×

মুক্তচিন্তা

অন্যান্য কৃষিতে প্রণোদনা জরুরি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২০, ১০:৫৪ পিএম

অন্যান্য কৃষিতে প্রণোদনা জরুরি

কৃষি খাতে পর্যাপ্ত প্রণোদনা এবং যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে খাদ্য সহায়ক কৃষির সফল উৎপাদন আমাদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারত। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গর্ব করার সময় আমরা অন্তত কৃষি খাতে পর্যাপ্ত প্রণোদনাদানের কথাগুলো যদি ভাবি তবু আজ হোক কাল হোক সার্বিকভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব কিছু নয়। তাই পর্যাপ্ত প্রণোদনা নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার বিকল্প যে নেই, সে বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে।

লকডাউনে গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছি অনেক দিন। বেশ কয়েকটি মাস ঘরবন্দি জীবনের হতশ্বাস চারদিকের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। হতশ্বাসের সেসব ধ্বনি-প্রতিধ্বনি মানসিক জগতে এনেছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কোথাও কোথাও কিংবা কারো কারো জীবনের বিকারকে আরো তীব্র করে তুলেছে। আমাদের মন, মেজাজ ও মর্জি এক অস্বাভাবিক চলনে হয়েছে অভ্যস্ত। খিটখিটে হয়েছে আমাদের মেজাজ। করোনার আতঙ্কজনিত কারণে মনের ওপর সৃষ্ট ‘চাপ’ স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করেছে। ব্যাহত হয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাও। সার্বিকভাবে এক উন্মূল জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার আর কোনো বিকল্প আমাদের সম্মুখে খোলা ছিল না। ঘরের ভেতর বসে বসে এসবই ভেবেছি সারাক্ষণ, ভেবেছি করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী মানবিক জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সব অপচয়ের অবলেশ নিয়েও। আমাদের সব ভাবনাই যে আবার কেবল অপচয়ের অনুষঙ্গী ছিল তাও কিন্তু নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি সবক্ষেত্রেই আমাদের যে কেবলই হারাতে হয়েছে তাও নয়। আমাদের অর্থনীতির চাকা হয়তো বা যতটা দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি। তবু শেষ পর্যন্ত দেখেছি কোনোভাবেই আমাদের অর্থনীতি একেবারেই থমকে যায়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে সবল বেগে ঘুরেছে অর্থনীতির চাকা। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিশেষ করে মাথাপিছু জিডিপি সম্পর্কে যে আভাস দিয়েছে তা বিবেচনা করলেও আমরা এক ধরনের স্বস্তিই বোধ করি, করেছিও। আমাদের কৃষি অর্থনীতি এই করোনার মধ্যেও ধাবমান অশ্বের মতোই গতিশীল আছে। আসন্ন আমন ফসলের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে এ কথার সার বুঝেছি!

