×

জাতীয়

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে ১৭ বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৪৬ এএম

দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে ১৭ বছর

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী

২২ বছরেও বিচার শেষ হয়নি চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীদের প্রভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেই ১৭ বছর ধরে স্থগিত আছে এ মামলার কার্যক্রম। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের তদারকি না থাকায় ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরও মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, নিষ্পতি না হওয়া মামলাগুলোর সুরাহার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৫৬১ ধারায় স্থগিত থাকা মামলা জটিলতা নিরসনে হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ কাজ শুরু করেছেন। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারাধীন আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিষয়টি নজরে আনলে জটিলতা নিরসনে উদ্যোগ নেয়া হবে।

মামলা সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এডভোকেট সৈয়দ শামছুল হক বাদল ভোরের কাগজকে বলেন, উচ্চ আদালতের মাধ্যমে আসামিরা মামলাটি ঝুলিয়ে রেখেছেন। চার্জ গঠনের পর এক আসামির পক্ষে হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এজন্য মামলার কার্যক্রম স্থগিত ১৬ বছর ধরে। তিনি বলেন, এতদিন একটি মামলা স্থগিত থাকলে পরে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলেও মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে অসুবিধা হয়। কারণ সাক্ষী মারা যেতে পারে, আলামত নষ্ট হতে পারে এবং সাক্ষীদের ঠিকানায় নাও পাওয়া যেতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হওয়া প্রয়োজন। মামলা নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানী ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলিতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার দিনই নিহতের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে শুধু আদনান সিদ্দিকীকে আসামি করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী আদনান সিদ্দিকীসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেনÑ ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, ফারুক আব্বাসী, আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। আসামিদের মধ্যে ইমন কারাগারে এবং বোতল চৌধুরী পলাতক ও আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ সাত আসামি জামিনে রয়েছেন।

২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। এরপর মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৩ সালে ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। কিন্তু আসামিদের মধ্যে একজন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দাখিল করেন। ওই রিট আবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এম এ মতিন ও সৈয়দ রিফাত আহমদের বেঞ্চ ২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রথমে তিন মাসের জন্য নিম্ন আদালতে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন। পরে ২০০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রিটের রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন। গত ১৬ বছরে ওই রুলের নিষ্পত্তি না হওয়ায় নিম্ন আদালতে বিচারকাজও শুরু হয়নি। মামলাটির নথি ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ফাইলবন্দি রয়েছে।

৯০ দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম নায়ক সোহেল চৌধুরী ও দিতি জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় করতে গিয়ে একে অন্যকে ভালোবাসেন। একপর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘনিষ্ঠরা জানান, স্ত্রী দিতির অবহেলা আর চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সোহেল চৌধুরী। তিনি জড়িয়ে পড়েন নেশার জগতে। একপর্যায়ে ক্লাবপাড়া তার ঠিকানায় পরিণত হয়। সেখানে অপরাধ জগতের গডফাদারদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলায় বান্টি ইসলাম ও বোতল চৌধুরীর মালিকানাধীন ট্রাম্পস ক্লাবের মধ্যে এক বান্ধবী নিয়ে সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের তর্ক হয়। উত্তেজিত সোহেল চৌধুরী আজিজ ভাইকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এরপর আসামিরা সোহেলকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

ঘটনার দিন রাত ৯টায় সোহেল চৌধুরী বনানীর বাসা থেকে বের হন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন শহীদ, আবুল কালাম আজাদ, হেলাল ও হাফিজ নামে চার বন্ধু। বাসা থেকে বের হয়ে তারা একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খান। এরপর রাত ২টার দিকে সোহেল চৌধুরী বন্ধুদের নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিছুক্ষণ পর তারা ট্রাম্পস ক্লাবে যেতে থাকেন। ক্লাবের নিচতলার কলাপসিবল গেটের কাছে দুই যুবক তাদের গতিরোধ করে। এক যুবক আবুল কালামের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক আব্বাস ও আদনান সিদ্দিকী সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। সোহেল চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বনানী ১৭ নম্বর সড়কের ওই সময়ে বাসিন্দারা জানান, সোহেল চৌধুরী ৩৫ বছর বয়সে খুন হন। ঘটনার সময় সোহেল চৌধুরীর বন্ধুং আবুল কালাম আজাদ (৩৫) এবং ট্রাম্পস ক্লাবের কর্মচারী নিরব (২৫) ও দাইয়ান (৩৫) গুলিতে আহত হন। গুলির ঘটনার পরপরই জনতা আদনান সিদ্দিকী নামের একজনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে। অন্যরা পালিয়ে যায়। ট্রাম্পস ক্লাবে থাকা ২০০ জনের মতো নারী-পুরুষ পালিয়ে যায়। ওই দিন পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবের ১১ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।

সোহেল চৌধুরীর বাবা তারেক আহমেদ চৌধুরী তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। সোহেল চৌধুরী মা-বাবার সঙ্গে বনানীর বাসায় থাকতেন। তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী অন্যত্র থাকতেন। তৌহিদ থানায় হত্যা মামলা করেন। মৃত্যুর প্রায় ২২ বছর পরও স্বজনরা সোহেল চৌধুরী হত্যার বিচার পায়নি।

সোহেল-দিতি দম্পতির দুই সন্তান বিদেশে থাকেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ মারা যান চিত্রনায়িকা দিতি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মামলার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতেন। বর্তমানে পরিবারের কেউ মামলার খোঁজ রাখেন না। এ অবস্থায় আলোচিত ওই হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App