×

বিশেষ সংখ্যা

করোনাধারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২০, ০৭:৩৪ পিএম

করোনাধারা

মুস্তফার কি করোনা পজেটিভ? যদি হয়ে থাকে মরে যাবে সে? মরে যাবে। ফরিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। চিন্তাশীল এবং বাস্তববাদী ফরিদ। যা বলেছে যুক্তি আছে। শরীরে বহুত গড়বড় মুস্তফার। মনে গড়বড়। দেহের ওষুধ খায়। মনের ওষুধ খায়। ফাইভে সিগারেট, এইটে গাঁজা, নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে বাংলা মদ, সে তার জার্নি স্টার্ট করেছিল। সেই জার্নি এখনও ফুরায়নি। সে মরে গেলে ফুরিয়ে যাবে? মুস্তফার সত্যি কি করোনা হয়েছে? করোনা পজেটিভ? লক্ষণ ভালো নয়। জ্বর জ্বর, খুশখুশে কাশি, মাথা চক্কর খায়। মুস্তফা জানে সে মরে যেতে পারে। বিশেষ করে করোনায় মরে যেতে পারে। সেটা হলে শান্তি পায় সে। ঢাকাবাসীকে বলেছিল। ঢাকাবাসী বলেছে, ‘লিস্টে তোর নাম নাই। হরির ধনের নাম আছে।’ হরিধন বণিক। ওয়ান থেকে তারা ডাকে হরির ধন। বিরাট ব্যবসায়ী। পাথরের ব্যবসা, কয়লার ব্যবসা। কলকাতায় খুব আনাগোনা করে। একবার বউ নিয়ে ফিরল। কলকাতার ডায়মন্ড হারবারের মেয়ে। হালুম হুলুম ভাষায় কথা বলে। গোপনে কম কালচার হয়নি টাউনে। সেই হালুম হুলুম মেয়ে এখন টাউনের ভাষায় কথা বলে। টাউনের জনগণের অতি প্রিয় অপর্ণাবৌদি। এত দিনে হিসাবমতো দুই সন্তান থাকত হরির ধন ও অপর্ণার। দ্বিতীয়বার অপর্ণা ডাবল ডেলিভারি দিয়ে ফেলেছে। দুই মেয়ে এক ছেলের জনক জননী তারা। মেয়ে জমজ না, এক মেয়ে আর এক ছেলে জমজ। বিগত সতেরো-আঠারো বছরে অপর্ণা যা হয়েছে দেখতে! নব্বই কেজি হবে ওজন। ফেসবুকে আছে হরির ধন। নিয়মিত বউয়ের ছবি পোস্ট দেয়। অপর্ণা ফেসবুকে নাই। তার এসব ভালো লাগে না। ঢাকাবাসী এজন্য অত্যন্ত গুণমুগ্ধ অপর্ণার। ফেসবুকে নাই ঢাকাবাসীও। হোয়াট্স অ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে আছে। ইনস্টাগ্রামে ফলো করে মাত্র একজনকে। পার্বতী তিরুবাতু। এটা কে? মালায়ালাম ছবির নায়িকা। বাধ্য হয়ে দেখেছে মুস্তফা। ঢাকাবাসী এতবার বলেছে। না জানি কেমন দেখতে মেয়েটা। ঢাকাবাসী এরকম একেক সময় একেকজনকে নিয়ে পাগলা হয়। তার পার্বতী তিরুবাতুকে দেখে মুস্তফা নিরাশ হয়েছে না হয়তো, তবে তার ধারণা মিলেনি সামান্যতমও। পার্বতী তিরুবাতু মেয়েটা টাউনের উকিলপাড়া কি ষোলোঘর, কি হাওয়াপাড়ার যে কোনো মেয়ের মতো দেখতে। মায়াভরা মুখ। মুস্তফার এই পর্যবেক্ষণে ঢাকাবাসী বিরক্ত হয়েছে, ‘তুই কী মনে করছিলি? সানি লিওনের মতো কেউরে দেখবি।’ ‘তা না-।’ ‘তা না মানে? তা না মানে? শোন, তুই আর বুলবুল চৌধুরী, তোরার আত্মায় বø্যাকহোল ছাড়া কিছু নাই আর। অন্ধকার গর্ত। আরে, একটা বয়স আসে মানুষের, জগতের মায়া কিছু ধরা যায়। পার্বতী একটা মায়া। ও তুই বুঝবি না।’ সে সবকিছু বোঝে। ঢাকাবাসী, বসে আছে ঢাকায়, কানাকানির খবর রাখে টাউনের। কার বউ কাকে ঝাঁটাপেটা করে, কার বউ অতৃপ্ত আত্মা, কার বউ পোয়াতি, কার বউ কোন প্রফেসরের কোলে বসে থাকেÑ টাউনের সব খবর মজুদ থাকে তার আছে। কী করে পায়? নেটওয়ার্কে আছে। তার নিজের দশা তেমন একটা সুবিধাজনক না হলেও। বিয়ে করেছিল, বউ চলে গেছে। একা থাকে এগারো-বারো বছর ধরে। সম্পর্ক সম্ভবত এক বিড়ালিনীর সঙ্গে। ভুলবশত তাদের একটা ছবি মুস্তফার হোয়াটস অ্যাপে সেন্ড হয়ে গিয়েছিল। ঢাকাবাসী এবং বিড়ালিনীর সেলফি। চশমাপরা বিড়ালিনী। কিউট দেখতে। মুস্তফা ভুল করে ফেলেছে। বলে দিয়েছিল ঢাকাবাসীকে, ‘বিলাইনি তো সেই রকম দেখি।’ ‘বিলাইনি মানে? সেই রকম, কী রকম? বিলাইনি কে? ’ ‘সেলফি যে দেখলাম। তোর সাথে একটা ছোটোমোটো মেয়ে বিলাইয়ের ইফেক্ট দিয়া সেলফি তুলছে। তোরে অবশ্য বিলাই বানায় নাই।’ ‘কী? এই ছবি তুই কই দেখলি? ছোটো মতো এই মেয়ে পড়ে এইটে।’ ‘মেয়ে এইটে পড়ে। ইয়া মাবুদ! এই মেয়ে তোর বাসায় আসে? তোর মতো একটা বুড়ার কাছে কী চায়? বল।’ ‘হলুদ খেজুরের রস চায়। তোর সমস্যা? কিন্তু ছবি তুই কই দেখলি?’ ‘হোয়াটস অ্যাপে। তুই নিজেই সেন্ড করছিস।’ ‘আমি সেন্ড করেছি? মাথা খারাপ। ভুলে সেন্ড হয়ে গেছে। তুই এই ছবি ডিলিট কর। এখনই ডিলিট কর।’ ‘করতেছি।’ ঢাকাবাসীর সঙ্গে কথা শেষ করে মুস্তফা ছবিটা ডিলিট করে দিয়েছে (?)। তার আগে শান্ত সুবোধভাবে ফরিদ, মান্না, মসরু, রুমেন, অনজন, শামিম, দুই খোকন এবং হরির ধনকে ফরোয়ার্ড করেছে। কাশি উঠল এবং করোনা আবার দুশ্চিন্তা বানিয়ে দিল মুস্তফার চিন্তাকে। শনিবারে রিপোর্ট দেবে। করোনা যদি পজেটিভ হয়? মুস্তফা একটা সিগারেট ধরাল। আশ্চর্য! দুই টান দিতেই কাশি কমল। ফরিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আবার নিরস গলায় এই কথাও বলেছে, ‘সিগারেট বিস্বাদ না লাগলে বুঝবি কিছু হয় নাই।’ সিগারেট না, সিগারেটের পরদাদা এ। বিস্বাদ লাগছে না, আরেক রকম লাগছে। ডুংরিয়ার হইলদা বিবির মাজারের ফুল। ঘ্রাণ আলাদা, স্বাদ আলাদা। সিগারেটটাকে মুস্তফার মনে হলো পাপড়ি। তার বউ। তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তবে তাদের আইনানুগ ছাড়াছাড়ি হয়নি। ছয় বছর হয়ে গেল। পাপড়ি ছোটো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। বড়ো ছেলে হোস্টেলে থেকে পড়ে। মুস্তফার তত্ত্বাবিধানে। বিশেষ ফুলের ঘ্রাণ ছিল পাপড়ির শরীরে। এখনও আছে? পাপড়ি আর বিয়ে করেনি কেন? শালা রোমান্টিক! মুস্তফা বোকা হাসি দিল। পাপড়িকে টানল। মনোযোগ সহকারে টানল। তার নেশার লাটিম ঝিম ধরল। পাপড়িকে এখন সে নিশ্চয় একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাতে পারে। কী লিখবে? মোবাইল ফোন বাজল। কে? পাপড়ি? কলার কে না দেখে মুস্তফা ধরল, ‘হ্যালো?’ ‘কী অবস্থা তোর?’ ফরিদ। মুস্তফা বলল, ‘ভালো।’ ‘ভালো হইলেই ভালো। জ্বর আছে?’ ‘না!’ ‘কাশি?’ ‘না।’ বলতে না বলতে কাশি উঠল। মুস্তফা খুকখুক করে কাশল। ফরিদ অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে ৩৮ সেকেন্ড মুস্তফার খুকখুক শুনল। কাশি-বিরতিতে বলল, ‘পানি খা। গরম পানি খা।’ ‘খাই। চিন্তা করিস না। আমি ঠিক আছি।’ ‘চিন্তা করব কেন? তোরে নিয়া আমি চিন্তা করব কেন? তোর চিন্তা করার মানুষ কত টাউনে।’ ‘তা ঠিক। তোদের দোয়ায় আমার একটা আলাদা হোল্ড আছে টাউনে। মানুষজন মানে, আদাব সালাম দেয়। তারা চিন্তিত আমিও শুনছি। জুমে একটা ভিডিও কনফারেন্স করব ভাবতেছি। তাদের বলব, ভয় নাই ব্রাদারস।’ ‘তুই এরকম কেন রে মুস্তফা? সারা জীবন এক রকম থাকলি। কেন?’ তেতে উঠে ফোনের লাইন কেটে দিল ফরিদ। মুস্তফা হাসল। এমনই ফরিদ পরোপকারী, দায়িত্বশীল, সাব্যস্তবাদী, বন্ধুদের ‘মুরব্বি।’ ঢাকাবাসীর একটা মন্তব্য আছে, ‘তারাশঙ্করের উপন্যাসে শুধু ফরিদের মতো চরিত্রের মানুষ দেখা যায়।’ মুস্তফা বহু আগে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের বই পড়ত। আরও কিছু বইও পড়েছে- একটা তারাশঙ্করের ‘কবি’। ২৮-৩০ বছর আগে পড়েছে, নিতাই ঠাকুরঝি রাজার কথা মনে আছে এখনও। ফরিদের মতো চরিত্রের মানুষ কে? নিতাই? রাজা? মুস্তফা মিলিয়ে নিতে পারে না। ঢাকাবাসী বিরাট ভাবজীবী দেশের। বিশেষ কলামে লিখে পত্রিকায়। দুপুর ১২টা, রাত্র ১টা যে কোনো সময় এর মুণ্ডু দেখা যায় টক শো-তে। টেলিভিশনে, অনলাইন চ্যানেলে। দেশদশ নিয়ে কথা বলে। দেখলে হাসি পায়। বন্ধুদের সঙ্গে অবশ্য ভাব নেয় না। নিলে খবর হয়ে যাবে, অবগত আছে। বন্ধুদের কাছে সে সেই উদোই। কোন উদো? ইরাকের সাদ্দামের ছেলে উদো না, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ের