×

মুক্তচিন্তা

ধাক্কা সামলাতে উদ্যোগ দরকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২০, ০৯:২২ পিএম

ধাক্কা সামলাতে উদ্যোগ দরকার
করোনায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড, ১৭ মিলিয়ন অধিবাসী নিয়ে সেন্ট্রাল ইউরোপের ছোট্ট দেশ নেদারল্যান্ডসও এর ব্যতিক্রম নয়। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। প্রথম ধাক্কা যেনতেন করে সামলে নিয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় অনেকটাই মুর্মূষু। বিশ্বের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে একটি দাবি করা ডাচেরা করোনার কাছে পর্যুদস্ত। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অসন্তোষ, বছরের পর বছর প্রতি মাসে এত টাকার চিকিৎসাবিমা দিয়ে আসার পর এখন যখন চিকিৎসা প্রয়োজন, তখন হাসপাতালে জায়গা নেই, আইসিইউতে বেড খালি নেই শুনতে আর রাজি নয় জনগণ। প্রতিজন ডাচ ন্যূনতম ১১শ ইউরো বছরে নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যবিমা পরিশোধ করেন, এর বাইরে তার প্রতিষ্ঠান আর সরকারও স্বাস্থ্যবিমার নির্দিষ্ট অংশের ব্যয় ভার বহন করে থাকে। সেগুলো যোগ করলে ব্যক্তিভেদে বছরে ৩ হাজার ৬৮০ থেকে ৫ হাজার ৩০০ ইউরো পর্যন্ত দাঁড়ায়। করোনার কারণে সরকারের অর্থায়ন ধাক্কা খেয়েছে। কয়েক বছর ধরে বাজেটের উদ্বৃত্ততার পর ২০২০ সালে ঐতিহাসিকভাবে বড় ঘাটতি হয়েছে। তাতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তবে তার জন্য জমানো অর্থ ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতি যখন ভালো করছিল, সরকার তখন বাফার তৈরি করেছে। করোনা সংকটের অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য সরকার প্রচুর অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে। বড় প্রতিষ্ঠান, ছোট ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী সবাইকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একই সময়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপাতত কর পরিশোধ না করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় করের পরিমাণ কমানো এবং ছাড় দেয়া হয়েছে। এতে সরকারের সর্বমোট ব্যয় হবে ৬২ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। এর মধ্যে ২০২০ ও ২০২১ সালের অর্থবছরে বড় প্রতিষ্ঠান, ছোট ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীদের সাহায্য করার জন্য ৪৫.৯ বিলিয়ন ইউরো ধরা হয়েছে। করের ছাড়, কর কমানো আর দেরিতে পরিশোধের কারণে খরচ হবে ১৬.৬ বিলিয়ন ইউরো। গত ৫ বছরের পর এবার ঘাটতি বাজেট এলো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। গড় প্রবৃদ্ধি কমেছে শতকরা ৭.২, যার পরিমাণ ৫৬ বিলিয়ন ইউরো। ২০২১ সালেও ঘাটতি বাজেট হবে বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ধারণা করা হচ্ছে ৫.৫ ভাগ কম হবে, যার পরিমাণ হবে ৪৫ বিলিয়ন ইউরো। তবে সেটি এখনো নির্ভর করছে সামনের মাসগুলোতে করোনা ভাইরাস কোন দিকে মোড় নেবে তার ওপর। এত সংকটের মধ্যেও রাজা এবং রানীর ভাতা ৫ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, দুজনেরটা একসঙ্গে ধরলে পরিমাণ দাঁড়ায় বার্ষিক ৭.২ মিলিয়ন ইউরো। রাজকন্যা আমালিয়া এই ডিসেম্বরে ১৮ হবে, ডিসেম্বর থেকে সেও মাসিক ১ লাখ ১১ হাজার ইউরো ভাতা পাবে যেটি সামনের অর্থবছর ২০২১-২২ হবে ১.