×

সাহিত্য

নেত্রকোনার শিল্পীদের অবস্থা দিনমজুরের চেয়েও খারাপ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২০, ১১:৩৬ এএম

নেত্রকোনার শিল্পীদের অবস্থা দিনমজুরের চেয়েও খারাপ

করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে এমন নৃত্য উৎসব।

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ৩৩তম প্রতিবেদন।

ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস প্রাচীন ঐতিহ্যে টইটম্বুর ও ঐতিহ্যের বিচিত্র সম্ভারে গর্বিত। গারো পাহাড়ের পাদদেশ লেহন করে এঁকেবেঁকে কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, ঘোড়াউত্রাসহ অন্যান্য শাখা নদী নিয়ে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার জলধারার উদ্ভব। তৎকালীন সুসঙ্গ, নাসিরূজিয়াল, মৈমনসিংহ, সিংধা ও খালিয়াজুরী পরগণার ভূমি নিয়ে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার অবস্থান।

ব্রিটিশ আমলে এ জেলায় কৃষক বিদ্রোহ, পাগলপন্থি বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলন সংঘটিত হয়। জনশ্রæতি আছে, নেত্রকোনা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মগরা নদীর বাঁক চোখের বা নেত্রের কোণের মতো বলে এই জায়গার নামকরণ হয়েছে ‘নেত্রকোনা’। কেউ কেউ এমনও মনে করেন, মগরা ও কংস নদী পরিবেষ্টিত এই জেলা দেখতে চোখ বা নেত্রের মতো বলেই এমন নামকরণ।

নেত্রকোনার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে বিজয়পুরের নৈসর্গিক পাহাড়ের সাদা মাটি, বিরিশিরি কালচারাল একাডেমি, কমলা রানী দীঘি, টংক শহীদ স্মৃতিসৌধ, রানিখং মিশন টিলায় ক্যাথলিক গির্জা, রাশমণি স্মৃতিসৌধ, কথিত নইদ্যা ঠাকুরের ভিটা, কলমকাকান্দার লেগুরা, চেংটি ও গোবিন্দপুর পাহাড়, ঐতিহাসিক সাত শহীদের মাজার, কেন্দুয়ার রোয়াইলবাড়ীর পুরাকীর্তি, সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি, নেত্রকোনার হাওর, সোমেশ্বরী নদী ইত্যাদি। মগরা, কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, ঘোড়াউত্রা নদীর শহর নেত্রকোনায় হানা দিয়েছে করোনা। এর ধাক্কায় সত্যিকার অর্থেই শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মানুষদের নেত্র ভিজে উঠছে জলে!

সূত্র জানায়, নেত্রকোনায় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। সংস্কৃতি কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। তাদের অনেকে পেশায় তবলা, সংগীত, গীটার, নৃত্য শিল্পী, বাউল শিল্পী ও প্রশিক্ষক। যারা সরকারি-বেসরকারি নানা অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এদের মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৬০০ জনের তালিকা দেয়া হয়। ১০০ জনকে অনুদান দেয়া হলেও অনেকের জীবনই দুর্বিপাকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নেত্রকোনার সাংস্কৃতিক অঙ্গন এখনো স্থবির। অধিকাংশ শিল্পীর জীবনই কাটছে অর্থনৈতিক দুর্দশায়। অনন্যেপায় হয়ে কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ ধারদেনা করে চলছেন। করোনাকালে এসব শিল্পীদের সহায়তার অর্থ বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে শিকড় উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রফিকুল ইসলাম আপেল ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের নেত্রকোনায় সংস্কৃতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে জনগণ। তারাই করোনায় আক্রান্ত। ফলে সীমাহীন অর্থ কষ্টে শিল্পীরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। পেশায় টিকে থাকতে না পেরে কেউ রিকশা চালাচ্ছে, দিনমজুরি করছে। অনেক বয়স্ক বাউল ও যাত্রা শিল্পী আছেন যারা গান গেয়ে সংসার চালাত। তাদের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ।

তিনি বলেন, করোনাকালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সহায়তা দিয়েছে ৫ হাজার আর জেলা প্রশাসন ১ হাজার টাকা। ওই সহায়তা একেবারেই অপ্রতুল। যা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি সাংগঠনিক সহায়তারও দাবি জানাচ্ছি। সংগঠনগুলোও এখন ধুকছে অফিসের বকেয়া ভাড়াসহ নানা সংকটে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সংগঠনও টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে।

নৃত্যশিল্পী হাবিবুর রহমান মজনু বলেন, নাচই আমার একমাত্র পেশা। করোনার ধাক্কায় সবই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একেবারে অসহায় হয়ে ঘরে বসে আছি। জমানো টাকাও শেষ হয়ে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সহায়তা পেয়েছি। তবে এখন চলছি ধারদেনা করেই। এমন পরিস্থিতিতে চা, পান, সিগারেটের দোকান কিংবা অন্য কিছু করতে গেলেও তো টাকার প্রয়োজন। তাও নেই। এ মুহূর্তে আমাদের অবস্থা দিনমজুরের চেয়েও খারাপ হয়ে গেছে। এই দুঃসময়ে সরকারকে আমাদের পাশে চাই।

বাউল শিল্পী সিরাজুদ্দীন খান পাঠান বলেন, ৫৭ বছর ধরে গান গেয়ে বেঁচে আছি। জীবনে এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে ভাবিনি। চতুর্দিকেই বাঁচার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল আমি নই, আমরা যারা বাউল গানের সঙ্গে জড়িত, তারা সবাই করোনার কষাঘাতে পিষ্ট। এক বেলা খেলে অন্য বেলা উপোষ থাকতে হচ্ছে। খুব দুরবস্থায় আছি। দুঃখের কথা হচ্ছে, গান ছাড়া আমি অন্য কিছু করতেও পারি না। তারপরও আশায় আছি এই ভেবে, মানুষ তো মানুষের জন্য। তাই সরকারের পাশাপাশি মানুষের দিকেই তাকিয়ে আছি।

বাউল শিল্পী রাসেল সরকার বলেন, গান গেয়েই আমি নুন-ভাতের খরচ জোগাতাম। কিন্তু করোনায় জীবন-জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যেন নুনে-ভাতে করোনার উৎপাত! এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি কষ্টের কথা কারো কাছে মন খুলে বলতেও পারছি না। হাত পেতে চাইতেও পারছি না। তারপরও কাছের মানুষদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App