উদো না, এই উদো উদলা থেকে থেকে হয়েছে। উদলা জোয়ান, সংক্ষেপে উদো। লিকপিকে এক নলখাগড়া, তার নাম কেন উদলা জোয়ান পড়ল, ভাস্করদা ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। ভাস্করদা টাউন-গবেষক। নাড়ি-নক্ষত্র জানে টাউনের আর তার। একই পাড়ার বাসিন্দা, একই লাইনের ভাস্করদার সঙ্গে মুস্তফার সম্পর্ক মধুর হার্দিক। এই যে মুস্তফার করোনা হয়েছে মনে করে দেশ ও জাতি চিন্তিত, করুণ এই সময়ে মুস্তফার পাশে আছে কে? একমাত্র ভাস্করদা। দুপুরেও একসঙ্গে ছিল। পরিমলের দোকানে বসে তারা দুই কাপ দুই কাপ চার কাপ চা আর তিনটা সিগারেট ফুঁকে দিয়েছে। একটা সিগারেট ভাগ করে টেনেছে। ভাস্করদা প্রথম টেনে দিয়েছে অর্ধেকটা। মুস্তফার করোনা পজেটিভ হলে কি ভাস্করদারও করোনা হবে এবং পজেটিভ হবে? নাও হতে পারে। ঢাকাবাসী বলেছে করোনা ভাইরাসের চলন-বলন আর বোঝা যাচ্ছে না। তাও যদি ভাস্করদার কিছু হয়ে যায়, মুস্তফাও ভাস্করদার সঙ্গে থাকবে। পরিমলের দোকানে বসে দুই দুই চার কাপ চা খাবে, ভাগ করে সিগারেট টানবে। আর তিনটা সিগারেট আছে বানাবে। মধু দাদা ভালো কথা বলে- খাই দুটো গাছের ফুল তাও সবার চক্ষুশূল! মুস্তফা এক কাপ চা বানাল এবং আরেকটা সিগারেট ধরাল। করোনা কি পজেটিভ আসবে তার? মরে যাবে যে? মরে গেলে কী হবে? করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ, পাপড়ি দেখতে আসার প্রশ্নই উঠে না। দাফনের ব্যবস্থা করবে ফরিদ শামীমরা? গোর দেবে কোন গোরস্থানে? টাউনে গোরস্থান এখন কয়েকটা। মনকির নকির দুই ফেরেশতা কোন গোরস্থানে তাকে সওয়াল করতে ঢুকবেন? ফেরেস্তারা দেখতে কি রকম? ‘মস্তফ!’ ভাস্করদা ডাকল। ভাস্করদা মুস্তফাকে ডাকে মস্তফ। আর ডাকে কাওসার মামু। কাওসার মামু ঢাকার রামপুরায় থাকে। উলন রোডে। তার একবার করোনা পজেটিভ হয়েছে। তেরো দিন ভুগেছেন। ঢাকাবাসী চতুর্থ দিন রাতেই বলেছিল, ‘আরে ব্যাটা মামুর কিছু হবে না। লিস্টে মামুর নাম নাই।’ কীসের লিস্ট? লিস্ট কি ঢাকাবাসী করে নাকি? করতেও পারে। ঢাকাবাসী টকার। করোনা প্রতারক আন্ডার মেট্রিক সাহেদও টকার- লোটাবাটি কম্বল জেলখানায় সম্বল গানের জিওল মডেল এখন। ঢাকাবাসী অবশ্য অযথা অপরাধমূলক কিছু করবে না। কিন্তু মুস্তফাকে কে ডাকল? একবার ডাকল। ভাস্করদা একবার কেন ডাকবে? তবে? নিশি? মুস্তফা হাসল এবং ভৌতিক নিশি না, বটছড়ার নিশিরানিকে ভাবল। বটছড়ায় সে কিছুদিন ছিল। নিশিরানিকে দেখেছে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ শরীরের মাটির চুলায় আগুন। মুস্তফা পতঙ্গ হয়েছিল এবং সেই আগুনে পুড়েছিল একলা মেঘলা দুপুরে। এরকম আর কখনও না। নিশিরানির ঘ্রাণ পায় এখনও মুস্তফা। এখন পাচ্ছে ভোরের নিমফুলের ঘ্রাণ হাওয়ায়। ফরিদকে এই তথ্য অবগত করা অতীব জরুরি। শরীরে করোনার লক্ষণ দেখা দিলেও ঘ্রাণ পায় সে। আশ্চর্য ঘ্রাণ। ‘মুস্তফা! এ মুস্তফা!’ ভাস্করদা না, ঢাকাবাসী এ! কিন্তু কী করে? সে বলেনি সে টাউনে আসছে। কথা হলো কতক্ষণ আগে? অবশ্য সে আধ প্লাস পাগলা। মূর্তিমান একটা অসম্ভব-কিছু-না। ‘মুস্তফা!’ মুস্তফা দরজা খুলল এবং মূর্তিমানকে দেখল। ঢাকাবাসী কি করোনায় আরও লম্বা হয়ে গেছে? ছয় ফুট আধ ইঞ্চি হয়েছে? মুস্তফা বলল, ‘তুই!’ ‘আমি না আমার প্রেতাত্মা।’ ঢাকাবাসী হাসল। মুস্তফা বলল, ‘সন্ধ্যায় কথা হইল, কিছু বললি না।’ ‘সন্ধ্যায় আমি মরি নাই। আট মিনিট নয় সেকেন্ডে আগে মরছি। চিন্তা করলাম লিস্টটা তোরে দিয়া যাই।’ ‘লিস্ট! কিসের?’ ‘কিসের মানে? লিস্ট করে রাখছি বলি নাই, কে কে মরব টাউনের।’ ‘অ আচ্ছা। ঘরে আয় বস। চা বানাই।’ ‘না। লঞ্চঘাটে গিয়া চা খাব। পরোটা-ডিম খাব। চল।’ ‘লঞ্চঘাটে! এতো রাতে?’ ‘কেন? লঞ্চঘাট কি এত রাতে খোলা থাকে না?’ ‘সেই কথা না-।’ ‘তবে কোন কথা? কোনো কথা নেই। তুই চল হাঁটব।’ তা তারা হাঁটত এককালে। বহু বছর আগে। সারারাত টাউনের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটত। সেই রকম দিন কি আর আছে? না সেই রকম আছে তাদের বয়স? তবুও রাতভর তারা হাঁটল। লঞ্চ ঘাটে গেল। নাস্তাপানি করল। নদীর ঘাট দেখল। নদীর অন্ধকার। মাছ ধরা কিছু নৌকার কুপি দেখল নিস্তরঙ্গ নদীতে। সব ইঞ্জিনের নৌকার শব্দ আরও বহুকাল পরে চলে গেছে। মনে হলো তাদের। ঢাকাবাসী লিস্ট করে রেখেছে, টাউনের কে কে মরবে করোনায়? ‘হরির ধন মরবে।’ ‘শিওর?’ ‘শিওর। হাফজল মরবে।’ ‘শিওর?’ ‘শিওর। সুরি পোদ্দার, এরতেজা উকিল, অংশুদা মরব।’ ‘শিওর?’ ‘শিওর।’ ‘নারীজাতি কেউ মরব না?’ ‘লিস্ট নাম আছে ঝুুলি আপার।’ হাফজল আবজল। ঝুুলি আপা তুলি আপা। বাসস্ট্যান্ড রোডের তুলি আপা অবশ্যই বিশেষ দ্রষ্টব্য টাউনের। বেয়াল্লিশ সাইজ। বয় হান্টার এই বয়সেও। টাউনের মায়েরা বউরা ডরায়। ছেলের জন্য, জামাইয়ের জন্য। তুলি আপার করোনা পজেটিভ হলে খবর আছে। চেইন রিএকশন শুরু হয়ে যাবে টাউনে। ঢাকাবাসীর জন্ম মড়ার টিলা রোডে। পৈতৃক নিবাস। তাকে তার বাসার গেটে রেখে রাতে ঘরে ফিরেছে মুস্তফা। ঘুমিয়ে উঠে দেখে শুক্রবার সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সন্ধ্যা দেখার ফুরসত মিলল না, বৃষ্টি নামল আকাশের অন্ধকার থেকে কাঁপিয়ে ঘানি ভাঙা সর্ষের তেল আছে ঘরে। মুড়ি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ আছে। ঢাকাবাসীর কথা মনে পড়ল এবং তাকে কল দিল মুস্তফা। ঢাকাবাসী ধরল। ‘কী রে শিয়াল?’ মুস্তফা বলল, ‘ঘুম দিয়া এই মাত্র উঠলাম। তুই তো আজ যেতে পারবি না। যেকরম বৃষ্টি!’ ‘আমি আজ যাব। আজ রাতে যাব।’ বলে ফোনের লাইন কেটে দিল এবং ফোন অফ করে দিল ঢাকাবাসী। সব সময়ই এমন অদ্ভুতুড়ে সে। প্রস্তুতি নিয়ে টাউনে আসেনি। জুরাইনের শবনম ভাবির ফ্ল্যাটে যাচ্ছিল। টাউনের বাস দেখে টিকেট কেটে উঠে পড়েছে। চলে যাবে আজ রাতেই। টক শো আছে সকালে? নাকি বাস থেকেই লাইভ করবে? বিচিত্র না। ঢাকাবাসীর একমাত্র বোন তিনা। কেউ অবশ্য তিনা বলে না, বলে তিননা। পরীক্ষা না দিয়ে এবার এইচএসসি পাশ করে গেছে। করোনার সাইড এফেক্ট। মুস্তফা কল দিল তিননাকে। কল যাচ্ছে। তিননা ধরল, ‘আস-সালামওয়ালিকুম মুস্তফা ভাই। কী নিউজ?’ মুস্তফা হাসল, ‘ওয়ালিকুম সালাম রে বইন। আগে বল তুই ভালো আছিস তো?’ ‘আমি ভালো আছি। তোমার রিপোর্ট তো মনে হয় দিব কালকে। তোমার করোনা নেগেটিভ আসব।’ ‘দোয়া করিস।’ ‘অবশ্যই দোয়া করব। এখন বলো কী নিউজ?’ ‘আর নিউজ! তোর দাদা ভাই কী করে?’ ‘এই দেখো! দাদাভাই কী করে আমি কীভাবে বলল? তুমি তারে ফোন দিয়া জিগাও।’ ‘সে কি ঘরে নাই? এই বৃষ্টির মধ্যে গেছে কই রে?’ ‘আরে। তোমার কি মাথাখারাপ হইছেনি মুস্তফা ভাই? না তোমার যা জানো টানছ? দাদাভাই ঘরে কীভাবে থাকব? সে কি আসছে?’ কী বলে তিননা! মুস্তফা বলল, ‘আসে নাই?’ ‘আমি শিওর তুমি স্বপ্ন দেখছ মুস্তফা ভাই। মাত্র দাদাভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। সে বলল ঢাকায় প্রচÐ গরম। তার ঘরের এসি নষ্ট হয়ে গেছে। জানো তো সে গরম সহ্য করতে পারে না। আহা উহু করল।’ ‘ঢাকায় প্রচণ্ড গরম! আমি অবশ্য মাত্র ঘুম থেকে উঠছি।’ ‘এই তো, বললাম না, স্বপ্ন দেখছ তুমি! শীত না পড়লে দাদাভাই আসে টাউনে? দুই বছর ধরেতো শীতেও আসে না। এই নভেম্বরে বলছিল আসবে। করোনা আবার বাড়লে তাও আসবে না। তুমি বলো সে ঘরে কী না!’ মুস্তফার মাথায় কিছু ঢুকল না। হতবুদ্ধি সে কল দিল লঞ্চঘাটের সনু মিয়াকে। সনু মিয়ার দোকানে কাল রাতে তারা চা নাস্তা করেছে। অনেকক্ষণ বসেছে। সনু মিয়া কল ধরে বলল, ‘হ্যালো! কে?’ ‘সনু মিয়া, আমি মুস্তফা । কলেজের মুসলিম হোস্টেলের উল্টাদিকের বাসার মুস্তফা।’ ‘ইয়া মাবুদ! মুস্তফা ভাই! আসলামআলিকুম, ভাই। চাইর-ছয় বছর পর ফোনে গলা শুনলাম ভাই। শুকরিয়া। ভাই কি ফরেইনে গেছিলেন নাকি?’ চার-ছয় বছর পর ফোনে গলা শুনেছে! তার মানে মুস্তফা কাল রাত লঞ্চ ঘাটে যায়নি? ঢাকাবাসী যায়নি? বৃষ্টি অল্প ধরব, আবার বাড়ল। মুস্তফা কল দিল ঢাকাবাসীকে। সুইচড অফ ফোনের। মুড়ি ভাজার পরিকল্পনা বাদ দিল মুস্তফা। দুধ চা বানাল। মুড়ি খাবে দুধ চায়ে ভিজিয়ে। কিন্তু মুড়ি নেতিয়ে গেছে। অগত্যা চায়ের সঙ্গে টা হলো সিগারেট। শুকনো ফুলের চ‚র্ণ ভরা সিগারেট। বৃষ্টি জমল। রাত জমল। ভাত আছে, তরকারি আছে। গরম করে খেয়ে মুস্তফা আরেকটা শুকনো ফুলের সিগারেট ধরাল। বৃষ্টি আরও তুমুল হয়ে নামল। অকালের বৃষ্টি। এই বৃষ্টির পর কি শীত পড়ে যাবে? পরদিন শনিবার, দুপুরে ঘুম থেকে উঠল মুস্তফা। ফোনে মেসেজ দেখল। নেগেটিভ। তার মানে তার করোনা নেগেটিভ। পানি-পথের যুদ্ধে জয় লাভ করার মতো আনন্দ হলো মুস্তফার। তার মনে হলো সে একটা দৌড় দেয়। তার মনে হলো দুপুরের রোদ আশ্চর্য কমলা। তার মনে হলো কী মনে হলো।... ঢাকাবাসী হলে সে লিস্ট করে রাখত। হরির ধনের কি করোনা হয়েছে? ঢাকাবাসী আর যাদের কথা বলেছে? হরির ধনকে কল দিল মুস্তফা। এই হরির ধন তোর শুনলাম করোনা হইছে? হরির ধন মুখ খারাপ করল, ‘ডট ডট। আমার করোনা হবে কেন রে ডট ডট? তোরে এই কথা টাউনের কোন ডট ডটের ছেলে বলছে? মাত্র ব্যাটা মালা জপ করতে বসছি! প্রভু! প্রভু!’ সস্ত্রীক দীক্ষা নিয়েছে হরির ধন। তাদের গুরু হিমালয় পর্বতের গুহায় একশ দশ বছর তপস্যা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে ডিরেক্ট মন্ত্র নিতে পেরে বিরাট বিগলিত হরির ধন এবং তদীয় পত্নী। তাদের গুরুদেবকে তারা ডাকে প্রভু!’ ‘তোর বউ ও মালা জপতেছে!’ ‘তবে কী করবে রে? ডট ডট!?’ ‘না ভাই এই তো। তোরা হইলি মধ্য বাজারের মানুষ।’ মধ্যবাজারের বউ-ঝিদের কেচ্ছা টাউনের হাওয়ায় কান পাতলেও শোনা যায়। রঙ্গিনী-ঢঙ্গিনী তারা। হরির ধন খেপল না, হাসল। হেসে আরও মুখ খারাপ করল। দিনের প্রথম শুকনা ফুলের সিগারেটটা ধরাল মুস্তফা। ঢাকাবাসী এবং ফরিদকে কল দিতে হবে। আশ্চর্য! ফরিদ কল দিল। মুস্তফা ধরল, ‘হ্যালো বস?’ ‘খবর কী তোর?’ ‘নেগেটিভ বস। মেসেজ পাইলাম।’ ‘আচ্ছা। তুই কিছু শুনছিস?’ ‘না! কী?’ ফরিদ বলল। করোনা হয়েছিল, কাউকে বলেনি, হাসপাতালে যায়নি, কিছু করেনি, ঢাকাবাসী মারা গেছে গতকাল সন্ধ্যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App