×

মুক্তচিন্তা

স্বজনতোষণ দুর্জনের কাজ, ভিসির নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১০:৪৮ পিএম

স্বজনকে তো ভালোবাসতেই হবে। সেই ভালোবাসাটা নিজের বাড়িতে কিংবা স্বজনের বাড়িতে হলেই ভালো। নিজের কর্মক্ষেত্রে কখনো নয়। কর্মক্ষেত্রে ভালোবাসা দেখাতে গেলেই কেলেঙ্কারির সিরিয়াল শুরু হয়ে যায়। তখন স্বজন প্রেমিক দুর্জনের পরিচিতি লাভ করেন। হালে পত্রিকার খবর অনুযায়ী একজন ভাইস চ্যান্সেলর তুলনামূলকভাবে কমযোগ্য তার কন্যা ও জামাতাকে নিজেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি করতে গিয়ে দুর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন এবং দুর্জন পরিচিতি নিয়েই হয়তো বাকি দিনগুলো কাটাতে হবে। তার যে কন্যা ও জামাতা তুলনামূলকভাবে কম যোগ্য হয়ে স্বজনের অনুকম্পা গ্রহণ করলেন বা করবেন বাকি জীবন অধিকতর যোগ্যদের সামনে তাদের মাথা নিচু করেই থাকতে হবে, যদি তাদের বিবেকবোধ থেকে থাকে তারা অপরাধীও বোধ করবেন। অপরাধমূলক কাজটি সরাসরি করে থাকবেন নিয়োগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বোর্ড-সদস্য শিক্ষকমণ্ডলী পুরো ব্যাপারটাতেই এক ধরনের গিভ এন্ড টেইক ঘটে থাকবে। নতুবা বিনাস্বার্থে তারাই বা অপরাধমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে যাবেন কেন? টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে ভাইস চ্যান্সেলর না আবার দুর্জনের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়ায় সে ভাবনা করতে হচ্ছে। যারা ভালো ভাইস চ্যান্সেলর, যারা দুর্নীতিতে নেই, টাকা-পয়সার ভাগবাটোরায় নেই, ছাত্রীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেই, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতা, পুত্রবধূ, ভাস্তে-ভাগ্নে, ভাস্তি-ভাগ্নি এবং বিশেষ সম্পর্কের অন্য কোনো নারীকে আইনের অনুশাসন ভঙ্গ করে চাকরি দেননি, যারা তাদের ছাত্রনেতাদের কথায় উঠবস করেননি তারাই এখন সবচেয়ে বেশি বিব্রত। বদনামের ছিটেফোঁটা তাদের ওপরও এসে পড়ছে। আরো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার কথা ইতোপূর্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি সাহেবের পুত্র-কন্যা বা অন্য কোনো আত্মীয় হিসেবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছেন তারা কেউ সন্দেহের বাইরে নেই। বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীও থাকতে পারেন তারা কি পারতেন না মেধাগুণে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে বাবাকে বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচাতে? স্বজনপ্রীতি অনেক জায়গাতেই হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন হবে না এ যুক্তি, কুযুক্তি। জাতির শিক্ষাগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তুলনামূলকভাবে কম যোগ্য লোকের শাসনে চলে যায় তাহলে জাতিকেই খেসারত দিতে হবে। স্বজনপ্রীতি নেপোটিজমকে আত্মীয়স্বজনের প্রতি অনাত্মীয়দের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ। রাজনীতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, যে কোনো ধরনের লাভজনক কাজের প্রতিযোগিতায় আত্মীয়ের প্রতি পক্ষপাতই অপরাধমূলক স্বজনপ্রীতি। অপরাধমূলক কারণ তাকে আইন ভঙ্গ করে, শপথ ভঙ্গ করে স্বজনতোষণ করতে হয়। তোমার চাচা তো বব মামা-চাচার জোরের কথা আমরা বলে থাকি। বাবার জোরটা সেভাবে চালু হয়নি কারণ বাবারা তখন পর্যন্ত ততটা বেহায়া হননি, এখন যেমন। যেটুকু করতেন ভাই ও শ্যালকের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিতেন। একালের ক্ষমতাধর বাবা ও মা বেহায়া। ব্রিটেনেও মামা-চাচার জোরের কথা বলা হয়, একটু ভিন্নভাবে ‘বব ইজ ইয়োর আঙ্কল’। রবার্ট আর্থার ট্যালবট গ্যাসকোয়েনসিসিল, স্যালিসব্যারির