×

বিশেষ সংখ্যা

যমুনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৩৯ পিএম

যমুনা

তনিয়া গডফ্রে সেদিন একটি অদ্ভুত অনুরোধ করেছিল আমার কাছে। অনুরোধটি ছিল আমি যেন তাকে একটি বাঙালি নাম দেই। নাইজেরিয়ান একটি মেয়ে আমার কাছে বাঙালি নাম চাচ্ছে, অদ্ভুত না? ইবিজা নামক একটি শহরের সমুদ্র সৈকতে বসেছিলাম দুজন। সন্ধ্যা নামার আগে ও এই আবদার করলো। আমি তাকিয়ে রইলাম এই কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েটির মায়াময় মুখের দিকে। আমার এই মুহূর্তে যমুনা নদীর কথা মনে পড়ে যায়। যমুনার কালো জল, সূর্যাস্তে যমুনার রূপ আর ইবিজার সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্তের সময় এই মেয়েটির রূপ ঠিক যেন একই। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে সুদূর নাইজেরিয়ান একটি মেয়ে আর বাংলাদেশের একটি মেয়ে একসাথে একটি বিচে বসে জীবনের শূন্যতাগুলোকে ভাসিয়ে দেবে সমুদ্রে? অথচ এটা হবার ছিল না। আমি ফিসফিসিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যমুনা!’ তনিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার দিগন্তে চোখ রাখলো। আনমনে বললো, ‘হোয়াট অ্যা বিউটিফুল নেইম! যামনাহ্! এটার অর্থ কি?’ মৃদু হাসলাম। আমার মনে পড়ে গেল যে কোনো এক অতীতে আমিও স্রোতের মতো যমুনার তীরে আছড়ে পড়েছিলাম। প্রকাণ্ড আকাশের নিচে নদীর এই বিশালতা আমার কল্পজগতকেও হার মানিয়েছিল। নদীর দিকে তাকিয়ে সেদিন বিড়বিড় করে আমিও বলেছিলাম, ‘এত সুন্দর একটি নদীর পানি কালো কেন?’ নিরুপম হেসে উঠেছিল। বললো, ‘জানো, এই যমুনারই একটি প্রান্তে একটি তাজমহল আছে। সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য বানিয়েছিলেন। বলতে পারো এই যমুনা প্রেমের ইতিহাস, ভালোবাসার আরেক রূপ।’ -‘ভালোবাসার আরেক রূপ কি কালো? এই জলের মতো?’ নিরুপম কিছু বললো না। তাকিয়ে রইলো সূর্যাস্তের দিকে। তীরের কাছে একজন বাউলও বসে ছিলেন। নাম না জানা সেই বাউল গেয়ে উঠলেন, ‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো, চান করিতে লাগে ভালো, যৌবন মিশিয়া গেল জলে।’ আমাদের যৌবনের শুরুর প্রান্তেই আমরা একে অপরকে পেয়েছিলাম। আমাদের জীবন সুন্দর ছিল, আমরা যতটা পারি রঙিন তুলিতে সাজিয়েছিলাম। আমি আরো একজনকে চিনতাম এই যমুনা নদীর মাধ্যমে। নিরুপমের মা ছিলেন এই যমুনারই মেয়ে। কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম, এই যমুনার তীরেই তার ঘর ছিল কোনো এক কালে। আগ্রাসী নদী তার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও তিনি নদীপ্রেম ভোলেননি। জীবনের অনেক গল্প শুনেছি তার কাছ থেকে। এই প্রৌঢ় বয়সেও তার চোখের কালোতে আমি যমুনার কালো জল দেখতে পাই। আমারও গুনগুনিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে বাউলের মতো, ‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো, চান করিতে লাগে ভালো, যৌবন মিশিয়া গেলো জলে।’

দুই. ইবিজাতে আজকে সকালটা শুরু হয়েছে সুন্দরভাবে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখা হলো পাশের ফ্ল্যাটে থাকা অ্যালিসিয়ার সাথে। একাই থাকেন তিনি। হাত নেড়ে একগাল হেসে সৌজন্য জানিয়ে চলে গেলেন বৃদ্ধা। হেঁটে বেড়াবেন পার্কে। দরজা খুলতেই দরজার সামনে একটি চিরকুট। চিরকুটটি খুলতেই দেখলাম সেখানে লেখা, ‘ডিয়ার সিস্টার, আগামী রবিবার ইগলেসিয়া দে সান্ত চার্চে আমার বিশেষ দিনে তোমাকে দেখতে চাই। আমার কেউ বলতে এই একাকী শহরে ম্যাথিউর পর তুমিই আছো। প্লিজ এসো। ভালোবাসা অনেক।’ ইতি, তনিয়া।

বি. দ্র. তোমরা বাংলায় যামনাহ্ বানান কিভাবে লিখো একটু শেখাবে আমাকে? আই লাভ দিস নেইম।

ইবিজা সমুদ্র সৈকতে সেদিন তাকে আর যমুনার অর্থ জানানো হয়নি। মাত্র এক ঝলকেই যে যমুনার প্রেমে পড়েছিলাম, কল্পনায় তাজমহল দেখতে পেয়েছিলাম সেটা আমি তনিয়া নামক একজন নাইজেরিয়ান মেয়েকে সুদূর শহরের একটি বিচে বোঝাতে পারতাম না। কোথায় যেন পড়েছিলাম, নদী হচ্ছে প্রেমিকার মতো। প্রেমিকাকে হয়তো বোঝা যায়, কিন্তু প্রেম বোঝানো যায় না। অদেখা রহস্য হয়েই থাকুক আমার স্বল্প পরিচিত যমুনা।

