×

মুক্তচিন্তা

সমাজসেবক জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:২৪ পিএম

আজ ৫ অক্টোবর প্রবাদ প্রতিম শিশুচিকিৎসক, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক, চিকিৎসা-শিল্পোদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কারমনস্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের (১৯২৮-২০১৬) চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।

শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তা তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে- এ সুযোগলাভ তার অধিকার। ডা. এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উঁচুমাপের চাকরির সুযোগ ও সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছেন পথিকৃতের ভ‚মিকায়। কর্মজীবনে ডা. এম আর খান দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রæপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তারপর দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।

১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগদান করেন এবং এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ডা. খান ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে পুনরায় তিনি বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক (ডা.) এম আর খান তার সুদীর্ঘ চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বিভিন্ন সময়ে পেশাভিত্তিক কর্মকাণ্ড ও সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অধ্যাপক (ডা.) এম আর খান নিজে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বধি বিএসএমএমইউর ভিজিটিং প্রফেসর, আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ভিজিটিং প্রফেসর, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এবং বারডেমের অনারারি উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে চলেন। সময় সচেতন অধ্যাপক (ডা.) এম আর খান তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ব্যয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কাজে। বিএসএমএমইউতে পেডিয়াট্রিক শিক্ষায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি চালুর ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তার ছিল অনন্য ভ‚মিকা। এ হাসপাতালে তিনি নতুন নতুন ইউনিট খোলেন যেমন আউটডোর, প্যাথলজি, রেডিওলজি ডিপার্টমেন্ট, পেয়িং ইউনিট, ইউনেটোলজি এন্ড নিউট্রিশন ইউনিট ইত্যাদি স্থাপনসহ বেডের সংখ্যা ১৫০ থেকে ২১৫-এ উন্নীত করেন। তিনি বিএসএমএমইউতে পেডিয়াট্রিক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স চালু করেন।

১৯৮৬ থেকে এ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যবিধায়ক কাউন্সিলের সিনিয়র সদস্য অধ্যাপক এম আর খান আহ্ছানউল্লা ক্যানসার হাসপাতালের অন্যতম উপদেষ্টা সদস্য এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ছিলেন প্রবীণতম সদস্য। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নতুন পেডিয়াট্রিকস ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে উপযোগী এফসিপিসি, ডিসিএইচ এবং এমসিপিএস নতুন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স প্রবর্তন করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা, প্রশাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ডা. খানের অবদান অনস্বীকার্য।

সদাশয় সরকার তার এই মহৎ অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক পদবিতে ভ‚ষিত করেছেন এবং তার পরিকল্পনায় ও প্রযতেœ শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দিয়েছেন সক্রিয় ও সার্বিক সহযোগিতা। তার মহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার কারণেই এই দেশে শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা সম্ভব হয়েছে। তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতি সংসদ স্বর্ণপদক (১৯৯২); কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় স্বর্ণপদক (১৯৯৩); কবি সরোজিনী নাইডু স্মৃতি পরিষদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭); খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা স্বর্ণপদক (১৯৯৮); বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সমাজসেবা স্বর্ণপদক (১৯৯৯); ইবনে সিনা স্বর্ণপদক (১৯৯৯); নবাব সলিমুল্লাহ পুরস্কার (২০০৬) একুশে পদক (২০০৯) এবং স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন। অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডন-আমেরিকায় যান। কিন্তু পড়াশুনা শেষ করে আর দেশে ফেরেন না। ওখানেই স্থায়ী হয়ে যান। উন্নত দেশে গিয়ে ভুলে যান পেছনে ফেলে যাওয়া এই জন্মভ‚মির জনগোষ্ঠীর কথা। কিন্তু ভুলতে পারেননি ডা. এম আর খান। নিজ জেলা সাতক্ষীরার প্রতি তার অদম্য আকর্ষণ। কখনো কোনো প্রসঙ্গে তার জন্মস্থান সাতক্ষীরার কথা উঠলে সুযোগমতো একটি কবিতার ক’টি চরণ দরদ দিয়ে প্রায়ই তিনি শোনান সবাইকে- ‘দেশের সীমানা, নদীর ঠিকানা যেথায় গিয়েছে হারিয়ে, সেথা সাতক্ষীরা, রূপময় ঘেরা বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।’

১৯৫৬ সালে ডা. এম আর খান সস্ত্রীক লন্ডনে যান। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলছিলেন, পড়াশুনা শেষে চাকরির অফার পেয়েছিলেন লন্ডনের হাসপাতালেই। কিন্তু নাড়ির টানে তিনি চলে আসেন দেশে। এমআরসিপি পাস করার পর সিক চিলড্রেন হাসপাতালের প্রধান ডা. ডিকশন ডাকলেন এম আর খানকে। তিনি ওখানে ভালো সুযোগ দিতে চাইলেন। বললেন- তোমার মেয়ে ম্যান্ডি এখানে পড়ে। তোমার স্ত্রীও এই সমাজে সম্মানিতা। তুমিও ভালো ইনকাম করো। কেন দেশে ফিরতে চাও? তিনি বলেছিলেন, আমার দেশ খুব গরিব। এই গরিবদের চিকিৎসা করার কেউ নেই। আমরা এদেশ পড়ে থাকলে তাদের দেখবে কে? সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ে গিয়েছিল জেনারেল মন্টেগোমারির কথা। তিনি ক্যাডেটদের বলেছিলেন, ‘উড়হ’ঃ ভড়ৎমবঃ গু এড়ফ. গু ঈড়ঁহঃৎু ধহফ গু ছঁববহ’ এই তিনটি কখনো ভুলো না। হ্যাঁ, এ ধরনের দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবোধ তাকে প্রচÐভাবে নাড়া দিয়েছিল বলেই তিনি সব লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দিতে পেরেছিলেন সেদিন। ডা. ডিকশন বললেন, দেশে তোমাকে খুব স্ট্রাগল করতে হবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ধর্মপ্রাণ তরুণ ডা. এম আর খান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে উত্তরে বলেছিলেন- এড়ফ রিষষ যবষঢ় ঁং.

অধ্যাপক (ডা.) এম আর খান একজন লেখক এবং গবেষকও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া তিনি শিশুরোগ চিকিৎসা সংক্রান্ত বই লিখেছেন ৭টি। যা দেশে ও বিদেশে বহুল প্রশংসিত। বইগুলো হচ্ছে : ‘ঊংংবহপব ড়ভ চধবফরধঃৎরপং’ (প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৯) ‘চড়পশবঃ চবফরধঃৎরপ চৎবংপৎরনবৎ’ (প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮২), ‘ঊংংবহপব ড়ভ ঊহফড়পৎরহড়ষড়মু’, ‘প্রাথমিক চিকিৎসা’, ‘মা ও শিশু’ (প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬), ‘আপনার শিশুর জন্য জেনে নিন’ (প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৭৬), ‘শিশুকে সুস্থ রাখুন’ এবং ‘ড্রাগ থেরাপি ইন চিলড্রেনসহ (প্রকাশকাল : জুন ২০০৬) আরো একাধিক গ্রন্থের তিনি যুগ্ম প্রণেতা।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App