×

অর্থনীতি

বাজার মনিটরিং নামেমাত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৯ এএম

বাজার মনিটরিং নামেমাত্র

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। টিসিবির ট্রাকের সামনে তাই স্বল্পমূল্যের পণ্যের জন্য ক্রেতাদের ভিড়। ছবি: ভোরের কাগজ

প্রতি বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বাজার মনিটরিং টিম গঠন করা হলেও কার্যত এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। বাজারে কোনো পণ্যের সামান্য ঘাটতি দেখা দিলেই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেট প্রবণতার কারণে চরম বিপাকে পড়ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। দৈনন্দিন ভিত্তিতে মনিটরিং না হওয়ায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেই কারো কাছে। তাছাড়া আগাম তথ্য না থাকায় বাজারে তৈরি হয়েছে ভারসাম্যহীনতা। যার কারণে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় অভিযান চালালেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযানের পর উল্টো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা। এতে আরো বেড়ে যাচ্ছে পণ্যমূল্য। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাজার মনিটরিংয়ের জন্য দুই দফা ১৪টি কমিটি করা হয়। উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রতিটি কমিটির ৬ মাস করে বাজারে মনিটরিং করার কথা। প্রতিটি কমিটিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা সিটি করপোরেশন, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি থাকেন। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এই টিমগুলো বছরের অধিকাংশ সময় নিষ্ক্রিয় থাকে। বাজারের জরুরি খাদ্যপণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও মজুত কী পরিমাণে রয়েছে তার দৈনন্দিন তথ্য সরবরাহেও রয়েছে ঘাটতি। যার কারণে বাজারে তৈরি হয় ভারসাম্যহীনতা। এসব কারণে সরকারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টার ফল ভোগ করতে পারছেন না ভোক্তারা। বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়ে কথা হয় দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আসলে প্রতিদিনের বাজারের আগাম তথ্য সরবরাহে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া মনিটরিং কমিটির জনবল ঘাটতিও রয়েছে। যার কারণে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাজার দৈনিক ভিত্তিতে মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো পণ্যের মজুত ঠিক পরিমাণে আছে কিনা, উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে কিনা, এই পণ্য আমদানিনির্ভর কিনা, সামনে সংকট পড়ার আশঙ্কা রয়েছে কিনা পণ্যের এসব আগাম তথ্য ঠিকমতো সরবরাহ না হওয়ার কারণে বাজারে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া বাজারে সরবরাহজনিত, উৎপাদনজনিত বা মজুতজনিত যে তারতম্য রয়েছে, সেসব তথ্য ঠিকমতো সরবরাহ করা হচ্ছে না। চালের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অন্যান্য জরুরি পণ্যের ক্ষেত্রে হচ্ছে না। এই কারণে বাজারে কখনো উদ্বৃত্ত তৈরি হচ্ছে, কখনো ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। এতে কখনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন, কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারে কোনো পণ্যের নামমাত্র ঘাটতি দেখা দিলে এর সর্বোচ্চ সুযোগ নেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। চাল-ডাল থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজ, সর্বশেষ আলুর দাম রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিযান করার পর হিতে বিপরীত হয়। পেঁয়াজের দাম রাতারাতি দিগুণ হওয়ার পর সারাদেশে একযোগে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। এর পরের দিনই বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ কমে যায়। দেশের কোনো কোনো আড়তে দেখা মেলেনি পেঁয়াজের। কদিন ধরে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য অভিযান পরিচালনার পর এখন রাজধানীর পাইকারি বাজারে মিলছে না আলু। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে তাই বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। অভিযানের কারণে ফড়িয়ারা বাজারে আলু সরবরাহ করছেন না। সরকারের বেধে দেয়া নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি করছেন না কোনো ব্যবসায়ী। এর আগে হুট করে আলুর দাম ৫০ টাকায় বিক্রি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি কেজি আলুর দাম ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সরকারের এই নির্দেশনা মানেননি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। গতকাল মঙ্গলবার বাধ্য হয়ে আলুর দাম বাড়িয়ে ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আসলে বাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এদের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আর বাজারের বিভিন্ন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের হাতে। এই কারণে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা কিছুটা নড়বড়ে। চালের ক্ষেত্রে যে অভিযোগ রয়েছে, বড় মিলাররা চালের সিন্ডিকেট তৈরি করে থাকেন। তাই মিলারদের অনুমতি না দিয়ে সরকারেরই চাল আমদানি করা উচিত। আলুর বিষয়ে ক্যাব চেয়ারম্যান বলেন, সব খাতে অতি মুনাফালোভীরা সক্রিয় রয়েছে। এদের দেখে আলু ব্যবসায়ীরাও এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে সরকারের উচিত যারা নতুন সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। তারা চাইলেই বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আলুর কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি তারা। এই পরিস্থিতি শুধু আলুর ক্ষেত্রেই নয়, ২৫-৩০ টাকার পেঁয়াজ এখন ১০০ টাকা কেজিতে কিনে খাচ্ছেন ভোক্তারা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ভালো মানের মিনিকেট চাল ৬০-৬২, মাঝারি মানের মিনিকেট চাল ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দামও। বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০০-১০৫ টাকা লিটারে। গুঁড়োদুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ২৫-৩০ টাকা। কেজিতে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত। বাজারে মূল্য বাড়ানোর হিড়িক চলছে। কোনো অজুহাত পেলেই ভোক্তার পকেট কাটা শুরু করে দেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কনসাস কনজুমার সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ ভোরের কাগজকে বলেন, বাজার মনিটরিং হয় আসলে কাগজে-কলমে। এ জন্য কমিটি আছে, কিন্তু কার্যক্রম নেই। কোনো পণ্যের মজুত থেকে শুরু করে ঘাটতির আগাম তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। কিন্তু এসবের কোনো বালাই নেই। বাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখন হুড়মুড়িয়ে বের হয় নানা কমিটি। শুরু হয় দেশব্যাপী অভিযান। এরই ফাঁকে মুনাফা লুটে নেয় অতি মুনাফালোভীরা। যত দিনে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসে ততদিনে ভোক্তার পকেট কাটার কার্যক্রম প্রায় শেষ হয়ে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App