×

জাতীয়

নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে আগ্রহ নেই ভোটারের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৩১ এএম

নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে  আগ্রহ নেই ভোটারের

ফাইল ছবি

গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত : বলছেন বিশেষজ্ঞরা উপনির্বাচনে দুই আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী

দিন দিন ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন ভোটাররা। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত মফস্বলেও ভোটার উপস্থিতি খুবই হতাশাজনক। ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনসহ সাম্প্রতিককালের কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র এক চতুর্থাংশ বা এর কাছাকাছি। সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনেও। প্রথমবারের মতো সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হওয়ায় নওগাঁ-৬ আসনের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কিছুটা বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভোট ব্যবস্থাপনার ওপর ভোটারদের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে, যা দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা বিনষ্টের একেবারে দোরগড়ায় নিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের পক্ষে এটি অশনি সংকেত। তারা মনে করেন, ভোটারবিহীন একের পর এক ভোট বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ঢাকা-৫ : সকাল ৯টা থেকে ভোট শুরু হলেও ১ ঘণ্টায় একাধিক কেন্দ্রে এক থেকে দুই শতাংশ ভোট পড়েছে। যাত্রাবাড়ীর ধলপুর কমিউনিটি সেন্টার, ডগাইর দারুচ্ছুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসা, মেট্রোপলিটন ক্রিয়েটিভ স্কুল এন্ড কলেজসহ একাধিক কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। এসব কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ভোটারের উপস্থিতি একেবারেই কম। কেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর নেতাকর্মীদের উপস্থিতি থাকলেও ভোটার সংখ্যা হাতেগোনা দু-চারজন।

মেট্রোপলিটন ক্রিয়েটিভ স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. জসিমউদ্দিন জানান, ওই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৪০০। এর মধ্যে ১ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে মাত্র ৩৫টি। ডগাইর দারুচ্ছুন্নাত ফাজিল মাদ্রাসার প্রিসাইডিং অফিসার মো. মহসিন মোল্লা বলেন, আমার ১৪৮ নম্বর কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৬২৫ জন। সকাল ১০টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৪৫টি। এই আসনের আরো কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। দুপুরের দিকে ভোটার উপস্থিতি কিছুটা বাড়লেও বিকালে কেন্দ্রগুলোতে ভোটার প্রায় ছিলই না।

নওগাঁ-৬ : সকাল ৯টায় নির্ধারিত সময়ের আগেই ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে কেন্দ্রে এসে উপস্থিত হন। এরপর উৎসবমুখর পরিবেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। রাণীনগর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, এ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ২ হাজার ৬২৯ জন। ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। ইতোমধ্যে ২০-২৫ শতাংশ ভোট প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, প্রথমবারের মতো ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে কৌতুহলের বশেও অনেকে ভোট দিতে এসেছেন।

এদিকে ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনে কোথাও কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি, কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কম কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশে ভোট হয়। এই খণ্ড নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ কমই থাকে। এ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য সরকার পরিবর্তনের সুযোগ নেই। ২ বছর-আড়াই বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন সেই জন্য হয়তো প্রার্থী বা ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। পাশাপাশি করোনার একটি বিষয় তো রয়েছে। এ জন্য মানুষ আতঙ্কিত।

ঢাকা-৫ আসনে কোথাও কোথাও ভোটারদের ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে, আইডি কার্ড কেড়ে নেয়া হয়েছেÑ এমন অভিযোগের জবাবে সিইসি বলেন, আইডি কার্ড কেড়ে নেয়ার কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। বাইরে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেছে এমন তথ্যও নেই। একটি জায়গায় কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার খবর পেয়েছিলাম। তবে সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে গতকাল নওগাঁ-৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলাকালে ‘পরিবেশ না থাকা, কেন্দ্র দখলসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিএনপি প্রার্থী শেখ রেজাউল ইসলাম রেজু নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে নওগাঁর আত্রাই থানা বিএনপি অফিসে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।

আবার ভোটে অনিয়মের অভিযোগ এনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পদত্যাগ দাবি করে ফলাফল বর্জন করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা-৫ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ। পাশাপাশি অনিয়মের প্রতিবাদে আজ (১৮ অক্টোবর) দুপুর ২টায় নির্বাচনী এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি এ নির্বাচনের প্রথম দিন থেকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। প্রায় সব কেন্দ্রেই আমাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি ইসির পদত্যাগ দাবি করেন।

দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী : নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৭ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী (নৌকা) আনোয়ার হোসেন হেলাল। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শেখ রেজাউল ইসলাম (ধানের শীষ) পেয়েছেন ৪ হাজার ৫১৭ ভোট।

আবার ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৯২৬ ভোট। এ আসনে ভোট পড়ার হার ১০.৪৩ শতাংশ।

গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত : সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে নির্বাচন হচ্ছে তা কোনো নির্বাচনই নয়, এমনকি এটাকে বাংলাদেশি স্ট্যান্ডার্ডেও কোনো নির্বাচন বলা যায় না। এ দেশে এর আগে চার-পাঁচটা জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সে সময় ভোটারদের আগ্রহ ছিল, ভোট পড়ার হার ভালো ছিল। তারপর থেকে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে যেসব নির্বাচন হচ্ছে তা কোনো মতেই ভোট বলা যায় না। এখানে সরকারি দলের যে প্রার্থী তিনিই জিতে যাবেন এমন একটা ধারণা তৈরি হয় ভোটারদের মনে। তিনি বলেন, প্রায়শ নির্বাচনের দিনে বুথ থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমান ইসি তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার দলীয় লোকজন ছাড়া কেউ ভোটকেন্দ্রের কাছাকাছি ঘেষতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ঠিকমতো দায়িত্বপালন করতে দেখা যায় না। সবই ইসির ব্যর্থতা। এগুলো চলছে, চলবেও। আমরা যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলছি, তা যদি দেশে না থাকে তাহলে এটা চলতে থাকবে। তবে একসময় আসবে জনগণ যখন নিজের ভোটের অধিকারের জন্য মাঠে আন্দোলন করবে।

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ শাহনেওয়াজ ভোটারের অনাগ্রহের কারণ হিসেবে বলেছেন, ভোটাররা মনে করে এর রেজাল্টে সরকারি ব্যবস্থা বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো সুফল তারা পাবে না। তাছাড়া জনগণ দেখেছে অন্য কোনো দল নির্বাচনে জিতে আসলে কোনো লাভ হয় না। বরং যা চলছে চলুক, গণ্ডগোলে গিয়ে লাভ কী? তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলীয় সমর্থকদের বাধা, ধাক্কাধাক্কি বা মারামারির মধ্যে পড়তে হয়, ভোট দিতে সরকারি দলীয় লোকজন বাধা সৃষ্টি করে; এসব কারণেও ভোটাররা আর ভোট দিতে ততটা আগ্রহী নন। যা সত্যি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জন্য খারাপ উদাহরণ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App