৬ মিলিয়ন ইউরো। রাজ পরিবারের এই আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত। এই প্রবৃদ্ধি বিরোধী দল আর জনগণের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের তীর্যক আলোচনা ও মন্তব্য আসতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে আর রাজ পরিবারের মধ্যে দারুণ সখ্য। রাজ পরিবারের করমুক্ত আয়ের সমালোচনার জবাবে তিনি বারবার একই কথা বলে যান, ‘আ ডিল ইজ আ ডিল’। ইউরোপের মধ্যে ডাচ রাজ পরিবারকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পরিবার হিসেবে ধরা হয়। মোটামুটিভাবে তারা বছরে ৪০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে থাকেন, যার মধ্যে তাদের নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত নয়। নেদারল্যান্ডসের জনগণ তাদের নিরাপত্তা, প্যালেসের সংস্কার, ঘোড়া গাড়ির ব্যয় বহন করে থাকে। ডাচ প্রিমিয়ে মার্ক রুতে প্রায়ই তার ভাষণে ‘আ ডিল ইজ আ ডিল’ কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। যদিও বিদেশি এক্সপার্টদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তার কথা রাখেননি। বিদেশ থেকে স্পেশালিস্ট নিয়ে আসার জন্য ডাচ সরকারের কিছু করের সুবিধা ছিল। যাদের বার্ষিক বেতন ন্যূনতম ৩৭ হাজার ইউরো তাদের বেতনের ৩০ ভাগ করের আওতামুক্ত ছিল, আর এই সুযোগটি প্রতি জন প্রথম ১০ বছরের জন্য নিতে পারত। সেটিকে কমিয়ে প্রথমে ৮ বছর আর এখন ৫ বছরের জন্য করা হয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে যারা নেদারল্যান্ডসে চাকরি নিয়ে আসবেন তারা আর এ সুযোগটি পাবেন না। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটাস্টিক্সের মতে, প্রায় ৫৭ হাজার এক্সপার্ট বছরে এই করমুক্ত সুযোগটি ব্যবহার করে থাকে। এই করমুক্ত সুবিধার সময় কমিয়ে দেয়াতে প্রতি বছর ডাচ সরকার প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ইউরো লাভবান হচ্ছে। এই সঙ্গে এক্সপার্টের বাচ্চাদের ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ার খরচ দেয়ার করমুক্ত সুবিধাও কোম্পানিগুলোকে ৫ বছরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। একজন এক্সপার্টকে যেহেতু বেতনের শতকরা ৫২ ভাগ কর দিতে হয়, ৩০ ভাগ করমুক্ত বেতনের আওতায় পাওয়া টাকার সুবিধার পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। ডাচ সরকারের এই ব্যবহারে এক্সপার্টরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ করেন। তাদের স্লোগানে লেখা ছিল, ‘প্রিমিয়ে রুতে, আ ডিল ইজ আ ডিল’। এতে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে, এক্সপার্টদের নিজেদের দেশে ফেরত চলে যেতে বলেন। নেদারল্যান্ডসের রিসার্চ আর ডেভেলপমেন্ট চলে ৮০ ভাগ বিদেশিদের দ্বারা। সে জায়গায় কোনো সরকারপ্রধান থেকে এ ধরনের বক্তব্য আশা নিতান্তই হতাশাজনক। ৩০ অক্টোবর থেকে বেলজিয়াম পুরোপুরি লকডাউনে চলে গেছে, নেদারল্যান্ডসকে অনুসরণ করে ফ্রান্স, ইতালি আর স্পেন আছে আংশিক লকডাউনে। ট্রেন ২ মিনিট দেরি করে প্ল্যাটফর্মে এলে স্ট্রেস হয় যে জাতি তারা বিশ্বের ৭ নম্বর আর ইউরোপের ৬ নম্বর করোনা আক্রান্তের শীর্ষে অবস্থান করে কি করে এই মুমূর্ষু অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে সেটি এখন দেখার বিষয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, এখনো দেশের অধিকাংশ জনগণ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতের ওপর আস্থা রেখেছে, তিনি অর্থনীতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সমৃদ্ধ নেদারল্যান্ডস ফিরিয়ে আনবেন এই আশা ডাচদের মনে দৃঢ়। নেদারল্যান্ডস থেকে তানবীরা তালুকদার : কবি ও লেখক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App