×

মুক্তচিন্তা

মোদি আমলে বিচার বিভাগেও হিন্দুত্ববাদিতা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ০৭:৪৪ পিএম

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যখন নাগরিক অধিকার ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ব্যাহত হয়, তখন বলা হয়ে থাকে, মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়, শেষ আশ্রয় আদালত, প্রধানত উচ্চ আদালত, আর বিশেষ আদালত হলে তো কথাই নেই। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় যুক্তিবাদী মানুষকে হতাশ করেছিল- কী ভারতীয়, কী বাংলাদেশি।

অযোধ্যায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হলো, তার সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো। নেতৃত্বে লালকৃষ্ণ আদভানি, উমা ভারতীসহ সব হিন্দুত্ববাদী নেতা- সংগঠনগতভাবে বিজেপি, আরএসএস শিবসেনা ইত্যাদি। করসেবকদের স্বেদাক্ত কৃতিত্বে আদালতের স্থিতাদেশ লঙ্ঘন করে এই বেআইনি কর্মটি সম্পন্ন করা হলো। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার বড় উপলক্ষ ছিল প্রতীকী রামমন্দির প্রতিষ্ঠা, বলাবাহুল্য তা বাবরি মসজিদটির স্থানে। ওদের দাবি, সেখানে রামের প্রতিষ্ঠিত মন্দির ভেঙে মুঘল সম্রাট বাবর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালত শেষ পর্যন্ত সেখানে স্থিতাবস্থা ঘোষণা করেন। অর্থাৎ ওটা রাম রহিম কারোর নয়, ওটা আদালতের এখতিয়ারে। এরপরও আদালতের সে বিধান লঙ্ঘন করে ছোটখাটো অনেক বিতর্কিত রাজনৈতিক স্বার্থের ঘটনা ঘটেছে। আমরা সেসবের মতিকাহনের বিবরণে যাবো না। বরং দুয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তুলে ধরব যা ভারতীয় সংবিধানের সেকুলারিজমকে আহত করবে। পরিকল্পিতভাবে ১৯৯০ সালে তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতা আদভানি রাম রথযাত্রার অনুষ্ঠান (লংমার্চের অনুকরণে) শুরু করেন যা বিভিন্ন রাজ্য ছুঁয়ে অযোধ্যায় অকুস্থলে পৌঁছাবে। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস শাসন চলছে। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ভয়ে তারা এ রথযাত্রায় বাধা দেয়নি বা এ বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেনি। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত তখন সিপিআই (এম) শাসন চলছে। তারাও এ সম্প্রদায়বাদী রথযাত্রা বন্ধ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর একটি লেখা পড়েছিলাম সেখানে তাদের চেষ্টা ও ভূমিকা ছিল। আদভানিদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তী দুবছর তারা বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালায় নানা মিথ্যা তথ্য ব্যবহারে। তারপর আসে সেই ভয়ঙ্কর দিনটি যেদিন অযোধ্যায় বহুসখ্যক কর সেবককে জড়ো করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত শাসনযন্ত্র যথোচিত প্রতিরোধ ব্যবস্থার আয়োজন করে। কিন্তু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী দলীয় স্বার্থরক্ষায় এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও, যিনি একজন মননশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনিও এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা করেননি, কিংবা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির যতটা সম্ভব ব্যবহারের কোনো চেষ্টা করেননি। স্বভাবতই যা ঘটবার তাই ঘটেছে। আদভানি, উমা ভারতী প্রমুখের নেতৃত্বে বিপুলসংখ্যক করসেবক বিনা বাধায় মহাউল্লাসে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজটি সম্পন্ন করে, যে কথাটি এ রচনার শুরুতেই বলা হয়েছে। তারপরও ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি দীর্ঘদিন বিতর্কিত হয়ে আদালতের এখতিয়ারে থেকে গেছে। চলেছে দুপক্ষে তাত্তি¡ক ও রাজনৈতিক লড়াই। ইতোমধ্যে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নেয়া হয়। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুসন্ধানী খনন কাজ শুরু করে। তাতে কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ যা কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, এখানে যে মন্দির ছিল, নিদর্শনাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে তা প্রমাণিত হয় না। অর্থাৎ আবারো অনিশ্চয়তা- মন্দির, না মসজিদ তা নিয়ে। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত তৎকালীন ভারত শাসক বিজেপির তৎপরতায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে আমরা ইতোপূর্বে একটি নিবন্ধে আলোচনা করেছি। \দুই\ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যখন নাগরিক অধিকার ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ব্যাহত হয়, তখন বলা হয়ে থাকে, মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়, শেষ আশ্রয় আদালত, প্রধানত উচ্চ আদালত, আর বিশেষ আদালত হলে তো কথাই নেই। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় যুক্তিবাদী মানুষকে হতাশ করেছিল- কী ভারতীয়, কী বাংলাদেশি। পূর্বোক্ত বাবরি মসজিদ অর্থাৎ একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস এবং সাম্প্রদায়িক প্রচারণা নেতৃত্বদানের কারণে লালকৃষ্ণ আদভানি, উমা ভারতী প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। দীর্ঘকাল নানা টানাপড়েনের পর সম্প্রতি লখনৌর সিবিআই বিশেষ আদালত সেই মামলার রায় প্রকাশ করেছে। বিজেপি শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মসজিদটি ভাঙার চক্রান্ত, পরিকল্পনা, প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। আদালত এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযুক্তদের ‘বেকসুর খালাস’ বলে রায় দিয়েছে। এ রায়ে অভিযুক্তরা ও তাদের সংগঠনগুলো বেজায় খুশি, কংগ্রেস হতাশ এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড উচ্চ আদালতে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তিবাদী সাংবাদিকরা তী² তির্যক ভাষ্যে, যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হলো : এমনটিই তো হবার কথা মোদি শাসনে। কারণ হিন্দুবাদী বিজেপি কয়েকটি রাজ্যসহ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন। তাদের পক্ষে ভারতব্যাপী যে কোনো ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টি করা, এমনকি দাঙ্গা হাঙ্গামা খুব সহজ। কলকাতার সাংবাদিক সৌমিত্র দস্তিদার লিখেছেন যে ১৯২৫ সালে জন্মলগ্ন থেকে আরএসএসের ছিল প্রধান দুটো এজেন্ডা-ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানা কায়দায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা। বক্তৃতা বিবৃতিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যাই বলুন না কেন, পরাক্রমশালী মন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতারা পূর্বোক্ত এজেন্ডা মাফিকই এগিয়ে চলেছেন। তবে আমাদের বিস্ময় আদালতগুলোর আচরণ দেখে গণমাধ্যমে, দৈনিক কাগজে এত সচিত্র সাক্ষ্যপ্রমাণ অভিযুক্তদের আচরণের, আদভানির রথযাত্রাসহ সাম্প্রদায়িক বিবৃতি তাদের বিবেচনায় আসেনি। দেখেননি করসেবকদের বেআইনি কর্মকাণ্ডের সময় আদভানিদের সেখানে উল্লসিত উপস্থিতি যা সেবকদের প্রেরণা জুগিয়েছে। সাংবাদিক সৌমিত্র দস্তিদারের তির্যক অভিমত- এমনই তো হওয়ার কথা মোদি আমলে বিচারকদের আচরণ। তার লেখা কলামটির শিরোনামও ‘বাস্তববাদী : বাবরি মসজিদের রায় যে কারণে বিস্ময়কর নয়’। তবু মানুষের অধিকার রক্ষার শেষ আশ্রয় আদালতের একদেশদর্শী আচরণ আমাদের কাছে বিস্ময়করই মনে হয়।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App