×

বিশেষ সংখ্যা

মঙ্গল ও সম্প্রীতির দুর্গোৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৮:২৬ পিএম

মঙ্গল ও সম্প্রীতির দুর্গোৎসব

সৌমিত্র শেখর

আবহমান বাংলা ছিল মঙ্গলময় ও সম্প্রীতিপূর্ণ। এখানে মানুষের মতান্তর ছিল কিন্তু মনান্তর ছিল না। একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হলে সেখানেও বীজমন্ত্র ছিল মঙ্গলাকাক্সক্ষা ও সম্প্রীতি। কারণ যে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের রক্ত যেমন ছিল, তেমনি ছিল জেলে-তাঁতি-অধ্যাপক-ব্যবসায়ী-রিকশাচালক প্রমুখ পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের রক্ত। তাই সম্প্রীতি আর মঙ্গলাকাক্সক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্র। তবে, কালের খরস্রোতে এই শুভ আকাক্সক্ষা ও সম্প্রীতিভাবনায় চিড় ধরেছে। একে বিনির্মাণ করা জাতীয় স্বার্থেই অতীব প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে শারদীয় দুর্গোৎসব বিশেষ আহ্বান নিয়ে আসে; এবারও এসেছে। সারা বিশ্বেও আজ মঙ্গল ও সম্প্রীতির বড় অভাব। অথচ, এই মঙ্গল ও সম্প্রীতির বীজ ছিল আমাদেরই এই শ্রীভ‚মিতে, আমাদেরই সংস্কৃতিতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সঙ্গীত, যা আজ সংস্কৃতিমান প্রায় সবারই প্রার্থনাসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে, তা হলো : ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’। এই সঙ্গীতের মধ্যেই কিন্তু মঙ্গলময়তার কথা আছে, সম্প্রীতির কথাও আছে। এই মঙ্গল ও সম্প্রীতি শুধু মানবের নয়, জগতের সকল সৃষ্টির। অমিততেজী সত্যসুন্দরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমীহ থাকলে এ বিশ্বজগৎ থেকে আনন্দধারা বইবে, চন্দ্র-সূর্য মোহনীয় হয়ে উঠবে, ঝরনা-সাগর জলরাশি দিয়ে পরিশুদ্ধ করবে। দুর্গাপূজা আমাদের সেই অমিয়-আদর্শে দীক্ষিত করে, নিজেকে বিনয়ী হতে শিক্ষা দেয়।

এই পূজাকে শুধু ধর্মানুষ্ঠানে সীমিত না করে একে যদি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তাহলে এর সর্বজনীনতা বৃদ্ধি পায় নিশ্চয়। নিশ্চয়ই, ‘ধর্ম’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আমরা সবাই জানি- ‘যা ধারণ করে’ বা ‘জীবকুল যে অভিজ্ঞানে স্নাত হয়ে শান্তির মোহনায় এসে পৌঁছান’। কিন্তু সত্যি কি তাই, প্রচলিত ধর্ম মানুষকে ধারণ করতে পারছে অথবা তাদের মনে সৃষ্টি করতে পারছে শান্তির ঝরনাধারা? ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক স্টিফেন হকিংস বলেছেন, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই, স্বর্গ-নরকের ধারণা অলীকমাত্র, মানুষের মস্তিষ্ক পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হলে মৃত্যু গ্রাস করে তাকে। তিনি মৃত্যু নিয়ে আতঙ্কিত বা চিন্তিত না হয়ে জীবনভোগের দিকে মনোযোগ দিতে পরামর্শ দিয়েছেন সবাইকে।

