×

বিশেষ সংখ্যা

‘কলা বৌ’ তত্ত্ব ও তাৎপর্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৮:৪৪ পিএম

‘কলা বৌ’ তত্ত্ব ও তাৎপর্য

নিরঞ্জন অধিকারী

আমরা জানি, দুর্গা প্রতিমার কাঠামোয় কেবল দেবী দুর্গা নন, তার সঙ্গে আরো অনেক দেব-দেবীর প্রতিমা রয়েছে। দেবী দুর্গার বাম পাশে দেবী সরস্বতী ও কার্তিকদের। ডান পাশে দেবী লক্ষ্মী ও গণেশ। থাকেন ছোট আকারের শিব বা মহাদেব। ছোট আকারের হলেও তিনি ছোট নন। তিনি শিবের পত্নী দেবী দুর্গা। এ কারণে দেবী দুর্গাকে বলা হয় শিবানী বা শিব জায়া। গণেশের পাশে থাকেন ‘কলা বৌ’। অনেকেই মনে করেন এই কলা বৌ গণেশের বৌ। আসলে তা নয়। এ প্রসঙ্গেই বর্তমান আলোচনা।

কলা বৌ কেবল কলা গাছ নয়। এখানে নয়টি উদ্ভিদ বা লতা ও বৃক্ষশাখা রয়েছে। এজন্য এর অর্থাৎ কলা বৌ-এর প্রকৃত নাম ‘নবপত্রিকা’। নবপত্রিকা নয়টি উদ্ভিদের সমাহার। শাস্ত্রে বলা হয়েছে : ‘রম্ভা কচ্চী হরিডা চ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ। অশোকো মানকচে¦ব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা\’ অর্থাৎ কলাগাছ, কচুগাছ, মানকচু, হলুদ গাছ, জয়ন্তীর ডাল, বেল, ডালিম গাছ, অশোক ফুলের গাছ ও ধানগাছ। শাস্ত্রমতে গাছপালা দেবতাদের বিভ‚তি। মানব জীবনে গাছপালার প্রয়োজনীয়তা কেবল অপরিসীম নয়, অপরিহার্য। তাই শাস্ত্রে বৃক্ষ-লতাকে দেবতার অধিষ্ঠান বলে বর্ণিত হয়েছে। এদিক থেকে নবপত্রিকার প্রত্যেকটির মধ্যে এবং একজন অধিষ্ঠাত্রী দেবী রয়েছেন। কলাগাছে দেবী ব্রহ্মাণীর অবস্থান, কচু গাছে দেবী কালিকা, হলুদ গাছে দেবী দুর্গা, জয়ন্তী গাছে দেবী কার্ত্তিকী, বেল গাছে দেবী শিবা, ডালিম গাছে দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছে দেবী শোকরহিতা, মানকচু গাছে দেবী চামুন্ডা এবং ধান গাছে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। এ বৃক্ষশাখা ও লতাকে মিলিয়ে লালপাড়যুক্ত সাদা কাপড় পরিয়ে, বেল দুটোকে স্তনের আকার দিয়ে কোনো রসিক পুরোহিত এই সর্ববা নারীর আকার দিয়েছেন। এর বধূরূপী নবপত্রিকা লোকের মুখে মুখে হয়ে গেছে কলা বৌ। হয়ে গেছে গণেশের বৌ। আসলে এ ধারণা কেবল ভ্রান্তই নয়, তা গর্হিত। দেবী দুর্গা শক্তির দেবী। তার রূপ ও বিভ‚তিও বিভিন্ন প্রকার।

নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবীগণের বিভূতির সঙ্গে দেবীগণের রূপ বা বিভ‚তির সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন- দেবী ব্রহ্মাণী রক্তবর্ণা, কলার মোচা ও রক্তবর্ণ। দেবী কালিকা বা কালীর জিহ্বার মতো। হলুদের রং আর দেবী দুর্গার রং একই রকম। কার্তিকের বাহন ময়ূরের গলার রং জয়ন্তী ফুলের সঙ্গে তুলনীয়। শিব বেল গাছ ভালোবাসেন; তাই বেল গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা। ডালিম ফুলের রং আর দেবী রক্তদন্তিকার রং একই প্রকার। দেবী শোকরহিতা অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবী চামুন্ডার জিহ্বার মানকচু গাছের পাতার মতো আর ধানই লক্ষ্মী, তাই লক্ষ্মীই ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এদের প্রতিমা নির্মাণ করে ভক্তিভরে এদের পূজা করা হয়। দেবী জ্ঞানে বৃক্ষলতার প্রতি এই শ্রদ্ধা বৃক্ষলতা সংরক্ষণ করে পরিবেশ সংরক্ষণ করার উপায় বলেই মনীষীরা বিবেচনা করেছেন। নবপত্রিকা এবং তার পূজা বৃক্ষলতা সংরক্ষণ করে পরিবেশ সংরক্ষণ করার সুমহান প্রয়াস।

