×

জাতীয়

দুশ্চিন্তার নাম ‘কিশোর গ্যাং’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২০, ১০:০১ এএম

দুশ্চিন্তার নাম ‘কিশোর গ্যাং’

প্রতীকী ছবি

সামাল দিতে বিশেষ নির্দেশনা

দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘কিশোর গ্যাং’ অপ্রতিরোধ্য। উঠতি বয়সি তরুণ-যুবকদের এই গ্যাংয়ের অনেক সদস্য ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডা, ইভটিজিং ও মাদকসেবনে অভ্যস্ত কিশোর গ্যাং সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযান ও উদ্যোগেও কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না তাদের। বরং প্রতিনিয়ত তাদের কর্মকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিব্রত করছে। পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং সদস্যদের রয়েছে মোটরসাইকেল বহর। সংগ্রহে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। তাদের নেপথ্যে প্রশ্রয়দাতা হিসেবে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের নাম। এরা নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও সক্রিয়। এদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স মাঠ পুলিশে বিশেষ নির্দেশনা পাঠিয়েছে। কিশোর গ্যাং রোধে থানায় পৃথক টিম করা হয়েছে। কাজ করছে বিট পুলিশ ও কমিউনিটি পুলিশ।

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং নতুন কিছু নয়। তারা নতুন নতুন ঘটনায় যুক্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা ভার্চুয়াল জগতে যুক্ত হয়ে বেশি সময় পার করায় উন্নত বিশ্বের তরুণ-যুবকদের কাজের দিকে চোখ রাখছে। এতে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার ধরন। তিনি বলেন, পারিবারিক বন্ধন একটা বড় ব্যাপার। পারিবারিক শৃঙ্খলায় ঘাটতি হলে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তারা খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিশোরদের রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হচ্ছে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাদের দিয়ে গ্রুপ তৈরি করাচ্ছে। অল্পতে তুষ্ঠ কিশোররা রাজনৈতিক আশ্রয়, অস্ত্র ও অর্থ পেয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে একেক ঘটনার পেছনে একেক গল্প তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম স্থিমিত হওয়ায় এর জায়গা দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা উন্মুক্ত করতে হবে উল্লেখ করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, কিশোররা যেভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বা অপরাধপ্রবণ হচ্ছে তা ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক। এ জন্য প্রতিটি পরিবারকে সহনশীল হতে হবে। গঠনমূলক কাজ করতে হবে। পরিবারে পরস্পরের সহযোগিতা-সমঝোতা বাড়াতে হবে। সামাজিক আস্থা বাড়াতে হবে। সরকারকে এ নিয়ে ভাবতে হবে। সবমিলিয়ে ইতিবাচক ফল পেতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগতে পারে। তাৎক্ষণিক ফল আশা করা ঠিক হবে না।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেন বলেছেন, কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। জনসচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি আইনেরও প্রয়োগ হচ্ছে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেছেন, বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যরোধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আইনি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স কম হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য সামাজিক সচেতনতা বাড়তে কাজ করছে পুলিশ। পরিবার থেকেও সন্তানদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। প্রতিটি থানায় এ ব্যাপারে তৎপরতা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা জানান, জেলার একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পুরো বিষয়টি মনিটরিং করেন। প্রতিটি থানায় এ জন্য পৃথক টিম রয়েছে।

পুলিশের কাছে থাকা তথ্য মতে, ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে খুন হয় ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। আদনান নিহত হওয়ার পর গ্যাং সংস্কৃতি আলোচনায় আসে। এ ঘটনায় জড়িতরা বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ করে আসছিল। তারা বাসাবাড়ির দেয়ালে গ্রুপের নামগুলো নানা সংকেতে লিখে রাখত। আদনান হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঢাকাতেই অন্তত ৪৫টি সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব পায়। পরে ঢাকার বাইরেও কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপের সন্ধান পায়।

এদিকে সারাদেশের কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে বছরখানেক আগে উদ্যোগ নেয় পুলিশ সদর দপ্তর। এরই অংশ হিসেবে সক্রিয় এবং তাদের সহায়তাকারীদের তালিকা করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এ তালিকার কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে পুলিশ। এতে সারাদেশে নামে-বেনামে সহস্রাধিক সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব গ্রুপের তালিকার সঙ্গে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট গ্রæপে ভাগ হয়ে চুরি, ছিনতাই, মাদক কেনাবেচাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সদস্যকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। শিগগির এটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হবে।

জানা গেছে, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারের দক্ষিপাড়ায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছে স্কুলছাত্রী নীলা রায়। ঢাকায় উত্তরায় ভয়ংকর কিশোর গ্যাং ‘রগকাটা’র তৎপরতা গাশিউরানো। গত বছরের জুলাইয়ে উত্তরা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ ফার্স্ট হিটার বস (এফএইচবি) নামে একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সেখানে ‘ফিফটিন গ্রুপ’ নামের একটি বড় গ্যাং পুলিশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গত বছরের জুলাই মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, কলেজগেট, শিশুমেলা, আগারগাঁও, তেজগাঁও এবং ধানমন্ডি থেকে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ২৯ জনকে আটক করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত বছর ৪ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে গ্যাংস্টার থেকে সরে আসায় ‘ফিল্ম ঝিরঝির’ গ্রুপের সদস্য চাইল্ড হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মহসিনকে হত্যা করা হয়। ২৮ জুলাই মোহাম্মদপুরে ‘লাড়া-দে’ গ্রুপের প্রধান তামিমুর রহমান মিম ও ‘লেভেল হাই’ গ্রুপের প্রধান মানিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, এলাকার ‘বড় ভাইয়েরা’ তাদের সবধরনের সহায়তা করে। তারা স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। ২৭ আগস্ট রাতে ঢাকার উত্তরখানে সোহাগ নামে এক কিশোর খুন হয়। দক্ষিণখান রাজাবাড়ী খ্রিস্টানপাড়া রোডের ডাক্তারবাড়ী মোড়ে ‘দি বস’-এর হৃদয়, রাসেলসহ বেশ কয়েকজন সদস্য আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় কাদা ছিটকে হৃদয়ের গায়ে লাগলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে রিকশাচালককে মারধর করতে থাকে। সোহাগ এগিয়ে এলে হৃদয়, রাসেলসহ অন্যরা এসে সোহাগের পেটে আঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে মারা যায় সোহাগ। এ ঘটনায় মোল্লারটেক থেকে কাটার রাসেল ও হৃদয়কে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। তারা স্থানীয় স্কুলে পড়ে। ১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাঠানটুলী এলাকায় আহাদ আলম শুভ মিয়া নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এলাকার এক যুবককে চড়-থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতেই শুভকে হত্যা করা হয়।

গত ৪ আগস্ট ফতুল্লার গাবতলীতে ওয়াসিফ গাউসিল উৎস নামে এক কিশোর রামদা হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করার দৃশ্য একটি ভিডিও ফুটেজে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার পর স্থানীয় নিজামের মা নূরজাহান বেগম থানায় অভিযোগ দেন। গত ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপ দেয় কদমরসুল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মিহাদ ও বিএম ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র জিসান। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট রায়েরবাজার বেড়িবাঁধে ‘স্টার বন্ড’ নামে একটি গ্যাংয়ের সদস্য আমিনুল ইসলামকে হত্যা করে প্রতিপক্ষ মোল্লা রাব্বি গ্রুপ। একই রকম পোশাক ও চুলের স্টাইল করে এলাকায় ঘুরে বেড়ানো দল দুটির সদস্যরা অনলাইনেও সক্রিয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App