×

বিশেষ সংখ্যা

বড় একা লাগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৭:১৯ পিএম

বড় একা লাগে

ভোরের দিকে হঠাৎ জোরে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল নিখিলেশের। আর তখনই সেই স্বপ্নটা আবারো দেখলেন নিখিলেশ। এক অচেনা তরুণীর হাত ধরে ছোট্ট নদীর তীর ছুঁয়ে ছুটতে ছুটতে সামনের অফুরন্ত সাগরের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছেন অবাধে। মাঝখানে আর কোনো ঘটনা নেই। আর অন্য কোনো বাক্যালাপ নেই। আর কোনো দৃশ্যপাটও নেই। শুধুই সংক্ষিপ্ত সময়ের এক টুকরো ছোট্ট ঘটনা ছাড়া। তবে তিনবার স্বপ্নটা দেখার পরে তরুণীর মুখখানা চেনা হয়ে গিয়েছিল। পরিচিতজনের ভিড়ে কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। নিজেকেও দেখেছিলেন নিখিলেশ। মোটেই ষাট পেরুনো বৃদ্ধ নন। রীতিমতো ঝকঝকে। প্রাণবন্ত এক সতেজ তরুণ।

মানুষ জীবনে বারবার একই স্বপ্ন দেখে নাকি কখনো? দ্বিতীয়বার স্বপ্ন দেখেই প্রশ্ন জেগেছিল মনে। আর তখনই বিশেষজ্ঞদের কথাও তার মনে পড়েছিল। স্বপ্ন বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষ একই স্বপ্ন বারবার তখনই দেখে, যখন জীবনে স্বপ্নের বিষয়টা অপূর্ণ থেকে যায়। মেডিকেল সায়েন্সের ব্যাখ্যায়, স্বপ্ন হচ্ছে এমন সব গল্পের ভাবমূর্তি, যা ঘুমের মধ্যে মানুষর মন অবাধে সৃষ্টি করে। কিন্তু এতকিছু ব্যাখ্যার পরও মনোবিজ্ঞানের ডাক্তারদের জবাব হলো- মন এমন কাজ কেন করে, তার উত্তর তাদের জানা নেই। কথাটা মনে হতেই নিখিলেশ উঠে বসেছিলেন বিছানায়। ভারি বিরক্ত হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন- এই বয়সে দাঁড়িয়ে মনের এমন সৃষ্টিকর্মের মানে হয় কোনো? নাকি স্বপ্ন বিশেষজ্ঞদের এমন ব্যাখ্যারই কিছু মানে আছে ছাই!

কিন্তু আজ তৃতীয়বার স্বপ্ন দেখে বিরক্তির বদলে এক অচেনা ভালোলাগার পরশ তিনি অনুভব করলেন বুকের অতল তলে। উঠে গিয়ে জানালা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া ছুটে এসে তাকে ছুঁয়ে দিলো। চোখে পড়লো, রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে সব রকম গাড়ি ছুটছে। নানা বয়সের মানুষ ছুটছে। চিৎকার করে হকার ছুটছে। ফুলওয়ালা, ফলওয়ালা সবাই ছুটছে জীবনের স্বপ্ন পূরণের প্রয়োজনে। দেখতে দেখতে তারও ভারি ইচ্ছে হলো, সদ্য দেখা স্বপ্নের মায়াজালে নিজের আপাদমস্তক জড়িয়ে অন্য সবার সঙ্গে ছুটতে ছুটতে সবার মতোই কেবল জীবনের প্রয়োজনের ভেতর হারিয়ে যান। আর সে রকম মনে হতেই প্রথম কিংবা দ্বিতীয়বার যেমন অর্থহীন ভেবে স্বপ্নটাকে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন, সেটা আজ আর সম্ভব হলো না। শিক্ষিত মানুষ নিখিলেশ, বিষয়টাকে মনের ভিত্তিহীন সৃষ্টি জেনেও স্বপ্নটার জন্য কেমন এক মমত্ব অনুভব করলেন।

