×

মুক্তচিন্তা

‘বিভাগীয়’ শব্দের তদন্ত প্রতিবেদন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ০৫:২৮ পিএম

শক্তি-সাহস-ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু প্রশাসন; সুতরাং ক্ষমতার প্রশ্নে প্রশাসনিক বিভাগের গুরুত্ব সবসময়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে আমাদের দেশে প্রশাসনিক বিভাগ ছিল চারটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনা; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরো চারটি বিভাগ, সিলেট-বরিশাল-রংপুর ও ময়মনসিংহ; সম্ভবত আরো দুয়েকটি পুরনো জেলা বিভাগ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। নতুন বিভাগ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিভাগীয় দপ্তর-প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলে।

‘বিভাগ’ থেকেই ‘বিভাগীয়’; ‘বিভাগ’ সম্পর্কীয় যা কিছু তাই বিভাগীয়; তারও আগে ‘ভাগ’ থেকে ‘বিভাগ’; ‘ভাগ’ শব্দের আগে ‘বি’ উপসর্গ যোগে বিভাগ। ‘ভাগ’ গণিতের একটা বিশেষ বিধান। ভাগ হলেই কারো ভাগে কিছু জমা হয়; তেমনি ভাগ হলেই কারো ভাগ থেকে কিছু খরচা হয়ে যায়। আর বাঙালি ‘ভাগ-বাটোয়ারা’টা ভালোই বোঝে! লোকবাংলায় তাই প্রচলিত আছে ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না!’ কথাটি। নিজের ভাগ বাঙালি ছাড়তে রাজি নয়; ‘ভাগ করে দে মা চেটে-পুটে খাই!’ ভাগ ছাড়ার কথা উঠলে মাথায় আগুন জ্বলে! প্রয়োজনে ভাই, ভাইকে খুন করবে; ছেলে বাপের কল্লা কাটবে, ভাই বোনকে বিধবা করবে; কিন্তু ভাগের অংশ কেউ ছাড়বেই না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ‘ভাগ’ থেকে পল্লবিত ‘বিভাগীয়’ শব্দ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের গুরুত্ব কত বেশি! প্রশাসনিক বিভাগ নিয়ে প্রতিবেদন যেমন ‘বিভাগীয় প্রতিবেদন’, তেমনি কোনো একটি বিশেষ দপ্তর বা বিভাগের যদি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন হয়, তা-ও বিভাগীয় প্রতিবেদন; একইভাবে বিভাগীয় তদন্ত, বিভাগীয় শৃঙ্খলা-শাস্তি ইত্যাদিও আমাদের দেশে এবং সমাজে প্রচলিত আছে দীর্ঘদিন; তাহলে আজ কেন ‘বিভাগীয়’ শব্দটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো? সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে চাইব আজকের প্রতিবেদনে।

হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি কখনো স্বশাসিত হওয়ার স্বপ্নও দেখেনি। যুগে যুগে কালে কালে বাঙালি পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি থেকেছে, নির্যাতিত শোষিত বঞ্চিত হয়েছে বাঙালি। কখনো করম শাহ, তিতুমীর, হাজী শরিয়তউল্লাহ, ফকির মজনু শাহ, টিপু পাগলারা স্বাধীনতার কথা বললেও জনমনে সেসব স্বপ্ন হয়ে উঠেনি। কোথাও কোথাও স্ফুলিঙ্গ দেখা গেলেও আলোকিত হয়নি বঙ্গ-জনপদ। শাসনের প্রয়োজনে প্রথমত মোগল এবং পরবর্তীকালে ইংরেজরাই ‘ভাগাভাগি’র কাজটা করেছে; সুতরাং বিভাগীয় কেন, অনেক আবশ্যিক শব্দ নিয়েই বাঙালির ভাবার অবকাশ হয়নি। দুশ বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭-এ আমরা যখন স্বাধীনতা পেলাম, তখন বাঙালি প্রাপ্তির আনন্দ উদযাপন করতে চেয়েছিল, কিন্তু ১৯৪৮-এ-ই বাঙালি টের পেয়ে গেল- ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়!’ ভারত বিভাগের কথা তুলে ‘বিভাগীয়’ শব্দের জটিলতা আরো বড় করে তুলতে চাই না।

‘বিভাগীয়’ শব্দটির মধ্যে একটা ‘গিরগিটি-স্বভাব’ লুকায়িত আছে। গিরগিটি-স্বভাব লুকায়িত আছে বলেই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শব্দটির অর্থ বদল হয়ে যায়। আমার তো কবিতা উদ্ধৃতি দেয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, ‘বিভাগীয়’ শব্দের তদন্ত প্রতিবেদন লিখতে গিয়েও মনে পড়ে যাচ্ছে জীবনানন্দ দাশের সেই কবিতাটি- অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া... (অদ্ভুত আঁধার এক// জীবনানন্দ দাশ)