করোনাভীতি আমাদের বাইরে যেতে দেয়নি। করোনার ভয়ে আমরা ঘরের বাইরে বেরোতে পারিনি- সাহসও হয়নি। বাইরে যাইনি। জরুরি প্রয়োজন থাকলে ‘স্বাস্থ্যবিধি’ মেনে ক্বচিৎ ঘরের বাইরে হয়তো বা বেরিয়েছি তবু যথারীতি সেই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আবার গৃহবন্দি জীবনের অভ্যস্ততার সঙ্গে নিজেকে সমর্পণ করেছি। মানুষ এখন প্রায় সর্বস্তরে স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেহেতু স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা কঠিন তাই অনেক চিন্তাভাবনা করেই এখন পর্যন্ত দেশের সব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। আর্থিক বা অর্থ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই খোলা হয়েছে। সেখানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষিত না হলেও কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে অনেকটা প্রায় আগের মতোই। এসব দেখে-শুনে এবং বলা যেতে পারে ‘বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে’র অজুহাত দেখিয়ে দীর্ঘদিন পর এবার বাইরে বেরুলাম। স্বাস্থ্যবিধি বলতে প্রথমত এবং প্রধানত ‘মাস্ক’। মুখোশ পরেই রাজধানী থেকে জেলা শহর, তারপর জেলা শহর থেকে উপজেলা শহর পেরিয়ে পৌঁছলাম প্রত্যন্ত গ্রামেÑ যাকে বলে ‘অজ পাড়াগাঁয়’। রাজধানী থেকে অজ পাড়াগাঁ পর্যন্ত ‘আসা-যাওয়া পথের ধারে’র দুপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে স্বস্তি, আনন্দ ও ভরসায় মন ভরে উঠল। দেখলাম মাঠভরা ফসলের সমারোহ। আমন ধানের ফলন সর্বত্রই এবার অনেক ভালো। দুয়েক জায়গায় থেমে ও গাড়ি থেকে নেমে দুয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম এবার আমনের ফসল তাদের ভাষায় ‘অনেক ভালো’। অনেক জায়গায় আবার বৈচিত্র্যময় কৃষিরও উচ্চ ফলন দেখে মন ভরে গেল। এর মধ্যে আলু (শাকালু), কলা, ফুল চাষেও কৃষকরা মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। মনোযোগী হয়েছেন মৎস্য চাষেও। সব মিলিয়ে কৃষি অর্থনীতির এক মজবুত ভিতের সঙ্গে সরাসরি পরিচয় হলো।

শুধু কৃষিই নয়- যেন নবরূপে পরিচয় হলো প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গেও। করোনাকালে যেখানে মানবের অস্থির ও আতঙ্কগ্রস্ত জীবন তারই বিপরীতে বেড়ে উঠেছে উদার প্রকৃতি। মানুষের খড়গহস্ত থেকে প্রকৃতি অনেকগুলো দিন এক ধরনের নিষ্কৃতি পেয়েছে! তাই অনেকটা যেন আপন মনে আপন স্বভাবে প্রকৃতি বেড়ে উঠতে পেরেছে। তাই বিস্তৃত প্রকৃতিজুড়ে প্রাণের স্পন্দন, দিকে দিকে সবুজের ঘন সমারোহ! একদিকে অজ পাড়াগাঁ অপরদিকে সমৃদ্ধ প্রকৃতি! মানুষেরও নেই ঘন বসতি। স্বাস্থ্যবিধির যে মুখোশ (মাস্ক) পরে এসেছিলাম নিবিড় প্রকৃতির কোলে এসে তা যেন অর্থহীন হয়ে গেল! চারদিকে ঘন সবুজ, নির্মল বাতাস, ততধিক ঘন সবুজের মাঠভরা ফসল- সবুজ ধানের ক্ষেত। সুতরাং সন্দেহাতীত নির্মল বায়ুর পরশ। প্রাণ ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে ফুসফুসকে বরং শক্তিশালী ও সমর্থ করে তোলা সহজ হয়ে ওঠে এইখানে। তাই স্বাস্থ্যবিধির মাস্ক মুখ থেকে নেমে থুঁতনির নিচেই আটকে যায়! নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে নির্মল বাতাস। ফুল ও ফসলে প্রকৃতি যেন অনেকটাই মানবিক ও মানবীয় হয়ে উঠেছে! তার সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় আমাদের মন যেমন একদিকে ভরে উঠেছে তেমনি আরেক দিকে আমরা ব্যাপকভাবে আশান্বিতও হয়ে উঠতে পেরেছি। বিশেষ করে আশান্বিত হয়ে উঠেছি আমনের বাম্পার ফলনের সম্ভাব্য আভাসে। সামনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সবুজ ধানের সবল গাছে গাছে দীর্ঘ দীর্ঘ ধানের শীষ। এসব শীষের সমৃদ্ধি দেখে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার চিত্রপট মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। আর ভিন্ন এক প্রশান্তি এসে যেন কানে কানে বলে যায় আমাদের কৃষি অর্থনীতির সাফল্য আর খাদ্য নিরাপত্তার আশ্বাস ও ভরসার কথা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা করোনা দুর্যোগ মোকাবিলার যে দৃঢ় ঘোষণা ব্যক্ত করেছেন ফসলের পুষ্পিত মাঠ দেখে জননেত্রীর প্রতি কৃষকের সেই সমর্থনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় আপামর মেহনতি এই কৃষককুল জননেত্রীর ঘোষণাকে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে চলেছেন। তাই আমরা আসন্ন আমন মৌসুমে কৃষির বাম্পার ফলন প্রত্যাশা করছি। এই প্রত্যাশা পূরণের কারিগর সমগ্র দেশের কৃষকের প্রতি তাই আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি। শ্রদ্ধা নিবেদন করি আমাদের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার জন্য প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও তারা অবদান রেখে চলেছেন নিরন্তর। প্রসঙ্গত এখানে এ কথাও বলা প্রয়োজন যে, অন্যান্য শিল্পের মতো কৃষিক্ষেত্রে কৃষকের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনা নেই। আমাদের বিবেচনায় কৃষককে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষির জন্য প্রণোদনা প্রদান জরুরি। আমন ফসলের পরেই রবিশস্যের চাষাবাদের সময়। এ সময় কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা জরুরি বলে মনে করি।