নিখিলেশ জীবনে কখনো প্রেমে পড়েননি। কোনো তরুণীর সঙ্গে গোপনে নিভৃত আলাপন জমেনি তার। সংসারধর্ম পালন করে ছেলেপুলে নিয়ে সুখী হবার তীব্র সাধও কোনোদিন সেভাবে ছিল না। পিতৃমাতৃহীন জীবনে মামা-মামীর কাছে দায়সারাগোছের ভাবে তিনি বড় হয়েছিলেন। কেননা, তাদের নিজেদেরও চারটি পুত্রকন্যা ছিল। তারপরও দুতিনটি কন্যার অনুসন্ধান তারা নিখিলেশের জন্য এনেছিলেন। অবশ্য জোরাজুরি করে বিয়ে দেয়ার গরজ তাদের ছিল না। বিয়ের কথা উত্থাপন করে মামী বরং বলেছিলেন- দেখো বাপু, বলছি বলেই যে তোমায় বিয়ে করতে হবে সে রকমটা ভেবো না। তোমার ইচ্ছে হলে করবে, না হলে করবে না। জগতে চিরকুমারের অভাব নেই। এসব ব্যক্তিগত বিষয় তাই জোর করে কারুর ওপর চাপিয়ে দেয়া চলে না! দেয়া উচিতই নয়! কারণ তার ফল কখনো ভালো হয় না! এতখানি বয়সে সেসব দৃষ্টান্ত ঢের দেখেছি বলেই কথাটা বলছি! মামা ফস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন কী রে? আমরা আর এগুবো, নাকি এখানেই থাকবে তাহলে? নিখিলেশ একেবারে কিছু না ভেবেই বলেছিলেন আপাতত থাক মামা। মাত্র তো চার পাঁচ বছর হলো চাকরিতে ঢুকেছি। সেই ভালো। মামা নিশ্চিন্ত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন।

এরপর মামার ছেলেমেয়েরা একে একে সংসার জীবনে প্রবেশের পর তাদের জনক-জননীকে অনায়াসে নিখলেশের কাঁধে ছেড়ে দিয়ে বহু দূরে-দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। তারা দুচার বছরে ছুটিছাটায় পৈতৃক বাড়িতে দুচার দিনের জন্য দর্শন দিয়ে ভালোবাসা আর কর্তব্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যেতো। নিখিলেশের মামা-মামী তাতেই সব সন্তানদের ধন্য ধন্য করতেন। এর বহু বছর পরে, মামা-মামীর পরপর গত হওয়ার সংবাদে সব ভাইবোনেরাই একসঙ্গে এসে জুটেছিল। আর এসেই সবকিছু বিক্রিবাটার ব্যবস্থা করে নিখিলেশকে বলেছিল- এবার নিজের জন্য একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে নে নিখিলেশ। পুরনো বাড়িতে টাকা খরচা করে আর কী লাভ? বরং নতুন একখানা বাড়ি দেখে...। হ্যাঁ, সে তো করতেই হবে! নিখিলেশ শোকের জ্বালা সরিয়ে সংক্ষেপে বলেছিলেন। তাহলে আর দেরি করিসনে। বাড়ি বিক্রির জন্য অদ্দূর থেকে বারবার তো আর আমাদের পক্ষে ছুটে আসা সম্ভব হবে না, তাই...। সেটা এত তাড়াতাড়ি কী করে হবে? কিছুদিন সময় তো লাগবেই! টাকাকড়ির জোগাড় করতে হবে তো! সে কী রে? কুড়ি বছরের ওপর হলো চাকরি করছিস, আর টাকাকড়ি কিছু নেই বলছিস? কিছু নেই, তাতো বলিনি বড়দা! সংসারে যথেষ্ট খরচা ছিল, বাড়ি কিনতে গেলে...! তাহলে আপাতত একখানা ভাড়াটে বাড়িতেই না হয় উঠে যা ভাই। আমাদের পক্ষে একসঙ্গে বারবার সময় করে এখানে আসা আদপেই সম্ভব নয়! সবদিক ভেবে তাই বলছি ...!

সংসারে মোটা দাগের স্বার্থপর চেহারাটা মামা-মামী অনেক আগেই তার সমানে প্রকট করে দিয়েছিলেন। এবার সন্তানরা তাকে ভয়াবহরূপে বিকীর্ণ করে দিলো। নিখিলেশ ছেলেবেলাকার পুরনো আশ্রয় ছেড়ে দগ্ধ হৃদয় নিয়ে একটি কম ভাড়ার বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ব্যাংক ব্যালান্স, নিজের একটা ছোট্ট বাড়ি এই ঘটনার তিন-চার বছর পরেই অবশ্য জুটে গিয়েছিল তার জীবনে। কিন্তু সংসার জীবনে প্রবেশের সুযোগ কোনোদিন আর আসেনি। পঞ্চাশ উত্তীর্ণ বয়সে কে আসবে তাকে সহযোগিতা দিতে? তার নতুন বাড়িতে বন্ধুবান্ধবেরা সপরিবারে এসেছেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য থেকেছেন। নিখিলেশ তাদের নির্বিঘ্ন চিত্তে আতিথেয়তা দিয়েছেন। তাদের সুখদুঃখের কথা শুনেছেন। সবার সঙ্গসুধা পেয়ে নিজে সন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু শত সন্তুষ্টির পরেও কেউ কখনো বলেননি- অনেক তো হলো, এবার তুই একটি বিয়ে কর নিখিলেশ!

