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অসাধারণ এক স্বর্ণ হৃদয়ের মানুষকে হারালাম আমরা। অপূরণীয় এই ক্ষতির কোনো শেষ নেই। অনন্তে শান্তিতে বাস করুন কবি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App