×

মুক্তচিন্তা

তৃপ্তি পেলাম, পরিতৃপ্ত হতে আরো কাজ করতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫৬ পিএম

বিশ্বব্যাপী করোনাকালেও বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি সংবাদ। ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ) তাদের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে যে, বাংলাদেশ মাথাপিছু প্রবৃদ্ধিতে ভারতকে পেছনে ফেলেছে। এই খবরে ভারত এক নিদারুণ অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। কারণ সেখানের সর্বত্রই এখন বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা এবং আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে আসা অর্থনৈতিক অগ্রগতি তথা মাথাপিছু জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়েই তুলনামূলক আলোচনার ঝড় বইছে। ভারতে আলোচনার ঝড় বইছে আর সমগ্র বাংলাদেশ এ খবরে উল্লসিত। অর্থনৈতিক খাতে এমন সাফল্যের সংবাদে আনন্দে ও প্রশংসায় বাংলাদেশ ভাসছে। আনন্দ ও প্রশংসার উচ্ছ্বাস কিছুটা কমে এলে আমাদের ভাবতে হবে ভারতের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতার জায়গাটি এখনো শক্তভাবে গড়ে উঠেনি। বৃহৎ আকারের এক অর্থনীতির দেশ ভারত। আমাদের চেয়ে ভারতের অর্থনীতির আকারও প্রায় চৌদ্দগুণ বড়। সাম্প্রতিক এ অর্জন প্রশংসনীয় হলেও পেছনে পড়া ভারতের দিকে তাকিয়ে আমাদের আশ্বস্ত হওয়ার অবকাশ নেই, আত্মতুষ্টিরও অবকাশ আছে বলে মনে করি না। বিগত পাঁচ বছরের ব্যবধানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক পার্থক্য অনেকখানি হ্রাস পেয়েছে। পাঁচ বছর আগে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। তাই এখানে ‘তৃপ্তি’র একটি জায়গা অবশ্যই আছে। কিন্তু এখনই ‘পরিতৃপ্ত’ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। পরিতৃপ্ত হতে হলে প্রবৃদ্ধির এই হারকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য শুধু অর্থনীতি নয়, মানব উন্নয়নের অন্য ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে হবে অনেক। তার আগে বাংলাদেশকে এই সক্ষমতা ধরে রাখতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের তাকাতে হবে আমাদের নিজেদের দিকেই, তাকাতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। অর্থনৈতিকভাবে আমরা কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই, আর সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের কী কী করণীয় তাও নির্ধারণ করতে হবে। অর্জিত এই সাফল্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, আসন্ন শীতে করোনার সম্ভাব্য ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আঘাত হানলেও আমরা যেন সবদিক ঠিক রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার সক্ষমতা দেখাতে পারি। যে কোনো দুর্যোগ বা বিপর্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার যেন ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করতে পারি।

আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এক হাজার ৮৮৮ ডলারে উন্নীত হতে পারে। পক্ষান্তরে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। আইএমএফসহ অনেক সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতোমধ্যে যেসব পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে এ দেশের অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে যে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি বর্তমানে ইতিবাচক ধারায় আছে। অর্থাৎ বলা বলা যায়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া সঠিক পথেই এগোচ্ছে। করোনা চলাকালেও কয়েক মাস ধরে ধীরে ধীরে খুলে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক খাতের প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের স্ব-স্ব কর্মে ফিরতে পেরেছে। এতে এক ধরনের সামাজিক স্বস্তি এসেছে বলে তার প্রতিফলন অর্থ খাতেও এক প্রকার সমৃদ্ধির সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আইএমএফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন তারই সাক্ষ্য বহন করছে।

অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ আইএমএফের আশাব্যঞ্জক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের আবার সতর্ক করে বলেছেন, ‘অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো যখন ধাক্কা খাচ্ছে তখন রপ্তানি ও প্রবাসী আয় নিয়ে শঙ্কা আছে।’ আমরা জানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘমেয়াদে একাধিকবার বন্যার আঘাতের পরও বাংলাদেশের কৃষি খাত এখনো সবল আছে, সেখানে ব্যবস্থাপনাও ভালো। কিন্তু তা সত্তে¡ও তিনি মনে করেন আমাদের সামগ্রিক ‘জাতীয় আয় ও উৎপাদন আগের অবস্থায় ফেরেনি।’ তার এই পর্যবেক্ষণও গুরুত্বপূর্ণ।

মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জনকে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার পরিচায়ক’ বলে স্বীকার করেছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ডক্টর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেললেও ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান ভালো।’ তবে তিনিও এই অর্জনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় মনোযোগের পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা এডিবি সবার হিসাবেই বাংলাদেশে এবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। সুতরাং আমাদের জন্য এ বছর অর্থনৈতিকভাবে ইতিবাচক হবে বলেই আশা করছি। এই অথনীতিবিদ বলেন, ‘যেখানে বিশ্ব সংস্থাগুলো সবাই বলছে, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবার নেগেটিভ অবস্থানে আছে। তবে আগামী বছরে ভারতের প্রাক্কলন অনেক বেড়ে যাবে। ৮-৯ শতাংশ বেশি হবে বলে মনে করছে আইএমএফ। তাই এ বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।’ তিনি আমাদের এও স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, ‘মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বণ্টনের বিষয় রয়েছে, রয়েছে ভোগের বিষয়ও। ভোগ ও বণ্টন সঠিকভাবে না হলে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও থাকে।’ উপরন্তু আমরা মনে করি মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ের ব্যবধান-বৈষম্যও বাড়ছে উচ্চ হারে। এটি হ্রাস করতে না পারলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টেরও আশঙ্কা থাকে। একটি সুস্থ-স্থিতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে আয় বৈষম্য কখনই হিতকরি ফল বয়ে আনে না। সে দিকটির প্রতিও সরকারের গভীর মনোযোগ থাকা চাই। বৈশ্বিক করোনা মহামারিকালেও আমাদের প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক তিনি বলেন যে, ‘আমাদের অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই বৈশ্বিক মন্দা বা মহামন্দার আশঙ্কা কিংবা করোনা ভাইরাস মহামারি অর্থনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো উপার্জন।’ তিনি এরূপও মনে করেন, করোনা মহামারি দূরীকরণের অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। শিল্প খাত এখনো তেমন চাঙ্গা নয়। বিশেষত যেখানে ৫২ থেকে ৫৩ শতাংশ জিডিপিতে যুক্ত হয় সেই সেবা খাত এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বড় শিল্প খাতে বাস্তবায়ন হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতগুলো এখনো তার বাইরেই আছে। প্রণোদনা প্যাকেজের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হলে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি আরো শক্তিমত্তায় ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম।

অপরদিকে আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন। ভারতের তুলনায় মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই অর্জন নিয়ে তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘এখানে খুব বেশি আত্মতুষ্টি নেই, তৃপ্তি আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এখন অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। আইএমএফের পূর্বাভাসে ভারতীয় অর্থনীতি রিকভারি করলেও বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যেতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো অর্থনৈতিক আলোচনায় বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। অথনৈতিক মন্দার এই সময়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় দেশটিতে আলোচনা শুরু হয়েছে।’ ডক্টর জাহিদ হোসেন আরো মনে করেন, ‘ভারতের মতো একটা বিশাল অর্থনীতির দেশকে অর্থনৈতিক সূচকে টপকে যাওয়া নিশ্চয়ই একটি বড় অর্জন।’

বাংলাদেশে সার্বিকভাবে করোনা সংক্রমণের ভীতি বাস্তবত তেমন প্রকট আকার ধারণ করেনি। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যেও করোনা তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্যবসায়িক সংগঠন এবং সরকারি দর কষাকষির ফলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে দ্রুত পণ্য আমদানি শুরু করেছে। ফলে আমাদের প্রায় ৮০ শতাংশ রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কৃষি খাতও অনেকটা প্রবল শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে আমাদের নির্ভরতা দান করেছে। এ বছর বন্যায় বারবার বিপর্যস্ত হওয়ার পরও কৃষির ওপর আমাদের সার্বিক ভরসা মোটেই খর্ব হয়নি। বৈচিত্র্যময় কৃষিই আমাদের বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছে, সহায় থেকেছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়ে চলেছে। এটি আশার কথা। আশার কথা এটিও যে, ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এমন সচল ও চাঙ্গা রাখার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব অন্যতম ভ‚মিকা পালন করেছে। সেই সঙ্গে প্রবাসী আয়, রপ্তানি বাণিজ্য এবং কৃষি ব্যবস্থাপনার প্রতি শেখ হাসিনার গৃহীত নীতি ও দিকনির্দেশনা সাম্প্রতিক সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছে। প্রবৃদ্ধির এই হার বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকলে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ‘২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন’ অসম্ভব বা কষ্ট কল্পনা থাকবে বলে আমরা মনে করি না। আমাদের সামগ্রিক অর্থ খাতকেও উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যেই বিন্যস্ত করা জরুরি।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App