×

মুক্তচিন্তা

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২০, ১০:৫৪ পিএম

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায়
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের বর্বরতার অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়ার আর এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের দিবস। এই দিন একদিকে সেনানিবাসে ক্ষমতার পালাবদল ও অভ্যুত্থান ঘটে, অন্যদিকে ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের এক অংশকে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, অন্য অংশ ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করার বাকি কাজটি গোপনে সম্পন্ন করে। জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে। ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় আরো কলঙ্কিত হয়। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একদিকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। প্রতিক্রিয়ার এমন বিশৃঙ্খল অবস্থাতে ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যেন জীবিত নেতৃত্বদের হাতে পড়তে না পারে সেই পরিকল্পনাই ঘটনাবহুল ৩ নভেম্বরের দিন ও রাত শেষে সম্পন্ন করে। জেলখানার অভ্যন্তরে খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে প্রবেশ করে কয়েকজন খুনি চক্র, যারা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চার জাতীয় নেতাকে জেলের অভ্যন্তরে বেয়োনেট চার্জের মাধ্যমে হত্যা করে। কেননা মোশতাক তখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট পদে তার আর থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং গদিচ্যুত হওয়ার আগে শেষ অপকর্মটি না সম্পাদন করে গেলে তাকে এবং ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের চরম মূল্য দিতে হতে পারে সেই বিবেচনা থেকেই নিষ্ঠুর জেল হত্যাকাণ্ড। ৩ নভেম্বরের প্রত্যুষে খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটেছিল সেটির অনিবার্যতা থাকলেও সংগঠকরা ছিলেন অপরিকল্পিত। তারা সেই সময়ের সেনানিবাসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমীকরণটি নিরূপণ না করেই বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলেন। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত না করে যে সময়ক্ষেপণটি করেছিলেন তার সুযোগটি নিয়েছিল ১৫ আগস্টের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা। তারা সম্মুখে নিয়ে এলেন এম এ জি ওসমানীকে- যিনি উভয়পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দৃশ্যমান হলেও তার পেছনে ১৫ আগস্টের মূল ষড়যন্ত্রকারীরা সবকটি সেনানিবাসকে খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে প্রস্তুত করার সুযোগ পেল। একইভাবে সেনানিবাস ও এর বাইরের রাজনৈতিক অঙ্গনের উগ্র হঠকারীদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হলো। প্রথম সালিশে ১৫ আগস্টের বেশিরভাগ হত্যাকারী ৩ নভেম্বর সকালেই ঢাকা ত্যাগ করার সুযোগ পেল। এরা নির্বিঘ্নে ব্যাংককে পাড়ি জমাতে সক্ষম হলো। অন্যদিকে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, পাকিস্তান ফেরত এবং অন্যদের দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দিয়ে গোটা সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে উত্তেজনা বিশৃঙ্খলা প্রতিশোধপরায়ণতা এবং উগ্র হঠকারিতায় গা ভাসিয়ে দেয়া হলো। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য খালেদ মোশারফদের ছিল না। কিন্তু নেপথ্যের শক্তি খালেদ মোশারফকে তখন আওয়ামী লীগের প্ররোচিত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাপক প্রচার দিতে থাকে। দেশের বাইরেও এই খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লুফে নেয়া হয়। বলা হতে থাকে জেলের অভ্যন্তরে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ খালেদ মোশারফকে দিয়ে খন্দকার মোশতাককে হটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রচারণাটি সেনানিবাসের বাইরে এবং দেশের বাইরে যারা প্রচার করছিল তারাই ছিল ১৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী সব ঘটনা নিয়ন্ত্রণকারী। এরা বেশ আগে থেকেই টের পেয়েছিল খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মিছিল বের করেছিল। সেই মিছিল থেকে পদযাত্রা করে ছাত্ররা ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সম্মুখে এসে ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার দাবি করেছিল, প্রতিশোধ নেয়ার শপথ গ্রহণ করেছিল। ২৬ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্বোধন করতে অস্বীকৃতি জানান। আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্টের পর কামান-বন্দুকের সম্মুখে দাঁড়াতে না পারলেও অচিরেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় যাচ্ছিল এটি ১৫ আগস্টের