তারপর হঠাৎ একদিন কী হলো তার কে জানে। নিখিলেশ সত্যি বড় নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন জীবনে। বছর দুই আগে চাকরি থেকে অবসরের পর সেই ফাঁকটা ক্রমে বড় হতে হতে এবার গ্রাস করেছে তাকে। জীবনের সমস্তটা জুড়ে যে বিশাল একখানা ফাঁক সৃষ্টি হয়েছিল দিনে দিনে, এর আগে এমন করে কখনোই তা অনুভব করেননি নিখিলেশ। এখন মাঝে মাঝে বুকের ভেতর বেদনাভরা উতলা বাতাসের পরশ পান। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঝরে পড়ে। কিন্তু তারপরও এখন জানালা থেকে ফিরে এসে একলা ঘরে একা বসে তার আরো একবার মনে হলো- নিঃসঙ্গতা যেমনই থাক, তাই বলে এমন স্বপ্ন কেউ দেখে নাকি এই বয়সে দাঁড়িয়ে? শোভা পায়? আমি তো এর জন্য সত্যিই কখনো কাঙাল হইনি জীবনে! তাহলে মন কেন করবে, এমন কাঙালপনার কাজ?

নিঃসঙ্গ একঘেঁয়ে জীবন এতদিন যেমন করে কাটছিল তেমনি করেই এরপরে অনেকগুলো দিন কেটে গেলো তার। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, সেই দুর্বোধ্য স্বপ্নটা অনুরাগ সত্তে¡ও এরপরে আর কোনোদিনও দেখেননি নিখিলেশ। অবাধ্য মন কাজহীন অলস মুহূর্তে কতবার নাড়াচাড়া করে দেখেছে তাকে। কতবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে তার গূঢ় অর্থের তাৎপর্যটুকু। কিন্তু সেই অচেনা তরুণীর হাত ধরে তরুণ নিখিলেশ নদীর তীর ছুঁয়ে ছুটতে ছুটতে সাগরের অন্তহীন শূন্যতায় আর কক্ষনো অবাধে উড়ে যেতে পারেননি। অথচ নিখিলশের জীবনে এইটুকুই তো প্রেম ছিল। এইটুকুই তো ছিল তার পার্থিব জীবনের রোমাঞ্চকর মুহূর্ত।

আজ সারাদিন বড় অসহ্য গরম ছিল। হঠাৎ কোথা থেকে সন্ধ্যার পরে একটি নীরব বাতাস, মৃদু নিঃশ্বাসের মতো ধীরে ধীরে বইতে শুরু করে শীতল করে তুললো চারপাশ। স্বস্তি পেয়ে বারান্দার কোণের দিককার চেয়ারে এসে বসলেন নিখিলেশ। স্বপ্নের কথাটা আবারো মনে পড়লো। বড় খেদের সঙ্গে মন বললো- কী অর্থহীন জীবনই না কেটে গেলো এতকাল! একটি আস্ত মানবজীবন কত নিষ্ফলভাবেই না চলে গেলো!

এরপর জীবনের এত বছর পরে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটি অবিশ্বাস্য কাজ তিনি অজান্তেই করে বসলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকারে বসে থেকে জেগে জেগেই স্বপ্নটাকে নতুন করে দেখতে আরম্ভ করলেন নিখিলেশ। তরুণীর হাত ধরে তরুণ নিখিলেশ ছুটতে ছুটতে ভেসে গেলেন এক ক‚লহীন সাগরের অন্তহীন পরপারে। নীরবে তার দুচোখ বেয়ে গড়াতে লাগলো উদ্বেল অশ্রুর উষ্ণধারা। অস্ফুটে তরুণীর কানে কানে বললেন- আজ থেকে আমরা দুজনে রোজ এভাবেই ভেসে যাবো পথহীন পথ ধরে! তুমি থাকবে তো আমার পাশে? আসবে তো রোজ? নইলে যে বড় অর্থহীন মনে হবে এই নিঃসঙ্গ জীবনটাকে! যে নিঃসঙ্গতায় আজকাল বড় বেশি একা লাগে!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App