হকিংসের এই কথা নতুন নয়- তিনি তার মতো করে বলেছেন মাত্র। হকিংসের এই কথাকে সদর্থকভাবে বিবেচনা করলে বলতে হয়, আমাদের কবি-সাহিত্যিকগণও তো প্রায় একই কথা বলেছেন। স্বর্গ-নরকের চিন্তা না করে পরার্থে জীবন উৎসর্গের জন্য একজন কবি কাব্য লিখেছেন : ‘কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর? / মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক- মানুষেতে সুরাসুর।’ তাহলে স্বর্গ-নরকের চেয়ে এ পৃথিবীর প্রতি দায়বোধটাই তো মুখ্য হলো! অন্যদিকে যারা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন বা যারা মনে করেন, মৃত্যু-উত্তরকালে অন্য এক জীবন আছে, তারাও কিন্তু ইহজগতকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করেন না। প্রচলিত প্রত্যেক ধর্মেই ইহজগতকে শান্তিপূর্ণ রাখার কথা আছে- আছে মানবপ্রেমের কথা। ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’- কথাটা এভাবে চণ্ডীদাস বলেছেন বটে, কিন্তু এ কথাই প্রচলিত সব ধর্মের বক্তব্য। মানুষকে সর্বাগ্রে স্থাপনের কথা ধর্মে আছে ঠিকই, তারপরও ধর্মের নামে হানাহানি চলছে জগৎজুড়ে। দুর্গাপূজা সেই মঙ্গল ও সম্প্রীতির বাণী নিয়ে আসে।

দুর্গা সুসংবদ্ধতার পূজা, পরিবারকে স্মরণ ও রক্ষার পূজা। বাঙালির বিচ্ছিন্নতা চিরন্তন- বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। তাদের সব কিছু একক! তাদের উপাসনার দেবতা আলাদা, মন্দির আলাদা, গুরুদেব আলাদা, একজনে ছুঁলে অন্যজনকে স্নান করতে হয় ইত্যাদি। এই আলাদা-তত্তে¡র মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের কথা বলা হলেও আসলে এতে বিচ্ছিন্নতা এসে বাসা বাঁধে। আর এই বিচ্ছিন্নতার বলি হয় সমগ্র জাতি ও ধর্মসমাজ। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবের পর তারই একান্ত আগ্রহে একত্র-প্রার্থনা ও সংকীর্তনের আয়োজন হয় বাঙালি সমাজে। এতে বৈষ্ণবকুলে একত্র-প্রার্থনা রীতি ধীরে ধীরে চালু হয়। প্রার্থনা শেষে ঘরে ফেরার সময় মানুষ পরস্পরের খোঁজখবর নেন আর এতে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ে আরো।

বাঙালির এর আগের ইতিহাস, পরস্পর বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। যে সময় থেকে বাঙালি সমাজে দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে, এই পূজার পৌরাণিক ও সামাজিক উভয় ব্যাখ্যাই মঙ্গল ও সমাজজীবনে সম্প্রীতির কথা বলে। রাজা সুরথকেন্দ্রিক উপাখ্যান, মধুকৈটভের কাহিনী, মহিষাসুরের কাহিনী, শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনী, কৃত্তিবাসী ‘রামায়ণে’র উপাখ্যান- সব কিছুতেই দুর্গাপূজার কোনো না কোনো পৌরাণিক সূত্র পাওয়া যায়। তবে সবসূত্রেই নারীশক্তির আরাধনার মাধ্যমে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের শক্তিকে সমীহ করার যে প্রত্যয় ব্যক্ত হয় তা দুর্গাপূজার একটি বিশেষ দিক। কবে থেকে বাঙালিসমাজে দুর্গাপূজার ঐতিহাসিক পত্তন হয় তা নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেলেও, একটি মত বলছে- ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির যেহেতু মূলত একটি দুর্গা মন্দির এবং খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী অর্থাৎ ১১০০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে বাংলার সেন বংশের কোনো এক রাজা, এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি দুর্গা সদৃশ মূর্তি খুঁজে পান, তারপর তারা সেখানেই একটি মন্দির বানিয়ে সেই মূর্তি স্থাপন করেন এবং খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, দেবীর এই মূর্তির নাম ‘ঢাকেশ্বরী’। তারপর থেকেই দুর্গাপূজার প্রচলন।