হত্যাকারীরা তীক্ষèভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল, সঙ্গে সঙ্গে তারা আত্মরক্ষামূলক বিকল্প পথগুলোও তৈরি করছিল। তাদের সঙ্গে তখন পাকিস্তানপন্থি, ভারতবিরোধী এবং উগ্র হঠকারী জাসদ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। কোনো ধরনের পরিবর্তন যাতে ঘটতে না পারে সে কারণে তারা ভারত বিরোধিতা, আওয়ামী বিরোধিতা, অপপ্রচার, গুজব ইত্যাদিকে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এর ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতে থাকে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও নানা বিভ্রান্তি, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ক্ষমতার দখলকে কাজে লাগানোর নানামুখী তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। জটিল এই বিষয়গুলো খালেদ মোশারফ এবং তার সহযাত্রীরা খুব একটা বিবেচনায় নেয়নি। তারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে শুধু খন্দকার মোশতাক এবং তার নিকটস্থ কয়েকজন জুনিয়র সৈনিকের বাড়াবাড়ি ও ক্ষমতা বেদখলের বিষয় হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু এর পেছনে যে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের আরো অনেক বিবদমান গোষ্ঠী এবং মতাদর্শগত হিংস্র প্রতিশোধপরায়ণ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি রয়েছে সেই জটিল বিভাজনের রেখাগুলো তারা দেখেননি। ২ নভেম্বর শেষ রাতে খালেদ মোশারফ অপরিকল্পিতভাবে যে অভ্যুত্থান অসমাপ্ত রেখে সময় অতিবাহিত করেছিলেন তার সব দেশপ্রেম মহৎ উদ্দেশ্য ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ কিংবা রাষ্ট্র ক্ষমতায় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির উত্থানকে মোটেও জায়গা করে দেয়নি। বরং সেই সময় তার প্রতিপক্ষরা এম এ জি ওসমানীকে সম্মুখে এনে সময়ক্ষেপণ করালেন। এই সুযোগে খন্দকার মোশতাক ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বড় অংশটিকে দেশ ছাড়ার সুযোগ করে দিল। অন্যদিকে ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে জেলখানায় তার চরম প্রতিপক্ষ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যা করার সময় করে দেয়া হলো। তিনি এবং তার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে ঘাতকদের প্রেরণ করে এই চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। উদ্দেশ্য একটাই ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যেন এদের হাতে না পড়ে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা গেলে বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেতৃত্ব খুঁজে পাবে না। খন্দকার মোশতাক ৩ নভেম্বর রাতে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন চার জাতীয় নেতাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যা ইয়াহিয়া পারেনি তা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর গভীর রাতে খন্দকার মোশতাক অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হলেন! অবশ্য তার পেছনে সামরিক বাহিনীর মূল ও সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে থাকা ষড়যন্ত্রকারীদের অবশিষ্ট অংশ এবং এর বাইরের নেপথ্যের শক্তি তাকে দিয়ে এমন মানবতাবিরোধী অপরাধটি করিয়ে নিয়েছিল। এরপর আর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতায় থাকা না থাকা মূল ষড়যন্ত্রকারী ও পরিকল্পনাকারীদের কাছে তেমন কিছুই ছিল না। মোশতাক কার্যত ৪ তারিখের পর ক্ষমতায় কিছু করার অবস্থানে ছিল না। তার বিদায় চার জাতীয় নেতার হত্যার মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের এমন নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা খুব কম জাতির জীবনে ঘটেছে। খন্দকার মোশতাক প্রায় ২৬ বছর যে সহকর্মীদের সঙ্গে রাজনীতি করলেন, যে বঙ্গবন্ধুকে তিনি নেতা বলে পরিচয় দিতেন তাদের সবাইকে তিনি হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েছিলেন। মাত্র ২ মাস ২০ দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে থাকার বিনিময় জাতির পিতাসহ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে যারা প্রাণ দিলেন তারা এবং জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতা, অসংখ্য নেতা কর্মকর্তা এবং পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা, নৈরাজ্য, হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের রাজনীতির উল্টোপথে হাঁটা ইত্যাদি ছাড়া আর কী অর্জিত হলো? ইতিহাসে পঁচাত্তরের এসব হত্যাকাণ্ড পটপরিবর্তন, রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন, রাজনীতির পশ্চাদ প্রসারণ সবই ঘটল খন্দকার মোশতাকের হাত দিয়ে। খন্দকার মোশতাক ইতিহাসে একজন নরঘাতকে শিরোমণি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকল। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App