×

বিশেষ সংখ্যা

তরঙ্গ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৭:০১ পিএম

তরঙ্গ

মধুরীমার মনটা খুব বিক্ষিপ্ত জানালায় দাঁড়িয়ে দূরের আকাশটা দেখছে। মেঘগুলো ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের গায়ে। মধুরীমাও এমনি করে একদিন মিশে যেতে চাইছিল অনিমেষে হৃদয়ে। আজ গুনে গুনে ২৪৮ দিন হলো অনিমেষের সাথে কথা নেই দেখা নেই। অনিমেষ হারিয়ে গেছে ইচ্ছে করে মধুরীমার জীবন থেকে। কিন্তু মধুরীমা ভুলেনি। অনিমেষকে মুছে দিতে পারছে না হৃদয় থেকে জীবন থেকে স্মৃতি থেকে। স্মৃতির সাথে নিজের টানাপড়েন। কিছু অনুভূতি মানুষকে বুঝানো যায় না। একদম নিজস্ব থাকে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। মন থেকে যতই তুমি তাড়িয়ে দিতে চাও না কেন কীভাবে যেন মনের আদিগন্ত জুড়ে শিকড়বাকড় গেড়ে বসে থাকে। তার থেকে তোমার নিষ্কৃতি নেই। যতই তুমি তোমাকে ব্যস্ত রাখার বাহানা করনা কেন? সব রকমের নীতিবাক্য, মনকে বুঝানো সব কিছু জেনেও মানুষ কেন জানি এই দুর্বোধ্য ভালোবাসার মায়াজালে আটকে থাকে বের হতে পারে না কিছুতেই। মধুরীমার ও হয়েছে এই অবস্থা। কিছুতেই অনিমেষের ছায়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছে না। যতদিন গড়াচ্ছে অনিমেষ যেন তার ভিতর পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে আছে। দূর থেকে মধুরীমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অজানা এক সম্মোহনে। কিন্তু মধুরীমা ভালো করেই জানে অনিমেষ আর ফিরবে না। এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। অনিমেষের মতো ছেলেরাই মধুরীমার মতো আরো অনেকের হৃদয়ে নোঙ্গর ভিড়াবে। আবার হয়ত কেউ ভালোবেসে সর্বস্বান্ত হবে। দেউলিয়া হবে, রাতের ঘুম উড়ে যাবে। দিনের শান্তি নষ্ট হবে। নির্ভেজাল ভালোবাসা এমনি। যখন কেউ কাউকে ভালোবাসে তার ভিতর বাইরে সব তছনছ হয়ে যায়। তোলপাড় হতে থাকে সারাক্ষণ আকাশের মতো করে ভিতরটাও বারবার বদলাতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে।

মধুরীমার সাথে অনিমেষের পরিচয় অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই। ব্যাংকক থেকে ঢাকা আসার পথে প্লেনের ভিতর বাংকারে যখন মধুরীমা হ্যান্ড লাগেজটা কিছুতেই ঠিকঠাক মতো করে রাখতে পারছিল না তখন অনিমেষ আগ বাড়িয়ে বলল দিন আমাকে দিন আমি রেখে দিচ্ছি। অদ্ভুতভাবে পাশাপাশি সিট। মধুরীমা একটু চুপচাপ ধরনের কথা বলে কম। অনিমেষই আগ বাড়িয়ে কথা বলছিল। মধুরীমা শুধু হো হ্যাঁ করছিল। দু’একবার কথা বলার সময় চোখাচোখি হয়েছিলো। মধুরীমা লক্ষ করেছে অনিমেষের চোখগুলো সমুদ্রের মতোই গভীর। কথা বলতে বলতে মধুরীমার আদ্যোপান্ত অনিমেষ মুখস্ত করে নিলো সাথে ফোন নম্বরটাও। সেই সময় মধুরীমা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। এই দেখাই মধুরীমার জীবনে কাল হয়ে দেখা দিবে। বুঝবেই বা কীভাবে অনিমেষ কম করে হলেও মধুরীমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট হবে। মধুরীমা স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী। অনিমেষ যে ধূমকেতুর মতো করে মধুরীমার জীবনে ঢুকে পড়বে মধুরীমা স্বপ্নেও ভাবেনি। কোনো কোনো সময়ে মানুষ যা ভাবে না তাই হয়। ছকে আঁকার মতো করে জীবন চলে না। হঠাৎ করে ছক থেকে বেরিয়ে পড়তে হয় নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। মধুরীমাও বের হয়ে এলো তার এত বছরের নীতি বোধ থেকে। অনিমেষের দর্বার আকর্ষণে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না ঠিকঠাকমতো করে। মধুরীমার ভিতরেও ঝড় বয়ে গেল। উথালপাথাল সময় কাটলো কয়েকটা বছর ঘোরের ভিতর দিয়ে।

