×

মুক্তচিন্তা

বর্জ্য যখন বাণিজ্যের উপাদান!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৩২ পিএম

সেতু, সড়ক, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, স্বাস্থ্যসেবা, বালিশ, চাদর, ছোট-বড় প্রকল্প, মশা মারার ওষুধ, এমনকি বৈশ্বিক মহামারি করোনা টেস্ট, মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি নিয়ে কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, দুর্নীতির গল্প বেশ জানে এ দেশের মানুষ। বলা ভালো জেনে গেছে। অন্তত এমন গল্পের আকাল নেই বলে। আকাল পড়ে না, পড়ছে না কখনই। সরকারপ্রধানের কঠোর হুঁশিয়ারি থাকা সত্ত্বেও এসব হয়। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির গল্প ডালপালা মেলে চোখের সামনে চলে আসছে। ফলে ভালো কোনো কাজকেও আজকাল কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখেন। তার ভেতর অনৈতিক নমুনা বের করতে অনুসন্ধানী হয়ে ওঠেন। অনেক সময় নিজের মতো করে একটা নেতিবাচক গল্প দাঁড় করিয়ে ফেলেন। গল্প একমুখ থেকে অন্যমুখে পৌঁছে যায়। কেউ কেউ এসব গল্পকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন। ‘গুজব’-এ কান দিতে বারণ করেন আবার কেউ কেউ। ‘গুজব’-এর বিরুদ্ধে কঠোর শাসনও উচ্চারিত হয়। সব দোষ যেন তৃতীয় পক্ষের। প্রথম পক্ষ আর দ্বিতীয় পক্ষ ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন, থাকবার চেষ্টা ও ব্যবস্থা করেন। যদিও তাদের ধরা খেতেই হয় শেষ অব্দি। প্রকৃতির মার কঠিন। এর থেকে এরা রেহাই পান না। কেউ রেহাই পেয়েছেন ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালনের চেয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন, এমন ধারণা এখন ঘরে ঘরে, পথে-ঘাটে। বিশেষ করে যারা ভুক্তভোগী, তাদের ভাবনা এমনই হয়। সমাজে কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতি এমন একটা কাজ যা একা করা যায় না, করা প্রায় অসম্ভব। অপরাধীরা মৌচাকের মতো এক একটা চক্র বানান, যেখানে ক্ষমতার বিষয়টি সুনিশ্চিত হয়ে থাকে বৃত্তাকারে। এক, দুই করে যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে অপরাধীরা, অন্যায়কারীরা জড়ো হয়, তারপর বড়ো হয়। এভাবে অতিবিত্তবানের সংখ্যা বাড়ে। আলট্রা ওয়েলদির পরিচিতি লাভ করে এই ভূখণ্ড আনন্দচিত্তে নয়, চরম বিস্ময়ে। সম্প্রতি বর্জ্য বা আবর্জনা অপসারণ নিয়ে বাণিজ্যের একটা সংবাদ প্রতিবেদন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। হতভম্ব হতে হলো। কী অভিনব বাণিজ্যিক চিন্তা বর্জ্যদ্রব্য অপসারণ বা সংগ্রহ নিয়ে! সংবাদ প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো সিটি করপোরেশন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চেয়ে বর্জ্য বাণিজ্যে বেশ মনোযোগী। তাই কি অভিজাত এলাকা ছাড়া অন্যান্য জায়গা অপরিচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে? জবাব বোধহয় সিটি করপোরেশনই ভালো দিতে পারে। পাশর্^বর্তী দেশ ইন্ডিয়ায় বর্জ্যদ্রব্যকে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় সংগ্রহ করে নগর পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি বর্জ্য পুনঃচক্রায়নের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী দ্রব্যে পরিণত করা হয়। আর বাংলাদেশে বর্জ্য অপসারণ নিয়েই বাণিজ্যের সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে গেছে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়, বর্জ্য বাণিজ্য ধুমসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে। নীতিগতভাবে সিটি করপোরেশনের কাজ হলো নগরকে পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বিভিন্ন ধরনের নাগরিকসেবা প্রদানের মাধ্যমে নগরকে নাগরিকদের বাস উপযোগী করে রাখা। সে সূত্রে সিটি করপোরেশনের অন্যতম একটি কাজ হলো নগরীর বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলার পাত্রের ব্যবস্থা করা, যেন সেখানে আশপাশের বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানের ময়লা-আবর্জনা নাগরিকরা ফেলতে পারেন এবং সেখান থেকে সিটি করপোরেশন গাড়ি দিয়ে ময়লা অপসারণ করে নেবে। গল্পটা কিন্তু অন্যরকম জানছি। সেই আভাস প্রতিবেদনে পাওয়া গেল। ঢাকার বাসাবাড়ি ও রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন উৎপাদিত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা দুই সিটি করপোরেশনের একটিতেও নেই। যা আছে তা হলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহযোগী সংগঠন হিসেবে নিবন্ধিত তিন শতাধিক বেসরকারিভাবে বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান, যা পিডবিøউসিএসপি নামে পরিচিত। যেসব প্রতিষ্ঠান আবার ক্ষমতা, প্রভাবে নিবন্ধিত। পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ঢাকা শহরে দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী হোল্ডিং সংখ্যা ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫টি। এই হিসাব কতটা সঠিক সেই বিতর্কে না গিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে প্রতিটি হোল্ডিংয়ে যদি গড়ে ৬টি করে ফ্ল্যাট থাকে এবং প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে যদি গড়ে ১৫০ টাকা বর্জ্য সংগ্রহের জন্য আদায় করা হয় তাহলে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে ৩৬ কোটি এবং প্রায় ৪৩ কোটি টাকা আদায় করা হয়। আর ৭ হাজার রেস্টুরেন্ট থেকে মাসে ১ কোটি ৪০ লাখ এবং বছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা আদায় হচ্ছে। নিঃসন্দেহে বিশাল বাণিজ্য চলছে ময়লা, আবর্জনা সংগ্রহ নিয়ে। এক সময়ে ময়লা, আবর্জনা সংগ্রহের জন্য বাসাবাড়ি থেকে ২০ থেকে ৫০ টাকা ছিল। সম্প্রতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা আনার অজুহাতে ৫ থেকে ১০ গুণ ফি বাড়ানো হয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা না আসার দায় এখন নগরবাসীর ঘাড়ে। নাকি এই ফি বাড়িয়ে দেয়ার নেপথ্যে কোনো গল্প আছে? নাগরিকরা কিন্তু বিনামূল্যে এই সেবা গ্রহণ করেননি কখনই, করেন না। মূল্য দিয়েই তারা নাগরিকসেবা গ্রহণ করেছেন, করছেন এবং করতে চান। অবশ্যই সেটা ন্যায়সঙ্গতভাবে। কিন্তু এই সেবা যে বাণিজ্যের বিষধর ফণা তুলে নাগরিককে ছোবল মেরে চলছে ক্রমাগতভাবে সেই দায়টা কার হবে, হওয়া উচিত প্রশ্ন থেকে যায়। ২০০০ সাল থেকে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়ে তার নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি ময়লা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত পিডবিøউসিএসপি কর্মীদের বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহের জন্য ৩০ টাকা করে আদায়ের অনুমতি দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সম্প্রতি সেই নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ডিএনসিসি। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে পিডবিøউসিএসপির সাড়ে ৪ হাজার কর্মী। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অভিযোগ, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের স্বার্থে এমন করা হয়েছে। কারণ বর্জ্য সংগ্রহের কোটি কোটি টাকার বিশাল বাণিজ্যে আধিপত্যের লোভ কাউন্সিলররা সামলাতে পারছেন না। ইতোমধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলর বর্জ্য সংগ্রহের জন্য নিজেরা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। জনপ্রতিনিধিরা এটা করতে পারেন কিনা আমার জানা নেই। কাউন্সিলররা নিজের লোকজনের মধ্যে ওয়ার্ডগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। আবার অভিযোগ রয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দরপত্রের মাধ্যমে নিজেরাই বর্জ্য বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। যতদূর মনে পড়ে এই সিটি করপোরেশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই মেয়র দুর্নীতির অভিযোগে কয়েক কর্মকর্তাকে অপসারণ করেছিলেন। এমন ঘটনায় আশ্বস্ত হয়েছিলাম, অন্তত দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অনিয়ম আর হবে না। অপসংস্কৃতির জায়গা হবে না। সিটি করপোরেশনে কাজ করছেন বলে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবেন, সেই সম্ভাবনা আর থাকছে না। কিন্তু ময়লা অপসারণ বা সংগ্রহ নিয়ে বাণিজ্য ও কৌশল চলছে সিটি করপোরেশনে তাতে সন্দিহান হয়ে পড়ছি। অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের মতো একদিন কেঁচো খুঁড়তে ভেতর থেকে অজগর সাপ বেরিয়ে আসবে না তো? একজন নিম্ন আয়ের সৎ ও শিক্ষিত শ্রমজীবী আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, পড়ালেখা আর সততার দাম কমে গেছে। দাম বেড়েছে চাটুকদার আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের। দেশের সব সুযোগ-সুবিধা এদের ঘরে। সিস্টেম তেমন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন পরিবর্তন আসুক, অথচ আসছে না এদের কারণেই। নিঃসন্দেহে কথাটা বর্তমান অবস্থার একটা স্বচ্ছ ক্যানভাস। জনগণের জন্য প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন জনগণের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন করার চর্চার বিষয় রাখে না, সেই প্রশ্ন কিন্তু অমূলক নয়। বরং উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলে সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে। অনেকটা রোগ শনাক্তের পর চিকিৎসা কার্যকর হওয়ার মতো। পরিশেষে বলি, অনিয়ম থেকে সরে আসার জন্য দরকার সঠিক কাজটি করা। যে কাজ সংবিধানসম্মত এবং নির্বিঘ্নে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে। সর্বোপরি জনগণকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা দেয়। বাংলাদেশে কোটিপতি হওয়ার পথ সহজ হয়েছে অনিয়মের কারণে। প্রকৃত মানুষ হওয়ার পথ সেই অনিয়মের কারণেই কঠিন হয়ে উঠেছে। সমাজ থেকে ময়লা অপসারণ জরুরি। তার আগে নিজেকে ময়লামুক্ত হতে হবে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি-গোষ্ঠী কতটা ময়লামুক্ত দেখা দরকার। স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App