বিভাগীয় শব্দটির অর্থ যেমন বদলে যাবার প্রবণতা আছে, তেমনি শব্দটির অপপ্রয়োগ করে ঘোলাজলে মৎস্য শিকারের প্রবণতাও কম দেখা যাচ্ছে না। সামান্য ‘বিভাগীয়’ শব্দের অপব্যবহার করে আমাদের সমাজে কত যে অজাচার হচ্ছে তার হিসাব কি আমরা রাখছি সবসময়? না-কি আমাদের সামনে এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে, যা দেখিয়ে আমরা বলতে পারি; শব্দের অপপ্রয়োগ রোধ করে সমাজকে অনাচার-দুরাচার-অজাচার মুক্ত রাখতে একটিও পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে! বিভাগীয় শব্দটির অপব্যবহারে সামাজিক দুরাচার এখনো মহামারির রূপ লাভ করেনি; এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও মিথ্যে নয়, মহামারির রূপ নেয়ার আগেই প্রবণতা প্রতিরোধ করা বুদ্ধিমানের কাজ।

শক্তি-সাহস-ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু প্রশাসন; সুতরাং ক্ষমতার প্রশ্নে প্রশাসনিক বিভাগের গুরুত্ব সবসময়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে আমাদের দেশে প্রশাসনিক বিভাগ ছিল চারটি, ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী-খুলনা; স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরো চারটি বিভাগ, সিলেট-বরিশাল-রংপুর ও ময়মনসিংহ; সম্ভবত আরো দুয়েকটি পুরনো জেলা বিভাগ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। নতুন বিভাগ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন বিভাগীয় দপ্তর-প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় চলে।

নতুন একটি প্রশাসনিক বিভাগ চালু হলে, প্রতিষ্ঠিত হবে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়, প্রতিষ্ঠিত হয় বিভিন্ন কার্যক্রমের বিভাগীয় শাখা; সেসব শাখার মাধ্যমে চলবে সরকারের নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম। মাঠ পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যায়ে শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের জন্য যেখানে প্রয়োজন সেখানে ‘বিভাগীয়’ আয়োজন নিশ্চয়ই করতে হবে; কিন্তু যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে কেন ‘বিভাগীয়’ শব্দের অপপ্রয়োগ; না-কি ‘বিভাগীয়’ শব্দটি ব্যবহার করে মানুষকে ভড়কে দেয়ার কৌশল? আবশ্যিকতা হয়নি, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো বিভাগীয় কমিটি গঠিত হয়নি কোনোদিন। কিন্তু কিছু কিছু সংগঠন-মোর্চা-প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামের সঙ্গে ‘বিভাগীয়’ শব্দটি যুক্ত করে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে; কোনো কোনোটি আবার ঘোলা পানিতে মাছ শিকারও করতে সচেষ্ট আছে।

ধরা যাক, ডিভিশনাল ব্লাড সোসাইটি, ডিভিশনাল স্কুল এন্ড কলেজ, বিভাগীয় সাহিত্য সংসদ, বিভাগীয় প্রেস ক্লাব, বিভাগীয় চারুশিল্পী পর্ষদ, বিভাগীয় অনলাইন লেখক ফোরাম ইত্যাদি। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপেরও জেলা ও বিভাগীয় শাখা প্রতিষ্ঠার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে ইদানীং। ফেসবুকীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না, কারণ ফেসবুক হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেপরোয়া-স্বাধীন উঠোন। যা হোক ‘বিভাগীয়’ শব্দের অপপ্রয়োগ দিন দিন বাড়ছে। কেউ বুঝে অথবা না বুঝেও কেউ এসব ভ্রান্তির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে! এ ধরনের সংগঠনের অস্তিত্ব কেন? তারা বিভাগীয় কোন দায়টি মাথায় নিয়ে আছে? আর এসব সবই তো বিভাগীয় শহরে গজিয়ে উঠছে, বিশেষ করে নবগঠিত বিভাগগুলোতে। এ অনাচার-অশিষ্টতা দেখার কি কেউ নেই? জেলা প্রশাসন অথবা বিভাগীয় কমিশনাররা? না-কি বঙ্গীয় এ বদ্বীপ ভূমি ‘মগেরমুলুক’-এর যে কলঙ্ক ধারণ করে আছে, সে কলঙ্ক নিয়েই থাকবে? আবার দেখি, সরকারি উদ্যোগে বিভাগীয় বইমেলা, অথবা বিভাগীয় ভাটিয়ালি উৎসব হচ্ছে, কিন্তু বিভাগের ন্যূনতম প্রভাব তো লক্ষ করা যায়নি সেখানে! তবে কেন ‘বিভাগীয়’ শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্তিতে রাখার এ সব অপকৌশল? আমাদের কি বোধোদয় হবে না, সাধারণের অথবা প্রশাসনের?

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও প্রাবন্ধিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App