অনিমেষের সাথে দেখা হওয়ার পর মধুরীমা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল অনিমেষকে। হঠাৎ একদিন একটা ফোন কল এলো। আননোন নম্বরটা দেখে মধুরীমা প্রথম রিসিভ করতে চায়নি। কিন্তু কি ভেবে যেন রিসিভ করে ফেলল। ও প্রান্ত থেকে ফোন, কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই আমি অনিমেষ চিনতে পারছেন? সেই যে ব্যাংকক থেকে ফেরার পথে- মধুরীমার চিনতে আর বাকি রইল না। মধুরীমা প্রবল উচ্ছ্বাসে বলে উঠলো কেমন আছো? ফোন না করলে ভুলেই যেতাম। অপর প্রান্ত থেকে আমি কিন্তু প্রতিদিনই একবার করে মনে করি নিয়ম করে। মধুরীমা হেসে ফেলল অনিমেষের কথা শুনে। অনিমেষের কথার ধরনই এমন। মনে হয় যেন কতকালের চেনা। হর হর করে সব বলে যাবে। হুট করেই আবার রেখে দিল একটা ফোন আসছে বলে। আর রাখার আগে বললো নম্বরটা সেভ করবেন। মধুরীমা কি মনে করে ‘দুরন্ত’ নামে সেভ করল অনিমেষের নামটা। সেই থেকেই অনিমেষ যখন তখনই ফোন করে কথা বলতো কিন্তু মধুরীমা ততটা নয়। রিসিভ করতেই ভালোবাসে মধুরীমা। এমনকি কথা বলতেও মোটেই বিরক্ত হচ্ছে না অনিমেষের এই পাগলামীতে মধুরীমা কেন জানি প্রচ্ছন্ন একটা সায় দিয়ে যাচ্ছে। তার এই একঘেয়েমি জীবনে কোথায় যেন আলোর ঝলকানি, কোথায় যেন জ্বলে উঠল স্ফুলিঙ্গ। এই যে যখন তখন কেউ তাকে ফোন করে, ম্যাসেজ পাঠায় তাকে মিস করে সব মিলিয়ে মধুরীমা কোথাও যেন ভেসে যাচ্ছে এক অনাবিল ভালোবাসার স্রোতে। এই অপ্রয়োজনীয় মধুরীমা কারো জীবনে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এই ভাবনা তাকে আলোড়িত করে। মনের ভিতর এক ধরনের সুখ অনুভব করে। বয়সে তার চেয়ে কত ছোট একটা ছেলে তাকে মধু বলে ডাকছে। নির্দ্বিধায় সব কিছু বলে যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়ের মতো তাকে শাসন করছে। মধুরীমারও নিজেকে মনে হচ্ছে আঠারোর মতো কিশোরী। অনিমেষের সামনে মধুরীমা কেমন জানি নিজের অজান্তে বালিকা হয়ে যায়। বয়স কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না দুজনের সামনে। মধুরীমা ভুলে যায় তার অতীত আর ভবিষ্যৎ বর্তমানে স্থির হয়ে থাকতে চায়। এ কেমন ভালোলাগা? সব নিষেধে প্রাচীর ডিংগিয়ে যেতে চায় লাফিয়ে লাফিয়ে। মধুরীমা ভাসতে থাকে অবাধ্য স্রোতে। অনিমেষ যখন মধুরীমার বাসায় আসে প্রবল এক ঝড়ের মতো করে। কীভাবে যেন মধুরীমার স্বামী আর মেয়ের মনটাও জয় করে নিয়েছে। মধুরীমার স্বামী শান্তনু অনিমেষ সপ্তাখানিক না আসলে বলে কি তোমার ফ্যান ‘দুরন্ত’ কি ডুব দিয়েছে? বাঁধন ও বলে ‘দুরন্ত’ মামাটা আসছে না কেন? মধুরীমার মোবাইলে দুরন্ত নামে সেভ করা নামটা সবাই জেনে গেছে। এই নিয়ে কেউ কিছু মনেও করেনি। কারন অনিমেষের স্বভাবের সাথে দুরন্ত নামটা বেশ যায়। অনিমেষের এন্ট্রি এই বাসায় যখন তখন। শান্তনু বাসায় থাকলে দাবা খেলতে বসে যায়। দাবা খেলায় দুজনেরই বেশ ঝোঁক। দাবা খেলার সময় অনিমেষ একদম অন্যমানুষ খুব ভেবে চিন্তে চাল দেয়। শান্তনু অনিমেষের সাথে কখনোই দাবা খেলায় জয়ী হতে পারেনি। এই নিয়ে একটা চাপা জেদ আছে। শান্তুনুর ভেতর। কোনো একদিন হারিয়ে দিবে অনিমেষকে... কিন্তু সেই কোনো দিনটি কবে হবে মধুরীমা জানে না।