তৃতীয় মার্কুইস ১৮৮৫ থেকে ১৯০২-এর মধ্যে তিনবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৪ বছর শাসন করেছেন। তিনি ১৮৮৭ সালে তার ভাইপো আর্থার ব্যালফোরকে আয়ারল্যান্ডের চিফ সেক্রেটারি নিয়োগ করেন। মনে করা হয় তিনি তখন এ পদের যোগ্য ছিলেন না। অনেকে প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তে অবাকও হন। তখনই বিভিন্ন মুখ ঘুরতে ঘুরতে এ কথাটি চালু হয়ে যায় অযোগ্য হলেও সমস্যা কি ‘বব ইজ ইয়োর আঙ্কল’। রবার্টকে সংক্ষেপে বব ডাকা হয়। কিন্তু চেয়ারে বসে আর্থার ব্যালফোর যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি রক্ষণশীল দলের সভাপতিও হন এবং চাচার পদত্যাগের পর ১৯০২ সালে তিনিই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন। চাচা তাকে চলার পথে অনেকটা এগিয়ে দিলেও তিনি যে অযোগ্য ছিলেন না, তা প্রমাণ করেছেন। ব্যালফোর যদিও নিজেকে যথেষ্ট যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন ‘বব ইজ ইয়োর আঙ্কল’- ইংরেজি ভাষা তাকে স্মরণ রেখেছে এভাবেই। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস একই কথা বলে প্রেসিডেন্টের সন্তানকে প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর সন্তানকে প্রধানমন্ত্রী। উভয় ক্ষেত্রেই সন্তানরা যত অযোগ্যই হোন না কেন সমস্যা নেই। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্ব বলে এক সময় যে দেশগুলোকে চিহ্নিত করা হতো সে দেশগুলো পরিচালিত হয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে। পদ্ধতিই সরকারপ্রধানকে একনায়ক বানিয়ে দেয়। সেই একনায়কের সন্তানকে একনায়ক যেখানে বসাতে চান সেখানে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিটিই প্রতিবাদ না কারণ তাতে আম ও ছালা দুটো যাওয়ার সম্ভাব নাই, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ বহু বছর ধরে এই চক্রেই খাবি খাচ্ছে। স্বজনপ্রীতির পাপ সবার আগে স্পর্শ করেছে ধর্মীয় গুরুজনদের। ধর্মগুরুদের শাসন ডিঙ্গিয়েই রাজনৈতিক সরকারের অভ্যুত্থান ঘটেছে। বব তোমার চাচার মতো ‘পোপের ভাস্তে’ কথাটিও বহুল প্রচলিত। সপ্তদশ শতকের শেষে পোপরা নিজস্ব যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করে নিষ্কাম থাকার শপথ যখন গ্রহণ করলেন তাদের আর সন্তানের বাবা হওয়ার আনুষ্ঠানিক যোগ্যতা থাকল না। কিন্তু চার্চ প্রধানদের যৌন কেলেঙ্কারির শেষ নেই। নেই হুজুরদের কারো কারো। কাজেই সন্তানের পিতা না হতে পেরে নজর দেন ভাস্তের ওপর। তুলনামূলকভাবে কম যোগ্য ভাস্তেদের নিজের প্রভাব খাটিয়ে ধর্মগুরু উঁচু পদে বসিয়ে দেন। কারো বঞ্চিত হওয়ার যাতনা তখন সম্ভবত তাদের স্পর্শ করে না। পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস তার দুই ভাস্তেকে কার্ডিনাল পদে বসিয়ে দেন। পোপ হওয়ার পথে এটি অন্যতম প্রধান মাইলস্টোন। এই মাইলস্টোন স্পর্শ করে তার এক ভাস্তে রড্রিগোই পরবর্তীকালে হলেন পোপ ষষ্ঠ আলেক্সান্ডার। আরো কোত‚হলোদ্দীপক কাহিনী রয়েছে। পোপ ষষ্ঠ আলেক্সান্ডার তার রক্ষিতার ভাই আলেসান্দ্রো ফার্নেসকে কার্ডিনালের পথে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি তৃতীয় পোপ পল হিসেবে পরিচিত হন। আরো ভয়ঙ্কর কাজ করেছেন তৃতীয় পোপ পল তিনি ১৪ ও ১৬ বছর বয়স্ক তার দুই ভাস্তেকে কার্ডিনাল পদে বসালেন। সর্বোচ্চ ধর্মীয় অবস্থানে থেকে পোপ এ ধরনের অনাচারে জড়াবেন এটা পোপ দ্বাদশ ইননোসেন্ট মেনে নিতে পারলেন না। তিনি ‘রোমানাম ডিসেট পন্টিফিসেম’ জারি করলেন। একে বলে ‘প্যাপাল বুল’ বা পোপদের চার্টার, তাতে তিনি ‘কার্ডিনাল-ভাস্তে’ পূর্ববর্তী পোপদের সৃষ্ট এই পদটি অবলুপ্ত করলেন। তার আগের ১৯ জন পোপ ভাস্তে নিয়োগের কাজটি করেছেন এবং একজন রক্ষিতাপ্রসূত নিজ পুত্রকেই ‘কার্ডিনাল নেফিউ’ বানান। পোপ দ্বাদশ ইননোসেন্ট ১৬৯২ সালে পোপের দান করার ক্ষমতা, নিয়োগ করার ক্ষমতা অনেকটাই ছেঁটে দিলেন। বরং পোপের ভাস্তের জন্য ১২০০০ (ইতালির উপক‚লীয় রাজ্যের মুদ্রা) একটি বৃত্তি নির্ধারণ করলেন। পোপ দ্বাদশ ইননোসেন্টের ক্ষমতা সীমিতকরণসহ ভাস্তেপ্রীতি বর্জনের হুকুম ১৯১৭ সালের ‘কোড অব ক্যানন ল’তে অন্তর্ভুক্ত হয়। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের অপকর্ম (যারা সততার সঙ্গে কাজ করছেন, তাদের বিচলিত হওয়ার কারণ নেই, তারা শ্রদ্ধেয়, তবে তাদের বের করতে আণুবীক্ষণিক গবেষণা প্রয়োজন হবে) ঠেকাতে এ ধরনের হুকুম জারি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে যে ভাইস চ্যান্সেলরের কার্যকালে তার এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কিত কাউকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিয়ন থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত কোনো পদেই চাকরি দিতে পারবেন না। পুত্রবধূ এবং কন্যার জামাতাও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে পোপ দ্বাদশ ইননোসেন্টের ফরমান অনুযায়ী ভাইস চ্যান্সেলরকে একটি ভাস্তে ভাতা দেয়া যেতে পারে, যা সর্বোচ্চ ছাত্রবেতনের একজনের সমপরিমাণ হবে। ভিসি সাহেব এটাই তার ভাস্তেকে (পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, জামাতা, ভাগ্নে-ভাগ্নি, ভাস্তি, শ্যালিকা, শ্যালক যে কাউকে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন) দেবেন অথবা নিজেও ভাস্তেহীনতার ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেখে দিতে পারেন। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম ক্ষতি হবে। এককালে অভিযোগ উত্থাপিত হলেই আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন ভাইস চ্যান্সেলর, অধ্যক্ষ প্রমুখ পদত্যাগ করে নিজের সম্মান রক্ষা করতেন; একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক (এ কালে তার সমমান ও মর্যাদার একজন ভাইস চ্যান্সেলরও যদি খুঁজে পাওয়া যায় ভাগ্য) অভিযোগ উঠতেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। যাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে আমরা এখনো পুরনো ঢেঁকুর তুলি তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ছিলেন। গ্রেসফুল ভাইস চ্যান্সেলর! রবার্ট মুগাবের (জিম্বাবের সদ্য প্রয়াত প্রেসিডেন্ট) স্ত্রী গ্রেস মুগাবে তার নামটিকে আরো ‘গ্রেসফুল’ করতে নামের সঙ্গে ডক্টর ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। আর তাকে পিএইচডি নিতে আরো বেশি উৎসাহী এবং উদ্যোগী হয়ে উঠেন ইউনিভার্সিটি অব জিম্বাবের ভাইস চ্যান্সেলর লেডি নিয়াগুরা। গণিতের শিক্ষক লেডি নিয়াগুরা ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হন এবং একের পর এক এই পদে পুনর্নিয়োগ হতে থাকে। প্রতিটি নবায়নে তার অপকর্ম বহুগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১৪ সালে জানা গেল প্রেসিডেন্টের স্ত্রী (প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য উত্তরসূরী) ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য জিম্বাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিবন্ধিত হয়েছেন। তিন মাসের মধ্যে তিনি তার থিসিস চেঞ্জিং সোশ্যাল স্ট্রাকচার এন্ড ফাংশন এব দ্য ফ্যামিলি জমা দিলেন, থিসিস ডিফেন্ড করলেন এবং ডক্টর গ্রেস মুগাবে হয়ে গেলেন। এ কাজে তার এক নম্বর একম্প্লিস (দুষ্কর্মের সহযোগী) লেডি নিয়াগুরা গ্রেসের কাছ থেকে কী প্রতিদান গ্রহণ করছেন তিনিই ভালো জানেন। তবে মুগাবের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে হাতকড়া পরিয়ে টেনে-হিঁচড়ে কারাগারে ঢুকানো হয়।আমাদের ভাইস চ্যান্সেলরদের কারো যেন এমন দুর্ভাগ্য না হয়। ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App