তিন. সাদা রঙের সাথে কালো রঙ যায় না, এটা ভুল প্রমাণ করতে তনিয়াই যথেষ্ট ছিল সেই সানডে তে। হাতে সাদা ফুলের তোড়া, সাদা গাউন পরে রেড আইলে দাঁড়িয়ে ছিল সে। মনে মনে তিনবার বললাম, ‘ডিয়ার মোনালিসা, স্যরি ট্যু সে বাট দিস লেডি জাস্ট প্রæভড দ্যাট ইউ আর নাথিং ইনফ্রন্ট অব হার।’ ভাউজগুলো পড়ার সময় তনিয়ার চোখ ভিজে ভিজে উঠছিল। কালো গভীর চোখ। দ্য মিস্ট্রিয়াস যামনাহ্। বিয়ে সম্পন্ন হবার পর তনিয়া টিস্যুতে চোখ চেপে কাঁদতে লাগলো। অদ্ভুত এক অনুভ‚তি। আমার মনে পরে, যেদিন নিরুকে আমার পাশে এনে বসানো হয় বিয়ে পড়ানোর পর, আমি এভাবেই কাঁদছিলাম। মাঝে একবার কান্না ভুলে মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। নিরুও আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। এখন আবারও সূর্যাস্ত। তনিয়ার ভেজা চোখ, হাসি হাসি মায়াময় মুখ অপূর্ব লাগছে। চার্চে থাকা যিশুও কি আজ একবার আজন্মের ক্লান্তি ভুলে মুখ তুলে চাইবে এই মেয়েটির দিকে? শুধু একটিবার?

চার. নিরুপমের চলে যাওয়ার আজ এক বছর পূর্ণ হলো। গৌতম বুদ্ধ এক মাঘী পূর্ণিমারাতে ঘর ছেড়ে বিবাগী হয়েছিলেন। নিরুপম হারিয়ে গেছে হঠাৎ করেই। এজন্যেই অপেক্ষা শব্দটা মধুর লাগে আজকাল। স্পেনের একটি ছোট্ট শহরে হারিয়ে যাওয়া মানুষরা নাকি সহজে ফেরে না। কিন্তু যারা ফিরতে জানে, তারা নাকি হারায় না। নিরুপম ফিরতে জানে। সে বারবার পথ খুঁজে একটা সময় আমাকে খুঁজে নিয়েছে। আমি জানি সে ফিরবে। আমাদের যৌবন হয়তো জলে মিশে যাবে ততদিনে, কালো চোখ বাদামি হয়ে আসবে। তবু ফিরবে। এখানে না ফিরুক, যমুনাতে ফিরবে। নেক্সট উইকেন্ডে আমার ফ্লাইট। তনিয়া আর ম্যাথিউ আমার ফ্ল্যাটে এসেছে বিকেলের দিকে। তনিয়া বললো, ‘তোমাকে কি যেতেই হবে? কেন ফিরে যেতে চাচ্ছো অপরিপূর্ণ জীবনটিতে? তুমি কি পারবে এই শহরকে ভুলে থাকতে?’ কিছু বললাম না। ব্যাগ গোছানোতে মন দিলাম। ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দিয়েছি কিছুদিন হলো। এক সপ্তাহ এক্সট্রা সময় নিয়েছি থাকার, দেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। ফ্ল্যাটের মালিকও না করেননি। যাওয়ার আগে চাবিটা তনিয়ার হাতে বুঝিয়ে দিলেই হবে। কেন ফিরছি আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি, ফেরাটা জরুরি। বড্ড জরুরি। এয়ারপোর্টে সি অফ করতে এসেছিল তারা দুজনই। গোলাপের তোড়াটা আমার হাতে দিয়ে তনিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অস্ফুট স্বরে বললো, ‘আই উইল নেভার ফরগেট ইউ। তোমাকে ভুলবো না কখনই।’ প্লেনে উঠতেই নজর গেলো ফুলের তোড়ার গায়ে কার্ডটির দিকে। সেখানে লেখা ছিল, ‘তুমি না বললেও আমি এখন যমুনা লিখতে জানি। আমি গুগল করে এটাও জেনেছি এই নদীর আরেক অর্থ প্রেম। ধন্যবাদ আমাকে এত সুন্দর একটি নাম দেয়ার জন্য। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যমুনা নামক নদীটি তোমার জীবনে প্রেম হয়ে ফিরুক। ইতি, যমুনা।’

পাঁচ. যমুনার নদীর তীরে বসে আছে দুজন। নিরুপমের মা এবং বাবা। বয়স যেন তাদের সংখ্যা কমিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে এই দুজনকে বহুকাল দূরে। নিরুপমের আর্তি কি মিশে আছে এই ঢেউয়ে? কেন বারবার আছড়ে পড়ে তীরে তাহলে? আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে। নিরুপমের বাবা বললেন, ‘লাভলী, আজকে রাতে রুটি খাবো আমি। ওজন কমাতে হবে, বুঝেছো।’ নিরুপমের মা মুখ টিপে হাসলেন। স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। আমি জানি, তিনি এই নদীর তীর থেকে ভাসিয়ে নেয়া তার ঘরটির দুঃখ ভুলে গেছেন। ঘর তো তার এই হাতের মুঠোতেই, ঘর কি আর চারদেয়ালে থাকে? মুগ্ধ চোখে দেখছি এই দুজনের বন্ধন। কে বলে যৌবন মিশে যায় জলে? নিরুপম আজ ফিরে এসেছে এই দুজনের মধ্য দিয়েই। রাত গড়াচ্ছে একটু একটু করে। তারা ফুটেছে আকাশে অসংখ্য। এই পূর্ণিমারাতে আজ আমার কোনো দুঃখ নেই। শুনতে পাচ্ছো যমুনা? আমার আর কোনো পাওনা নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App