অনিমেষের চোখ দুটি মধুরীমাকে খুব টানে। সেই প্রথম থেকেই। চোখের দিকে তাকালেই মনে হতো সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। কিন্তু অনিমেষকে কখনো বলা হয়নি। অনিমেষ কবিতা ভালোবাসে, প্রচুর কবিতা তার মুখস্ত। মাঝে মাঝে যে কবিতাটা আওড়ায় সঙ্খঘোষের..... মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক একই রকম থাকবে সারাজীবন। মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে মাঝে মাঝে উড়াল দিবে মন। তারপর হেসে মধুরীমাকে বলবে ঠিক না? মধুরীমা বলে না ঠিক না। মাঝে মাঝে উড়াল দিবে মন। কথাটা শুনলেই মধুরীমার মন খারাপ হয়ে যায়। এক অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে উঠে। অনিমেষও কি তাহলে উড়াল দিবে? অনিমেষের সাথে মধুরীমার সময়গুলো খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। কোথা দিয়ে মধুরীমা তা বুঝতেই পারেনি। অনিমেষ তাকে অষ্ট প্রহর এমন ব্যস্ত করে রাখতো সেই কয়েকটা দিন, নির্জনতা বা নিঃসঙ্গতা শব্দটি প্রায় ভুলতে বসেছিল মধুরীমা কিন্তু এখন বুঝতে পারছে নিঃসঙ্গতা তাকে কীভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে। মধুরীমার রুদ্রের কয়েকটা কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে গেল।

চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয় চলে যাওয়া মানেই নয়- বন্ধন ছিন্ন করা আদ্র রজনী চলে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে। অনিমেষের সাথে মধুরীমার সর্ম্পকটা ছিল অলিখিত প্রেম। হৃদয়ের টান। শারীরিক নয়। শরীর ছাড়াও যে প্রেম হয় বিবাহিত নারী ও পুরুষের মাঝে অনিমেষ আর মধুরীমার প্রেমটাই উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এসব কেউ বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস যোগ্য নয়। মধুরীমা মাঝে মাঝে ভাবে যার সাথে শরীরের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তার জন্য কেন কষ্ট হবে? ভালোবাসি কথাটি কখনো বলিনি কাউকে তারপরও ভালোবাসার বন্ধন ছিল দৃঢ়। কিছু কিছু সম্পর্কের ব্যাখ্যা হয় না। শুধু কষ্ট হয়। অনিমেষের সাথে দেখা নেই কথা নেই ৩৪২ দিন হলো আজ গুনে গুনে। সব জেনেও মধুরীমা কেন জানি এই দিন গোনার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। মনের অজান্তেই গুনে চলে ও কি এভাবেই দিন গুনে যাবে বাকি জীবন! মধুরীমার মাঝে মাঝে মনে হয় এখন যেখানে যতদূরেই থাকি অনিমেষের সাথে দেখা না হওয়াই ভালো। অনিমেষের সাথে সর্ম্পকটা ভেঙে গেল অতর্কিতে। অনিমেষের ছোট্ট একটা ম্যাসেজে।

মধু ক্ষমা করো। জয়াকে বিয়ে করতে হচ্ছে। জয়ার গর্ভে আমার সন্তান। ফেরার আর পথ নেই। জানি তুমি খুব উদার মনের ভুলে যাবে সব ভালো থেকো.... দুরন্ত। “তোমার শূন্যতা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস বেদনার ঘ্রাণ, তোমার না থাকা জুড়ে জেগে থাকে সহস্র শ্মশান”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App