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষেয় ষষ্ঠী তিথিতে হয় দুর্গোৎসবের বোধন। দুর্গাপূজা আরম্ভ হয় তার পরের তিথি অর্থাৎ সপ্তমীর দিন। এই সপ্তমীর দিন প্রথমেই যে কাজটি করতে হয় তা হলো নবপত্রিকাকে স্নান করানো। মন্ত্রপাঠ করে নবপত্রিকার প্রত্যেকটিকে স্নান করানোর আগে সবগুলোকে একসাথে দড়ি দিয়ে বাঁধতে হয়। নবপত্রিকার এই স্নান মানে হলো বৃক্ষলতাগুলোকে পরিষ্কার করা। মনে করা হয়, এই স্নান কেবল নির্দিষ্ট নয়টি বৃক্ষলতার স্নান মাত্র নয়। এই স্নান নয়টি বৃক্ষলতার অধিষ্ঠাত্রী নয়টি দেবীর স্নান। এক-একটি পত্রিকাকে স্নান করানোর সময় তার কাছে সাফল্য বিজয় ও সমৃদ্ধি প্রার্থনা করা হয়। যেমন হরিদ্রা বা হলুদ গাছের কাছে প্রার্থনা : ওঁ হরিদ্রে হররূপাসি শঙ্করস্য সদাপ্রিয়া। রূদ্রপাসি দেবী ত্বং সর্বসিদ্ধি প্রভচ্ছে মে\ অর্থাৎ হে হরিডা, তুমি হররূপা, শঙ্কর বা শিবের প্রিয়া, তুমি রুদ্র রূপিণী, তুমি আমাকে সর্বসিদ্ধি প্রদান কর। নবপত্রিকাকে স্নান করানোর পর আল্পনা আঁকা পিঁড়িতে বসিয়ে তার পূজা করা হয়। কোনো কোনো স্থানে নবপত্রিকাকে নদী থেকে স্নান করিয়ে আনার প্রথাও রয়েছে। নবপত্রিকায় যে নয়টি দেবীর অধিষ্ঠানের কথা বলা হলো, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এ তিনটি তিথিতে দুর্গা দেবীর পূজার পাশাপাশি পৃথকভাবে তাদের পূজাও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়।

দেবী চামুন্ডার (মানকচুর দেবী) পূজাটি আবার বিশেষভাবে করতে হয়। এ পূজাটি সম্পন্ন করতে হয় অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে। আর অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিস্থলে এ পূজা করা হয় বলে এ পূজার নাম ‘সন্ধি পূজা’। এ পূজাতে কেবল দেবী চামুন্ডারই অধিকার। একটি প্রশ্ন উঠতে পারে : দেবী দুর্গার পূজা করার সময় নবপত্রিকার পূজা করা কেন? এর উত্তর এই যে দেবী দুর্গা শক্তি স্বরূপিনী।

এই শক্তি আবার ব্রহ্মের শক্তি। তাই দেবী দুর্গা ঈশ্বর নন। ঈশ্বরের শক্তির প্রতিমা তিনি। বলা যায়, তিনি শক্তিমানের শক্তি। এখানেই হিন্দু ধর্মে যে একেশ্বরবাদী তার প্রমাণ নিহিত। ঈশ্বরের কোনো গুণ বা শক্তির প্রতীক বা প্রতিমা এক-একটি দেবতা। দেবী দুর্গা যেমন ঈশ্বরের শক্তিরূপ তেমনি তার ধনধানের ক্ষমতা লক্ষ্মী দেবীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। কিংবা তার বিদ্যাদানের ক্ষমতা দেবী সরস্বতীর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তার সিদ্ধি বা সাফল্য প্রদানের ক্ষমতা গণেশ দেবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।

সর্বশক্তিমানের শক্তি শক্তির দেবীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আর প্রকৃতিতেই এই শক্তির প্রথম প্রকাশ। এই যে বৃক্ষলতায় ফুল ফোটে, ফুল থেকে ফল হয়। ফলের বীজ থেকে আবার সৃষ্ট হয় বৃক্ষ বা লতা। এসবই শক্তির বিকাশ। বৃক্ষলতারা দেবতা নয়, বৃক্ষলতার তাদের বিভ‚তি বৃক্ষলতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। ধান, গম, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য মানুষের শক্তি উৎপাদন করে। এ শস্যগুলো মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপায়স্বরূপ। এগুলোতে দেবতার বিভ‚তি প্রকাশ পায়। তাই নবপত্রিকার বৃক্ষলতার অধিষ্ঠাত্রী দেবীদের পূজা করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

আরো একটি প্রশ্ন উঠতে পারে দেবী দুর্গার পূজার সময় বৃক্ষলতার অধিষ্ঠাত্রী যে দেবীদের পূজা করা হয়, তাদের সংখ্যা নয়টি কেন? এ নয়টি দেবীর একটি দেবী দুর্গা নিজে। বাকি আটটি দেবী দুর্গা বা শক্তির দেবীর আটটি বিভিন্ন রূপ। তবে এদের দেবীর সহায়িকা অষ্ট নায়িকাও বলা হয়েছে। এরা হলেন : ব্রহ্ময়ণী, মাহেশ^রী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী, কৌমারী, ঐন্দ্রী, চামুন্ডা ও দেবী কালিকা বা কালী। তবে অষ্ট নায়িকা না বলে এ আটটি দেবীরই বিভিন্ন রূপ বলাই সঙ্গত। নবপত্রিকার পূজা দেবীরই বিভিন্ন রূপের পূজা। আর কলা বৌ গণেশের বৌ নয়। এটা ভাবা অজ্ঞতা মাত্র। তার স্ত্রী দেবতারা তাদের পতিদেবতার বামে থাকেন। ডাইনে নয়। কলা বৌ যদি গণেশের স্ত্রী হতেন, তাহলে তার অবস্থান গণেশের ডাইনে না হয়ে বামে হতো।

সুতরাং কলা বৌ বা নবপত্রিকা দেবীর নয়টি রূপের সমন্বিত প্রকাশ। কলা বৌ দেবী বিভূতি। এ বিভূতি আবার ঈশ্বরের শক্তিরই বিভিন্ন প্রকাশ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App