সেই ঢাকেশ্বরীর নাম অনুযায়ীই এই মন্দিরের নাম হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং পরবর্তীকালে এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃৃত হতে শুরু করে একটি নগর বা জনপদ, আস্তে আস্তে যার নাম হয় ঢাকা। ঢাকেশ্বরী শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে যে ‘ঢাকা যুক্ত ঈশ্বরী’ পাওয়া যায়, সেই ঈশ্বরীই হলেন দুর্গা। এর আগেও দুর্গাপূজা হয়ে থাকলে সে পূজা মানুষের দৃষ্টিতে ব্যাপকভাবে পড়েনি। ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলার দেওয়ান হন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের সামন রাজা কংস নারায়ণ। তিনি মনোবাঞ্ছা করেন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের। এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে দুর্গাপূজা করেন তিনি এবং তার প্রভাবেই পরে হিন্দু রাজা ও জমিদারেরা এই পূজার প্রসার ঘটান। এরপর দুর্গা পূজার প্রচলন হয় বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, মণিপুর ও ত্রিপুরায়। ভারতের আর কিছু রাজ্যে দুর্গাপূজা নবরাত্র হিসেবে উদযাপিত হতে দেখা যায়।

এছাড়াও মূলত প্রবাসী বাঙালি হিন্দুরা বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে দুর্গাপূজা করে থাকেন। এখন এর রূপ হয়েছে বারোয়ারি। কিন্তু সূচনাতে রাজা ও জমিদার বাড়িতে পূজা হলেও, এই পূজার একটি বড় বৈশিষ্ট্য তখন থেকেই ছিল আর তা হলো, এই পূজা উপলক্ষেই সাধারণ মানুষ রাজা ও জমিদার বাড়ির কাছাকাছি আসার সুযোগ পেতো। তাছাড়া প্রসাদ পাবার ব্যাপারটি ছিল দরিদ্র জনসাধারণের জন্য একটি বড় আগ্রহের বিষয়। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে অর্ধ সপ্তাহব্যাপী সাধারণ মানুষ রাজা বা জমিদারবাড়ির চারপাশে উৎসবের আমেজে বিচরণ করতো। এতে সমাজ থেকে রাজা-প্রজার ভয় ও দূরত্ব কমে আসতে থাকে। আজ সমাজে রাজা-প্রজার ধারণাটি যে নেই, এই ধারণাবিনাশের সূচনা করেছিল এই দুর্গাপূজা। তাই বাংলায় সামাজিক সাম্যের সূচনাতে দুর্গাপূজার বড় ভ‚মিকার কথা স্বীকার করতে হয়।

শরৎকালের দুর্গাপূজায় দীর্ঘ ছুটি থাকায় হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষ শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসতেন। এটিও একটি সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। এতে পারস্পরিক যোগাযোগ আরো বাড়ে। ইংরেজ আমলের শেষ দিকে সামাজিক অবস্থার নিম্নাগমের ফলে রাজত্ব তো থাকেই না, জমিদারিত্বও বিলোপ হয়। তখন থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজার আয়োজন চলে। ‘বারোয়ারি’ শব্দটি ‘বার ইয়ারি’ শব্দদ্বয় থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। ‘বার’ অর্থ দ্বাদশ কিন্তু এখানে বহু আর ‘ইয়ারি’ অর্থ বন্ধুর। অর্থাৎ বহু বন্ধুজনের মিলনে যা করা হয় তাই ‘বারোয়ারি’। দুর্গাপূজাও অবশেষে বারোয়ারিতে স্থান পায়। এই বারোয়ারি পূজাতে রাজা বা জমিদারের তুলনায় অনেক বেশি মানুষের সম্পৃক্ততা ঘটে, আর এতে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ়তর হয়। এখানে দেখা যায়, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও আয়োজক ব্যক্তি হিসেবে অংশ নিচ্ছেন।

পূজার আনুষ্ঠানিকতাটুকু ছাড়া যে কোনো ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণে সর্বজনীন হয়ে ওঠে এই আয়োজন: দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে দুর্গা উৎসব। তাই, দুর্গা শুধু পূজামাত্র নয়, দুর্গা উৎসব এবং তা সর্বজনীন দুর্গোৎসব। পৃথিবীর এমন দৃষ্টান্ত খুব কমই পাওয়া যাবে, প্রায় এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত একটি সম্প্রদায়গত পূজা সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে মঙ্গলময়তার বাণী ছড়িয়ে সর্বজনীন সম্প্রীতির উৎসবে পরিণত হতে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App