×

মুক্তচিন্তা

পাকিস্তানকালের সরকারি দলিলপত্র উন্মুক্ত করা প্রয়োজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১০:০৩ পিএম

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তথ্য ভাণ্ডার সরকার কতটা উন্মুক্ত করবে জানি না, তবে পাকিস্তানের ২৩ বছরের গোয়েন্দা ফাইলগুলো দেশের গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া অতীব প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ওপর যেসব ফাইল উদ্ধার করা হয়েছে তার ফলে শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নয় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোটা রাজনীতির একটি বড় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস এখন অনেকটা উন্মোচিত হয়ে এসেছে।

পাকিস্তান আমলের রাজনীতিসহ গোটা ইতিহাস মৌলিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচনা কাজ আগে খুব বেশি এগোতে পারেনি। কারণ ২৩ বছরে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও রাজনীতির গভীর বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করার জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত গবেষকের গবেষণার জন্য প্রয়োজন ছিল সেগুলো অনেকেরই হাতের নাগালে ছিল না, জানাও ছিল না। ফলে পাকিস্তানকালের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্মৃতিকথা এবং স্মরণশক্তিনির্ভর ঘটনাবলির ওপর নির্ভর করে অনেকেই নানা ধরনের বইপুস্তক রচনা করেছেন। এগুলো মৌলিক গ্রন্থ হয়ে উঠেনি। তারপরও শিক্ষাব্যবস্থার সর্বত্র পাকিস্তানকালের রাজনীতির ইতিহাস পঠন-পাঠনে আমাদের অনেকবেশি নির্ভর করতে হয়েছিল ওইসব স্মৃতিকথা কিংবা সাধারণ বর্ণনামূলক বইপুস্তকের ওপর। ব্যতিক্রম যে কয়েকটি গবেষণামূলক গ্রন্থ দেশে বা বিদেশে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত অনেকটাই বিদেশের আর্কাইভ বা লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা। কিন্তু আমাদের দেশেই পাকিস্তানকালের সরকারি দলিলপত্র বিভিন্ন আর্কাইভে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। যার সন্ধান আমরা এখনো খুব একটা করেনি। বিশেষত্ব পাকিস্তান সরকারের এসবি পুলিশের গোপন প্রতিবেদন আমাদের পুলিশ দপ্তরগুলোতেই রয়েছে। এই দলিলপত্রগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি আগে অনেকেই জানতে পারেননি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ওপর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখন যে কোনো গবেষক এসব তথ্য ব্যবহার করে যেসব গবেষণা বা বইপুস্তক রচনা করবেন তারা অনায়াসে বুঝতে পারবেন যে আগে লেখা পাকিস্তানকালের ঘটনাবলির বইপুস্তক কতটা অসম্পূর্ণ তথ্যনির্ভর ছিল সেটি সহজেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

