×

শিক্ষা

টিউশন ফি আদায়ে মরিয়া স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৪৮ এএম

টিউশন ফি আদায়ে মরিয়া  স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ
টিউশন ফি আদায়ে মরিয়া  স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষ

টিউশন ফি মওকুফ করার দাবি

নীরব শিক্ষা মন্ত্রণালয়

দিশাহারা অভিভাবকরা

রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলিক্রস কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ভর্তি ফি ও তিন মাসের বেতন মিলিয়ে ১৮ হাজার ৫৫০ টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছেন এক অভিভাবক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অভিভাবক বলেন, বহু কষ্টে ওই টাকা জোগাড় করে কলেজে দিতে হয়েছে। টাকাটা না দিলে ওরা মেয়ের ভর্তি বাতিল করে দেবে বলে জানিয়েছিল। অথচ করোনার এই দুঃসময়ে কী কষ্টে আছি বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

রাজধানীর আরেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ প্রথমে নোটিস দিয়ে বলেছে, দ্বাদশ শ্রেণির যে ছাত্রীরা গত আগস্ট মাসের বেতন দেননি তারা চলতি অক্টোবরের ১৭ তারিখের মধ্যে দেবেন। কিন্তু ১৭ অক্টোবর পেরিয়ে গেলেও বহু অভিভাবক বেতন দিতে পারেননি। এ অবস্থায় আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে বেতন দিতে বলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

মনিপুর স্কুল এন্ড কলেজ অভিভাবকদের মোবাইলে ‘জরুরি নোটিস’ নাম দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে বলেছে- প্রথম থেকে দশম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানো যাচ্ছে, আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে অনলাইনে হোমটেস্ট-২ এবং অনলাইন মডেল টেস্ট-১ অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ২০ অক্টোবরের মধ্যে পরীক্ষার ফিসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করে বেতন কাউন্টার থেকে সংশ্লিষ্ট অভিভাবককে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে হবে। টাকা না দিলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হবে না।

এ শুধু রাজধানীর সেরা তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র নয়, সারাদেশের প্রায় সব স্কুল-কলেজই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছ থেকে বেতন (টিউশন ফি) নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে। অথচ গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্যাম্পাসে ক্লাস, পরীক্ষা নেই। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চারদিকে দুঃসময়ের মধ্যে জীবনের পাশাপাশি জীবিকার জন্য লড়াই বাড়ছে। সংকুচিত হয়ে আসছে অনেকেরই নিয়মিত আয়ের উৎস। করোনার এ দুঃসময়ে যখন জীবিকাযুদ্ধ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে, তখন শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি জমা দিতে স্কুল-কলেজ থেকে মাত্রাতিরিক্ত চাপ দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ছেন অভিভাবকরা। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বেতন কোথাও সম্পূর্ণ কমাতে আবার কোথাও ৫০ ভাগ কমানোর দাবি অভিভাবকদের। কিন্তু পুরো ফি আদায়ে নিজেদের অবস্থানে অটল অধিকাংশ স্কুল-কলেজ। বিষয়টি নিয়ে কিছুই ভাবছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর অনলাইনে জুম মিটিংয়ে শিক্ষা বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, করোনাকালে টিউশন ফি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক, উভয়পক্ষকেই ছাড় দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, কোনো জায়গায় টিউশন ফির কারণে যেন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ না হয়ে যায়। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমাদের জানালে সমাধান করে দেব। ওই দিন সভায় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কঠোরতার বিষয়ে অভিভাবকদের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকরা। সবার জন্য একটি অংশ ছাড় দেয়ার প্রস্তাব করেন তারা। এর জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, করোনাকালে সবাই কিন্তু এক ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবার আয়ের ধরনও এক রকম নয়। সবার জন্য এক রকম করে দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোর চলার মতো হবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর চলার খরচ যেমন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রভৃতি রয়েছে। এর ফলে উভয়পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। তবে কোনো জায়গায় টিউশন ফির কারণে যেন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ না হয়ে যায়। সবমিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা এবং অভিভাবকদের বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়ে চলতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর পেরিয়ে গেছে কুড়ি দিন। কিন্তু এই কুড়ি দিনেও করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বেতন নেবে তার কোনো গাইডলাইন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে আছেন। ফলে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে ওইভাবে কোনো কাজও হচ্ছে না।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, চলমান দুঃসময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেবে তার গাইডলাইন কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করবেন। এ কারণে আমি আর নতুন করে কিছু বলছি না।

অভিভাবকরা বলেছেন, করোনার কারণে গত আট মাস ধরে বন্ধ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত খোলেনি। হচ্ছে না কোনো ক্লাস। তারপরও বেতন মওকুফ হচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এরকম পরিস্থিতিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন দিতে অভিভাবকদের চাপ দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো স্কুল থেকে এককালীন চাওয়া হচ্ছে, আবার কেউ কেউ ভেঙে ভেঙে দিতে বলেছেন। তাও দিতে হবে, কোনোভাবেই ছাড় নেই। দ্রব্যমূল্যের আগুনে মানুষ যখন পুড়ছে তখন স্কুল থেকে বেতনের জন্য চাপ দেয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

করোনার করাল গ্রাসে কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সরকার নানাভাবে প্রণোদনা দিয়েছে আর্থিক দুরবস্থার কারণে। এমনকি নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও দ্বিতীয়বারের মতো আর্থিক প্রণোদনা পাচ্ছেন। এখনো বহু মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে পারেনি। অসংখ্য লোক কোনোভাবেই টিকে আছে। এ অবস্থায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেতনের তাগাদা। কোনো রকম ক্লাস পরীক্ষা না নিয়েই তারা আট মাসের বেতনসহ অন্যান্য ফি আদায় করছে এক প্রকার গায়ের জোরে। মোবাইল ফোনে এসএমএস দিয়ে এবং ফোন করে চাওয়া হচ্ছে বেতনসহ অন্যান্য খরচাদি। এতে অসচ্ছল ও নিম্নআয়ের অভিভাবকরা অসহায় হয়ে পড়ছেন।

করোনা মহামারির কারণে আগামী সেমিস্টারে ৩০ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের দাবিতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে বিক্ষোভ করেছে একদল শিক্ষার্থী। গত রবিবার সকালে ক্যাম্পাসের গেটে জড়ো হয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। সকালে অবস্থান কর্মসূচির পর বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার সব গেট বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। ফি কমানোর বিষয়ে গতকাল সোমবার থেকে আলোচনায় বসেছে নর্থসাউথ কর্তৃপক্ষ।

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, টিউশন ফি আদায় করেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। খুব কম প্রতিষ্ঠানই আছে যাদের বছর শেষে টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। বর্তমান অবস্থায় টিউশন ফি পাওয়া যাচ্ছে না বলেই শিক্ষকদের বেতন দেয়া যাচ্ছে না। তবে যারা সচ্ছল অভিভাবক তারা যদি সবাই বেতন পরিশোধ করে দিতেন, তাহলে যারা সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় আছেন তাদের ব্যাপারে ভাবতে পারত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর মণিপুর স্কুলের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করেই আমাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। মধ্য অক্টোবর পেরোলেও এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারিনি। সাড়ে ৮শ’র ওপরে শিক্ষক কর্মচারী। শিক্ষার্থীরা না দিলে শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পাবে কি করে? এ জন্য আমরা বেতন-ভাতা চাচ্ছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App