×

জাতীয়

দুই সিটির বর্জ্য বাণিজ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৩৬ এএম

দুই সিটির বর্জ্য বাণিজ্য

ফাইল ছবি

ময়লা বাণিজ্যে কাউন্সিলররা নাগরিক সেবায় অবহেলার অভিযোগ

বর্জ্য বাণিজ্যে নেমেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপণার জন্য হোল্ডিং ট্যাক্সে দেয়া ২৫ শতাংশের সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন রাজধানীর বাড়ির মালিকরা। এই সুযোগে গৃহস্থালি বর্জ্য সরিয়ে নিতে গড়ে উঠেছে বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংস্থা, যারা নির্ধারিত ফির বিনিময়ে বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিন বর্জ্য নিয়ে যায়। প্রথম দিকে বর্জ্য সংগ্রহের ফি ২০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার নামে ৫ থেকে ১০ গুণ খরচ বাড়ানো হয়েছে। এতে জিম্মি হয়েছেন নগরবাসী। বাড়তি টাকা দিতে কেউ আপত্তি জানালেই বর্জ্য ফেলে রাখা হচ্ছে। কখনো দুর্ব্যবহারও করা হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) দরপত্রের মাধ্যমে নিজেরাই বর্জ্য বাণিজ্যে জড়িয়ে গেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এভাবেই বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর হাতছাড়া হয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারীদের দখলে চলে গেছে কোটি টাকার এ বাণিজ্য।

ঢাকার বাসাবাড়ি ও রেস্তোরায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এসব বর্জ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। বেসরকারিভাবে বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে (পিডব্লিউসিএসপি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহযোগী সংগঠন হিসেবে সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত আছে।  দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে হোল্ডিং রয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫টি। অধিকাংশ হোল্ডিংয়ে ৬ থেকে ১২টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। একটি হোল্ডিংয়ে গড়ে ৬টি ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। আর প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। এই হিসাবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ৩৬ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে, বছরে যা প্রায় ৪৩২ কোটি টাকা। আর সাত হাজার রেস্তোরাঁ থেকে মাসে আদায় হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।

আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলার পাত্রের ব্যবস্থা করবে। সেখানে পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর ও জায়গা-জমির দখলদাররা তাদের ময়লা বা আবর্জনা ফেলবে। সিটি করপোরেশন নির্ধারিত ওই স্থান থেকে ময়লা সংগ্রহ করে ভাগাড়ে নিয়ে যাবে। আর নাগরিকরা তাদের বাসাবাড়ির বর্জ্য করপোরেশনের নির্ধারিত বিনে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু বর্তমানে বাসাবাড়ির বর্জ্য কোনো নাগরিকই সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে দেয় না। এই সুযোগে গত ১৮ বছর ধরে বিভিন্ন ওয়ার্ডভিত্তিক সংগঠন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে করপোরেশনের নির্ধারিত বিনে পৌঁছে দিচ্ছে। এজন্য প্রতিটি বাসা বা হোল্ডিং থেকে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

ডিএসসিসি তাদের ৭৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭৪টির্তেই একটি করে প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিসিএসপি) নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিটি পিসিএসপিকে প্রতিমাসে এক লাখ টাকা করে বছরে ১২ লাখ টাকা সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ডিএসসিসির আয় হবে ৯ কোটি টাকা। জনসংখ্যা গড় হিসেবে ডিএসসিসির প্রায় ২৪ লাখ পরিবার ময়লার বিল দিচ্ছে। পরিবারপ্রতি একশ টাক হিসেবে মাসে আসে ২৪ কোটি টাকা। আর বছর শেষে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮৮ কোটি টাকা। এছাড়া রয়েছে কয়েক হাজার রেস্তোরাঁ ও দোকানের বিল।

পিসিএসপির কাজের বিষয়ে ডিএসসিসির মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেন, নতুন আঙ্গিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট হারে আমরা মাসিক চার্জ নির্ধারণ করেছি। কোথাও এই হারে ব্যত্যয় করা যাবে না। কোনো পিসিএসপি বাসাবাড়ি থেকে ১০০ টাকার বেশি চার্জ নিতে পারবে না। ডিএসসিসির মতো ডিএনসিসিও তাদের এলাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা টেন্ডারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংস্থাটির পুরনো ওয়ার্ডগুলোতে কর্মরত পিসিএসপির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়ায় আপাতত নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে।

সূত্র জানায়, পুরো বিষয়টি একটি নীতিমালার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে শৃঙ্খলা ও রাজস্ব আয় বাড়াতে এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ময়লা নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীসহ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। এই বিষয়টিকে গুছিয়ে আনতে চাই। এজন্য বর্জ্য সংগ্রহের ফি নির্ধারন করে নীতিমালা করবো। পুরো কাজটি আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে করা হবে।