আমি ২০০০ সালে মোনায়েম সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ গ্রন্থটি রচনার জন্য আমন্ত্রিত হই। কিন্তু পাণ্ডুলিপি রচনার প্রস্তুতি দেখে সম্পাদক সাহেবকে অনুরোধ করি বঙ্গবন্ধুর ওপর যদি সত্যিই নতুন করে কিছু লিখতে হয় তাহলে পাকিস্তান আমলের পুলিশ ফাইলে যেসব তথ্য চাপা পড়ে আছে সেগুলো উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করুন। নতুবা বঙ্গবন্ধুর ওপর যা লেখা হচ্ছে এতে নতুনত্বের কিছুই সংযোজন করার আছে বলে মনে হয় না। সম্পাদক সাহেব আমার মতো নাছোড়বান্দার হাতে করে পুলিশ ফাইল উদ্ধারে ৬ মাস তৎপরতা চালিয়ে অবশেষে সফল হলেন। ওইসব ফাইলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা পুলিশ প্রতিদিন শেখ মুজিব কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কী বলছেন ইত্যাদি দিনলিপি বর্ণনা করে রেখেছেন। সেইসব ফাইল থেকে তথ্য নিয়েই ২০০৮ সালে দুই খণ্ডের উক্ত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি এর সঙ্গে আরো কিছু ফাইল যুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানকালের রাজনীতির অজানা অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত আমাদের জন্য এখন উন্মোচিত হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ হয়েছে যার ওপর ভিত্তি করে সেই সময়ের রাজনীতি এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমার ধারণা বঙ্গবন্ধুর ওপর এগুলোই সব তথ্য নয়। আরো তথ্য এখনো গোয়েন্দা পুলিশ দপ্তরে অন্যান্য ফাইলের মধ্যে রয়ে গেছে। পাকিস্তানকালে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে গোয়েন্দারা অনুসরণ করেছিল একইভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খানসহ সব বাঙালির রাজনীতিবিদ যারা তখন পাকিস্তান সরকার ও মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, গণতান্ত্রিক পার্টি ইত্যাদি নামে আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। তাদের সবাইকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী নজরদারিত্বে রেখেছিল। তবে গুরুত্বের দিক থেকে হয়তো শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের কাছে ২৩ বছরেই ‘পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন। সে কারণে তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তবে শেখ মুজিব সেইসময় যেসব রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাদেরও গোয়েন্দারা একেইভাবে অনুসরণ করত। সে কারণে এসবি গোয়েন্দা দপ্তরে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীসহ অন্য নেতাদের রাজনীতি ও কাজকর্ম নিয়ে পুলিশ ফাইল লেখা হতো। সেইসব ফাইলে ওইসব নেতার কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শেখ মুজিবের যোগাযোগ যাতায়াত, রাজনৈতিক শলাপরামর্শ, জনসভার ভাষণ ইত্যাদি নিয়ে আরো কিছু তথ্য ও বিবরণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেগুলো শেখ মুজিবের নামের মূল ফাইলে হয়তো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সে কারণে প্রয়োজন হচ্ছে সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্পর্কে পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশ যেসব পুলিশ ফাইল খুলেছিল সেগুলোর সব কপি উদ্ধার এবং উন্মুক্ত করে দেয়া। তাহলে আমরা সেই সময়ের পরিপূর্ণ তথ্য ভাণ্ডার হাতের কাছে পাব, যা পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস প্রকৃত তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধভাবে লেখা ও গবেষণা করা সম্ভব হতে পারে। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, মাওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সময় থেকে ১৯৫৭ সালে কাগমারি সম্মেলন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময়ের ফাইলগুলোতে মাওলানা ভাসানীকে একভাবে দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে। কাগমারি সম্মেলনের পর তিনি যখন নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন তখন থেকে তার ভ‚মিকা ভিন্নভাবে উপস্থাপনের দলিলপত্র পুলিশ ফাইলেই সংরক্ষিত থাকার কথা। বিশেষত ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পর থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তার ভ‚মিকা ভালোভাবে বুঝতে হলে সেই সময়ের গোপন দলিলপত্রের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাকিস্তানকালে অনেক রাজনীতিবিদেরই উত্থান-পতন আবার আঁকাবাঁকা পথে হাঁটার নজির রয়েছে। এগুলোর তথ্য-উপাত্ত সেই সময়ের গোয়েন্দা ফাইলেই রয়েছে। সুতরাং পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানতে হলে, দল ও নেতাদের ভ‚মিকা কখন কোন পর্যায়ে কতটা স্বাধীনতার পক্ষে, কাছাকাছি অথবা দূরে অবস্থান করছিল সেসব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে হলে পাকিস্তান সরকারের পুলিশের ফাইলগুলো বিশেষভাবে গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি গোপন দলিলপত্র (এসবি পুলিশ) ৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত দলিলপত্রগুলো অবশ্য ব্যতিক্রম, যা এর বাইরে রাখা হয়। আমাদের দেশে পাকিস্তানকালের সব দলিলই এখন উন্মুক্ত করে দেয়া জরুরি। এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্তত ৩০ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গোপন দলিলপত্র একইভাবে উন্মুক্ত করে দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া যেতে পারে। সেটি করা হলে রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যে তথ্য বিকৃতি সমাজে এবং শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও দৃশ্যমান হচ্ছে সেটি অনেকটাই হালে পানি না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। মূলত তথ্যের অভাবের কারণেই ইতিহাস বিকৃতি করার সুযোগ থাকে। আমাদের অনেক তথ্যই পত্রপত্রিকায় এখন প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অনেক তথ্যের বিকৃতিও ঘটিয়ে থাকে। সে কারণে আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে সরকারি দলিলপত্রের মধ্যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলো ছাড়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখন ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে গবেষক পর্যন্ত সবার কাছেই উন্মুক্ত করে দেয়া। তাহলে রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে বিভ্রান্তি, তথ্য বিকৃতি এবং অপপ্রচারের সুযোগ কমে আসতে বাধ্য হবে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তথ্য ভাণ্ডার সরকার কতটা উন্মুক্ত করবে জানি না, তবে পাকিস্তানের ২৩ বছরের গোয়েন্দা ফাইলগুলো দেশের গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া অতীব প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর ওপর যেসব ফাইল উদ্ধার করা হয়েছে তার ফলে শুধু বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নয় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের গোটা রাজনীতির একটি বড় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস এখন অনেকটা উন্মোচিত হয়ে এসেছে। এটি আরো ব্যাপক ও গভীরতর হবে যখন অন্য নেতাদের ফাইলগুলো উদ্ধার করে একইভাবে গবেষণার জন্য উন্মুক্ত কর দেয়া হবে। সেটি করা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের জটিল বিষয়গুলো জ্ঞানের আলোয় ধরা দেয়ার যথেষ্ট সুযোগ ঘটবে। এখনো আমরা পাকিস্তানকালের অনেক তথ্যই জানতে পারছি না। অনেক জায়গায় গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের অনালোকিত তথ্য ভাণ্ডারকে জ্ঞানচর্চার জন্য উদ্ভাসিত করতে হবে। এমনিতেই আমাদের সমাজে জ্ঞানচর্চার পদ্ধতিগত বিষয়গুলো খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় না। বিশেষ করে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি তথা রাষ্ট্রের গবেষণায় আমরা এখনো আধুনিক জ্ঞানতাত্তি¡ক চর্চায় খুব বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি। তেমন প্রসিদ্ধ চিন্তক আমাদের সমাজে স্থান করে নিতে পারছে না। সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষণাকে আমরা বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছি। কিন্তু রাষ্ট্র রাজনীতিকে গতিময়তা প্রদানের জন্য এসব জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য প্রয়োজন হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে জাতির ইতিহাসকে নির্মহভাবে চর্চা করা। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে পুরনো তথ্য ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেয়া। পাকিস্তানকালের তথ্য ভাণ্ডার উন্মোচন এখন আমাদের জ্ঞানচর্চা ও রাষ্ট্রের সম্মুখ চলার জন্যই জরুরি।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App