আমরা ধানের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করতে পেরেছি। গর্ব করে বলেও থাকি যে, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। কিন্তু এই গর্বের মধ্যে এক ধরনের ফাঁক বা ফাঁকি উভয়ই আছে। সামগ্রিকভাবে ধান ছাড়া অপরাপর সব কৃষিপণ্য যেমন- পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল প্রভৃতি আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। এবং আমদানির সহজলভ্যতার নিরিখে এ দেশের বাজারও ওঠানামা করতে থাকে। তাই আমাদের বক্তব্য যথাযথ উদ্যোগ, উৎসাহ ও প্রণোদনা পেলে আমাদের দেশের কৃষকরাও এসব কৃষিপণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা দেখাতে পারে। এবং এটি জরুরিভিত্তিতে করা প্রয়োজন। একদা আমরা মাছ চাষে পিছিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মাছ চাষেও আমরা প্রায় আত্মনির্ভরশীলতার পথেই আছি। ফুল উৎপাদনেও প্রয়োজনের তুলনায় আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। সুতরাং দৃঢ়তার সঙ্গে এ কথা বিশ্বাস করি যে, আমাদের দেশের কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনতে পারলে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, আদা প্রভৃতি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশেষ অবদান রাখতে পারবে। এ বিষয়ে আর অবহেলার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। করোনাকালে কৃষি খাতই শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। প্রমাণিত হয়েছে কৃষিই আমাদের আশা ও ভরসার জায়গা। তবু প্রণোদনা প্রদানের ক্ষেত্রে কৃষককুলকে আমরা পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানে হয় কার্পণ্য করি, না হয় অবহেলা করি। যার কারণে প্রতি বছর বাজার হয়ে ওঠে অকল্পনীয় অস্থিতিশীল। বিশেষত মসলা জাতীয় কৃষিপণ্যের বাজার আমাদের জীবনযাপনে নাভিশ্বাস সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিককালের পেঁয়াজ ও আলুর বাজার আমাদের হিমশিম খাইয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কৃষি খাতে পর্যাপ্ত প্রণোদনা এবং যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে খাদ্য সহায়ক কৃষির সফল উৎপাদন আমাদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারত। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গর্ব করার সময় আমরা অন্তত কৃষি খাতে পর্যাপ্ত প্রণোদনাদানের কথাগুলো যদি ভাবি তবু আজ হোক কাল হোক সার্বিকভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অসম্ভব কিছু নয়। তাই পর্যাপ্ত প্রণোদনা নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার বিকল্প যে নেই, সে বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App