এদিকে সিটি কপোরেশনে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, বাসা থেকে ময়লা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেয়ার দায়িত্ব সিটি কপোরেশনের। কিন্তু ঠিকাদারের মাধ্যমে এটা করায় ময়লা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

জিম্মি করে টাকা আদায় : কয়েকটি ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় নেতারা তাদের ইচ্ছামতো ফি নির্ধারণ করেন। এলাকা ভেদে বাসাপ্রতি ১৫০-৩০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। গুলশান, বনানী, ধানমণ্ডিতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকাও আদায় করছেন। আবার একই পাড়া, মহল্লায় কিংবা একই বাসাবাড়িতে একজনের বিলের টাকার পরিমাণের সঙ্গে অন্যজনের বিলের পার্থক্য রয়েছে। নিধারিত ফি সম্পর্কে কেউ আপত্তি তুললেই তার বাসা থেকে ময়লা নেয়া হয় না।

বাসাবো কদমতলার বাসিন্দা মুজিবুর রহমান বলেন, আমার বাসা থেকে ময়লার বিল প্রতি মাসে ৩০০ টাকা নেয়া হয়। যেটা ঈদের আগে ছিল ২৫০ টাকা। তারপরও সপ্তাহে ২ দিন ময়লা নিতে আসে না। ঘরের ভেতর ময়লা পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এ নিয়ে কাউকে কিছু বলারও সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন কমিটির সদস্য সচিব ইকবাল হাবিব বলেন, রাজধানীতে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্জ্য সংগ্রহের এই ব্যবস্থাপনাকে আত্তীকরণ করতে হবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাউন্সিলরদের কাজে লাগিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

বর্জ্য সংগ্রহকারীদের কোথাও বেতন আছে, কোথাও নেই : অভিযোগ রয়েছে, বর্জ্য সংগ্রহের মূল দায়িত্বে থাকা পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। ময়লার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভ্যানগাড়িতে ময়লা সংগ্রহকারীদের নামমাত্র মাসিক বেতন দেন। আবার কোথাও বেতন নেই। সংগ্রহ করা ময়লা থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য আলাদা করে বিক্রি করাই মূলত তাদের আয়ের উৎস।

৯ বছর ধরে মিরপুর ৬ নম্বরে বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করেন শরিফ। ময়লা সংগ্রহের কাজ করে কোনো বেতন পান না। ময়লা থেকে বেছে রাখা জিনিসপত্র ভাঙারির দোকানে বিক্রি করেন। মাসে ভাঙারি বিক্রি করে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান। তিনি জানান, মালিকরা আলাদা লোকের মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে টাকা নেন। সুরক্ষাসামগ্রী থেকে শুরু করে বর্জ্যরে কাজ করতে তাদের কোনো যন্ত্রপাতিও দেয়া হয় না।

রেস্তোরাঁর মালিকরা দিচ্ছেন ২ থেকে ৪ হাজার টাকা : ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে (বনানী, গুলশান-১ ও ২, গুলশান সুইপার কলোনি ও কড়াইল) বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করে ৩৭টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি বাসা থেকে কমপক্ষে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন স্থানীয় কাউন্সিলর ও তার অনুসারীরা। এসব অভিজাত এলাকায় বর্জ্য ফেলার জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়েই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বর্জ্য পরিষ্কার করাতে হচ্ছে। এখানকার রেস্তোরাঁগুলোকে বর্জ্য বিল বাবদ মাসে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়।

ময়লা বাণিজ্যে কাউন্সিলরদের আধিপত্য : জনপ্রতিনিধি হলেও দুই সিটির একাধিক কাউন্সিলর বর্জ্য সংগ্রহের জন্য নিজেরা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন। সেখানে তারা নিজের লোকজনের মধ্যে ওয়ার্ডগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। তাদের বাইরে কেউ বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারেন না। শুধু তাই নয়, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের ভ্যান সার্ভিস দখল করে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে ডিএনসিসির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

কর্মহীন পিডব্লিউসিএসপির সাড়ে ৪ হাজার কর্মী : বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শুরু থেকেই করপোরেশনের নিজস্ব কর্মীদের পাশাপাশি বাসাবাড়ি থেকে ভ্যান সার্ভিসের মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এর মধ্যে ২০০০ সাল থেকে পিডব্লিউসিএসপি সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিয়েই কাজ করছে। এজন্য প্রতি বাড়ি থেকে মাসে ৩০ টাকা করে আদায়ের অনুমতি দেয় ডিএনসিসি। এই অর্থ দিয়ে কর্মীদের বেতন ও ভ্যান সার্ভিসের অন্যান্য খরচ বহন করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি সেই নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে ডিএনসিসি। কাউন্সিলরদের স্বার্থেই এমনটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। তারা বলছেন, অনেক ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের লোকেরা তাদের ময়লা সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে ভ্যান সার্ভিসের সাড়ে চার হাজার কর্মী বেকার হচ্ছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App