×

সারাদেশ

অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য নোয়াখালী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৫১ এএম

অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য নোয়াখালী

প্রতীকী ছবি

অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশের উপক‚লীয় জেলা নোয়াখালী। ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ জেলায় ধর্ষণ, হত্যা, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এখন স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক ও পারিবারিক কারণে ঘটছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। জেলায় ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন যেন উৎসবে পরিণত হয়েছে। গত ৫ বছরে নোয়াখালীতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২৭৮টি। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩২০টি। ৭৯৯ জন নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিশু নির্যাতন ৪২টি। অপহরণ করে মুক্তিপণবন্দি ২৬টি। সন্ত্রাসী হামলাসহ নানাভাবে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে ৪৪ জন। ডাকাতি ৩১টি, দস্যুতা ২৩টি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, সন্ত্রাসী হামলাসহ ৮০টি ঘটনা ঘটেছে। চুরি ৪৪৩টি। ৫ বছরে ১৩ হাজার ৫৯৪টি মামলা হয়েছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও জেলার সার্বিক উন্নয়নে নতুন ৩টি উপজেলা গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। পুলিশ জানিয়েছে, গত বছর প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা করেছে। বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ৩২৫টিসহ বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। সিআর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৭ হাজার ২৪৫টি। জিআর মামলা নিষ্পত্তি করেছে ২০ হাজার ৬২টি। আর সাজা পরোয়ানা ২ হাজার ৯৮৫টি তামিল করেছে পুলিশ। প্রতিটি অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আসামিও গ্রেপ্তার করেছে। নোয়াখালীর চৌমুহনী এসএস কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সুশৃঙ্খল সমাজ উচ্ছৃঙ্খল সমাজে পরিণত হয়েছে। যে কারণে সমাজে কিশোরী ও কিশোররা তাদের অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণে না থেকে রাজনৈতিক ও ক্যাডারভিত্তিক বড় ভাইদের নিয়ন্ত্রণে চলছে। সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক সরকারের দলীয় নেতাদের সমীহ করে পুলিশ প্রশাসন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশের অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্যরা অপরাধীদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়। অনেক সময় বিচার প্রার্থীরা থানায় গিয়ে এসব কারণে সুবিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। আইনি সহায়তার পরিবর্তে পুলিশ উল্টো বিচার প্রার্থীদের হয়রানি করে। আর এসব কারণে বাড়ে অপরাধ। নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত বিএনপির আমলে নোয়াখালীতে অস্ত্র ও মাদকের কারবার শুরু হয়। সে সময় স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নোয়াখালীতে অস্ত্রের মজুত বাড়তে থাকে। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক ক্যাডার গ্রুপগুলো মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ার কারণে মাদকের কারবার শুরু হয়। বর্তমান সরকারের আমলে এসে অস্ত্র ও মাদকের পরিধি আরো বেড়েছে। নোয়াখালীতে অপরাধ বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হিসেবে জেলার সুশীল সমাজ দেখছে এখানকার উপজেলাগুলোর আয়তনকে। জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলা ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত, নদী থেকে নতুন নতুন চর জেগে আয়তন বেড়েছে সুবর্ণচর, হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার। এতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া উপজেলাগুলো বৃহৎ আয়তনের হওয়ায় এখানে উন্নয়নও ব্যাহত হচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন জানান, নোয়াখালীতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা অনেকটা কমে গেছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড পারিবারিক কারণে ঘটছে। এসব ঘটনায় পুলিশ ক্লু উদ্ঘাটন করে আসামিও গ্রেপ্তার করছে। সম্প্রতি ধর্ষণ বেড়ে গেলেও এর নেপথ্যের কারণ অধিকাংশ নারীর স্বামী বিদেশ থাকেন। একাকী থাকার কারণে অনেক নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া আকাশ সংস্কৃতির কারণে এখন মোবাইলে পর্নো ভিডিও বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে। এছাড়া পারিবারিক বিরোধের কারণে অনেক সময় মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ তুলে মামলা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ১০টি গণধর্ষণের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ৫টি মামলা ভুয়া বলে প্রমাণ পেয়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বেশি আলোচিত হয়েছে নোয়াখালী। প্রত্যেকটি ঘটনা পুলিশ মামলা নিয়েছে এবং ক্লু উদ্ঘাটন করে আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। ধর্ষণের বিষয়ে পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ঘটনার খোঁজ নিতে গিয়ে যেটা মনে হয়েছে, সামাজিক অবক্ষয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ধর্ষণের মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পতি হয় এবং আসামিদের দ্রæত সাজা হয় সেই লক্ষ্য নিয়ে পুলিশের টিমগুলো কাজ করছে। অপরাধী যত প্রভাবশালী হোক না কেন অপরাধ করলে কোনো ছাড় নেই। ধর্ষণ রোধে এবং ধর্ষণকে না বলুন, সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে এবং কয়েকটি উপজেলায় ধর্ষণ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনমূলক অনুষ্ঠানও করেছেন। পুলিশ জানায়, রাজনৈতিকভাবে পুলিশের কাছে কোনো হস্তক্ষেপ কেউ করতে পারছে না। কিশোর গাং গ্রুপসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। পারিবারিক সহিংসতা ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড : সম্প্রতি সুবর্ণচরে এক নারীকে হত্যার পর ৫ টুকরা করা হয়। পুলিশ চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে। প্রথমে এটিকে পেশাদার খুুনি কর্তৃক হত্যকাণ্ড মনে করা হলেও পুলিশের সেই ধারণা পাল্টে যায়। পরে দেখা যায় সৎছেলেই তার মাকে নৃশংসভাবে ভাড়াটে কসাই দিয়ে হত্যা করে ৫ টুকরা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। এর আগে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নোয়াখালীতে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে গ্যাং কালচার : নোয়াখালীর ৯ উপজেলায় ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড এমনকি পাড়া-মহল্লাভিত্তিক রয়েছে একাধিক গ্রুপ। কিশোর গাং, ক্যাডার বাহিনীরা নানা নামে পরিচিত। এসব গ্যাং গ্রুপ এলাকা ভাগ করে নিয়ে মাদক, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজির পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডেও অংশ নেয়। পারিবারিক সহিংসতায়ও ব্যবহার হয় ক্যাডার গ্রুপ। ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি ও গ্যাং কালচারের কারণেও নোয়াখালীতে নানা অপরাধ ঘটছে বলে অভিমত স্থানীয়দের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App