×

মুক্তচিন্তা

দূরত্ব কমাতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৮ পিএম

করোনাযুদ্ধের এই পর্যায়ে দেশে দেশে মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বাড়াবার চেষ্টা চলছে। কয়েক মাস স্থবির হয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায় জীবন ও জীবিকা সমন্বয় সাধনের অনিবার্যতা উপস্থিত। কিন্তু পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী না বাড়ায় সরবরাহে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে। প্রতীকী উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইলিশের সংগ্রহে ভাটা সত্ত্বেও একদিকে ইলিশ রপ্তানির প্রয়াস যেমন চলেছে অন্যদিকে বর্ধিত চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন বা ধরার উদ্যোগে ভাটা পড়ায় ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে মুখরোচক সংবাদ শিরোনামে পরিণত হতে পারে। যত দাম হাঁকা হোক না কেন প্রতিযোগিতা করেই যেন কেউ কেউ ইলিশ কিনেছেন ভাবখানা এই ইলিশ না হলেই যেন চলে না। চড়া দামে ইলিশ কেনার মানুষ আছে বলেই ইলিশের চড়া দাম হাঁকার অবকাশ তৈরি হয়েছে। সরবরাহ ও চাহিদার এই মহামহিম দূরত্বের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীরও দাম হু হু করে বাড়ে, চড়া আকাশচুম্বী দাম হাঁকা হয়ে থাকে। এই অবস্থায় সমাজে আর্থিক বৈষম্যের বিবর আরো বেদনাদায়কভাবে উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতির চালচিত্র, এর আবহমান সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর পরিবেশে ভেদাভেদ ভুলে পুরনো দিনের বেদনা ও বৈষম্যের জঞ্জাল সরিয়ে নতুন দিনের আলো অবগাহনের মতো গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও পরিতৃপ্তিকে উপভোগ করার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে চলেছে কতিপয় পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির, ধর্ষণ ও প্রতারণা, সামাজিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির মতো বিষয়ের এই অতি অস্বাভাবিক আচরণে। প্রভ‚ত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও পটভূমিতে আজ এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে দূরত্ব বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সঙ্গে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উৎপাদনকারীর সঙ্গে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সঙ্গে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, ব্যয় সংকোচন কৃচ্ছ্র সাধন পরিবেশেও বলগাহীন ব্যয়ের, সদাচার, সামাজিক ন্যায়নীতি নির্ভরতার সঙ্গে অসদাচার ও নীতিহীনতার, সুশৃঙ্খলা বোধের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খতার, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের। সামষ্টিক অর্থনীতিতে চড়া সুদ ও কড়া শর্তের ঋণের টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুসের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্য বিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এই অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষার পাসের হার এবং পার ক্যাপিটাল জিডিপি বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তি লাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে ভূত-ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয় সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী যেখানে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু, সেখানে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতিকে আপাতত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসার অজুহাত অবয়বে নিরুৎসাহিত করা চলে না। সেগুলো ক্রমশ নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এই প্রগলভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগুচ্ছে না পিছাচ্ছে তার একটা সালতামামি ও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন। মূলত এবং মুখ্যত নব্বইয়ের দশকেই বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণে ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা শুরু। ১৯৯১-এর শুরুতে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশে ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির নবযাত্রা শুরু হয় সেখান থেকেই। প্রথম বছরেই মূল্য সংযোজন কর আইন পাস ও প্রবর্তিত হয়। বিরানব্বই সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লোকবল ও কর্মকাঠামোয় প্রথম সম্প্রসারণ ও সংস্কার আনা হয়। সে সময় বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যম নতুন উদ্যোগ সংযোজিত হওয়ায় অর্থনৈতিক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে, এ দশকেই তিনবার (১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯) ঘোষিত হয় সংশোধিত শিল্প নীতি। ১৯৯৩ সালে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন, প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, সাউথ এশিয়ান প্রিফারেনসিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং ফাইন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট পাস হয়। ১৯৯৪ সালে প্রথম সেলুলার ফোন পদ্ধতি চালু, ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন প্রথম সংশোধন, টাকাকে চলতি হিসাবে লেনদেনের জন্য রূপান্তরযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ৮নং আর্টিকেলের মর্যাদা লাভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আইন ও বিধিমালা জারি হয়। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশরাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ (আইসিসিবি) গঠিত হয় এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাওয়ার সেল গঠন, বিধিমালা জারি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট এক্সপার্ট প্রসেসিং জোন আইন পাস, প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি ঘোষণা। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি নিয়ম পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায় উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। মূসক আইন প্রবর্তনসহ কয়েকটি রেগুলটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় ও সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। প্রসঙ্গত যে তখন পর্যন্ত শুধু আমদানি শুল্কই ছিল রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও বিপণন এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্পূরকসহ শুল্ক হিসাবায়ন ও আদায় অভিযাত্রায় একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয় এবং উঠে আসে ভোক্তা কর্তৃক প্রদত্ত পরোক্ষ (পণ্য ও সেবা) কর হিসাব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধির তাগিদ। তবে প্রথমদিকে এ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে এবং করদাতা ও আহরণকারী উভয় পক্ষের মধ্যে নানা অনুযোগ অজুহাতে এক ধরনের ‘সময় নেয়ার’ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অর্থনীতি যখন সবে বড় হওয়া শুরু সে সময় নতুন ভ্যাট আইন হঠাৎ করে কিছুটা হলেও গোলকধাঁধার পরিবেশ সৃষ্টির দ্যোতক হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে এর গ্রহণ ও প্রয়োগ যোগ্যতায় আনা হয় সংস্কার। ২০১২ সালে (কথিত) নতুন ভ্যাট আইনটি পার্লামেন্টে নতুন মোড়কে পাস করা হলেও ১৯৯১ সালের মতো ব্যবসায়ীদের অব্যাহত অনুযোগ অজুহাত এবং যা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দীর্ঘসূত্রতায়, সর্বোপরি এ আইন বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপ্রতুলতায় এটি প্রবর্তিত হতে পারেনি বিগত ৯ বছরেও। বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে একটি স্বয়ংক্রিয় ও যুক্তিযুক্ত ভিত্তি প্রক্রিয়ার ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গঠনমূলক বেশকিছু উদ্যোগ গৃহীত হলেও পরবর্তীকালে সেসব প্রয়াস প্রচেষ্টায় যথাযথ ফলোআপ ছিল না। ফলে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে রাজস্ব আহরণ আওতায় আনতে শুধু বেগ পেতেই হয়নি বা হচ্ছে না এখানে বেশকিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিও অনুপ্রবেশ করে। শুল্ক হার নিরূপণ নির্ধারণে ট্যারিফ কমিশনের তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি সরবরাহের প্রশ্নে এনবিআরের সঙ্গে ট্যারিফ কমিশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বেড়ে যায়, যোগাযোগ হ্রাস পায়। আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ ও শুল্কায়নের স্বার্থে প্রাক-জাহাজীকরণ ইনসপেকশন পদ্ধতির প্রতি ঝুঁকে পড়ে শুল্ক বিভাগ। এখানে বিদেশি ভেন্ডরদের বাংলাদেশে এই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও অনিয়ম এখানে যুগলবন্দি হয়ে ওঠে। পিএসআই কোম্পানিগুলোর দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির মহড়া দেখা যায়। এনবিআরের লোকবল ও কর্মপদ্ধতির উন্নয়ন অভীপ্সায় বিশেষ করে ভ্যালুয়েশন এবং শুল্কায়নে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ডিএফআইডির অর্থায়নে কয়েকটি গুচ্ছ প্রকল্প [যেমন কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মডার্নাইজেশন বা ক্যাম; এক্সাইজ, কাস্টমস, ট্যাক্সেশন (ইটাক) ডাটা কম্পিউটারাইজেশন] বাস্তবায়নের মহড়া শুরু হয়। এসব প্রকল্প মেয়াদান্তে শেষ হলেও তাদের রেখে যাওয়া সুপারিশ, প্রবর্তিত পদ্ধতি সফটওয়্যার প্রয়োগ বাস্তবায়ন ফলাবর্তনে সব সময় সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার লক্ষ্যে কয়েকটি কর্মসূচি ও স্ট্রাকচারাল রিফমর্স প্রোগ্রামের মধ্যে শর্ত (ট্রিগার) আরোপ করে তার বাস্তবায়নে চাপ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ অনুসরণে ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে। বিগত পাঁচ দশকে অনেক বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। কিন্তু সেসব উন্নয়ন ও সাফল্যকে টেকসই ও অর্থনীতিতে তার স্থায়ী অধিষ্ঠান ও অগ্রগতি সহগামী হতে বারবার হোঁচট খেয়েছে বা খাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। যার মুখ্য শনাক্তযোগ্য কারণ দূরত্ব পরস্পরের মধ্যে সেবক ও সেবাগ্রহীতার, চিন্তা-চেতনার, চাহিদা ও সরবরাহের, স্বপ্ন ও সত্যের, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির। ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App