×

সাহিত্য

‘এনজিওর ঋণে জীবনকে কতদূর টেনে নেয়া যাবে’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ১০:০৪ এএম

‘এনজিওর ঋণে জীবনকে কতদূর টেনে নেয়া যাবে’

শিল্পকলার মঞ্চে গৌড়ীয় নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পীরা -ফাইল ছবি

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড- ২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে বাগেরহাটের অবস্থান। এই জেলার সমৃদ্ধির ইতিহাস উপমহাদেশের বহু প্রাচীন জনপদের সমকালীন ও সমপর্যায়ের। শিল্প সংস্কৃতিতেও এই অঞ্চল বেশ সমৃদ্ধ। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯) বাংলার শাসক থাকাবস্থায় খানজাহান আলি এই অঞ্চলের নাম রাখেন ‘খলিফাত-ই-আবাদ’। এর অর্থ প্রতিনিধির অঞ্চল। জনশ্রুতি আছে, তার একটি বাগ ছিল। শব্দটির অর্থ বাগান বা বাগিচা। এই বাগ থেকে এসেছে বাগেরহাট। কেউ কেউ মনে করেন, বরিশালের শাসক আগা বাকেরের নামানুসারে ‘বাগেরহাট’ নামকরণ হয়েছে। কেউ বা বলেন, পাঠান জায়গিদার বাকির খাঁর নামানুসারে বাগেরহাট শব্দের উৎপত্তি। কারও মতে, বাগেরহাটের নিকটবর্তী সুন্দরবন থাকায় বাঘের উপদ্রব ছিল। এজন্য এর নাম হয়েছিল ‘বাঘেরহাট’। ক্রমে তা ‘বাগেরহাট’ রূপ নিয়েছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতো হচ্ছে, শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদীর উত্তর দিকের হাঁড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত লম্বা বাঁক অবস্থিত। ওই বাঁকের পুরাতন বাজার এলাকায় একটি হাট বসত। তাই স্থানটির নাম রাখা হয় বাঁকেরহাট। কালক্রমে তা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের বাগেরহাট। বাগেরহাটের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো হলো ষাটগম্বুজ মসজিদ, হজরত খানজাহান আলির মাজার, খাঞ্জেলি দিঘি, চন্দ্রমহল, সিংগাইর মসজিদ, নয়গম্বুজ মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি, জিন্দাপির মসজিদ, অযোধ্যা মঠ, বাগেরহাট জাদুঘর, পৌর শিশুপার্ক, সুন্দরবন রিসোর্ট পার্ক, চাঁদপাই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ধাংমারি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সমৃদ্ধির ইতিহাসপ্রাচীন এই জনপদও করোনায় হানায় স্থবির। থমকে আছে এর শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

সূত্র জানায়, জেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় আশির কাছাকাছি। সংস্কৃতিকর্মী প্রায় দেড় হাজার। এদের মধ্যে অনেকে নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত। যারা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান করেই সংসার চালান। করোনাকালে তারা সবাই বেকার হয়ে গেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পক্ষ থেকে মাত্র ১০০ জনকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে। অনেকে রয়েছেন পাইপলাইনে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনার ধাক্কায় বাগেরহাটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও স্থবির হয়ে আছে। যা এখনো অপরিবর্তিত। অধিকাংশ শিল্পীরই জীবন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ মাস্ক বিক্রি করছে, কেউ বা অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি আঙিনার গাছ বিক্রি করছেন। অবিলম্বে সহায়তাবঞ্চিত শিল্পীদের সহযোগিতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে, ৪৫ বছর ধরে সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত সংগীতশিল্পী ও প্রশিক্ষক প্রদীপ কুমার দাস ভোরের কাগজকে বলেন, সংগীতই আমার আয়ের একমাত্র উৎস। দীর্ঘ ৮ মাস ধরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় আয়ের পথও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে জমানো টাকা ভেঙে চলছি। প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো খরচ করে ফেলেছি। জানি না সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে।

বিশিষ্ট এই সাংস্কৃতিক সংগঠক আরো বলেন, অনেকে নিরুপায় হয়ে পেটের দায়ে মাস্ক বিক্রি করছে, অটো চালাচ্ছে, এমনকি বাড়ির আঙিনার গাছও বিক্রি করে ফেলছে। অনেকে এনজিও থেকে ঋণ নিয়েও টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ সরকারি প্রণোদনা পেয়েছে বটে। কিন্তু তা দিয়ে জীবনকে কতদূরইবা টেনে নেয়া যাবে? এ পরিস্থিতিতে সরকারকেই প্রণোদনা সহায়তা অব্যাহত রেখে শিল্পীদের পাশে থাকতে হবে।

অঙ্কুর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মীর ফজল সাঈদ ডাবলু বললেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানা সহায়তার পরও কষ্টে আছে শিল্পীরা। এই নাজুক পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিল্পীদের প্রণোদনা সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানাচ্ছি।

শিল্পী ও প্রশিক্ষক অঞ্জন দাস বলেন, ৪৩ বছর ধরে সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে এ অঙ্গনে আছি। এটাই আমার প্রধান আয়ের উৎস। করোনার আঘাতে এখন আমি কীভাবে বেঁচে আছি বলে বোঝাতে পারব না। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। না মরতে পেরে বেঁচে আছি! বাসা ভাড়া জমে গেছে প্রায় ৫ মাসের। এ পরিস্থিতিতে সরকারের সাহায্য ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব।

শিল্পী শাওন বিশ্বাস বলেন, আমার প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে সংগীত। বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়ে সংসার চলে। বিশেষ করে সরকারি বেসরকারি প্রোগ্রামগুলো। কিন্তু লকডাউনের পর থেকেই আয়ের পথটা বন্ধ হয়ে গেছে। জীবন এখন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। মানসিক শক্তি আর মনোবল দুটোই ভেঙে যাচ্ছে। জীবনটাই থমকে আছে!

শাওন বিশ্বাসের মতোই দলছুট সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রচার সম্পাদক শিবজিৎ নন্দী শুভর কণ্ঠেও হতাশার সুর। তিনি বললেন, ৮ মাস ধরে বিপদে আছি। শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে ৩ মাস আগে নাম ঠিকানা নিয়ে গেছে। এরপর থেকে আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। কিন্তু কোনো সহায়তা পেলাম না।

বেহারা সম্প্রদায়ের শিল্পী সঞ্জয় দাশ হৃদয়ের কণ্ঠেও হৃদয় ভাঙা আর্তনাদ। তিনি বললেন, আমরা আদিবাসীরা এমনিতেই অবহেলার শিকার। ৩ মাস আগে নাম ঠিকানা নেয়া হলেও কোনো সহায়তা পাইনি। আশায় জগৎ বয়ে যাচ্ছে!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App