×

জাতীয়

এনআইডি সংশোধনে ভোগান্তি প্রতিদিন জমছে ফাইলের স্তূপ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১২:২৪ পিএম

বীরাঙ্গনার এনআইডি সংশোধন হয়নি ৩ বছরেও

জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল সংশোধনের অপর নাম ভোগান্তি-হয়রানি। প্রথমত নামের বানানে ভুল, বাবা-মা, স্বামীর নামের বানান ভুল, জন্ম তারিখ ভুল, ঠিকানায় ভুল- এসব ঘটনা অসংখ্য। আর এসব সমস্যা নিয়ে সেই শুরু থেকেই (২০০৮ সাল) ভুগছেন নাগরিকরা। এসব ভুল সংশোধনে আবেদনের স্তূপ জমেছে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (আইইটি ভবনের) প্রতিটি উপজেলা-জেলাভিত্তিক কর্মকর্তার টেবিলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরেও গ্রাহকরা এসব ছোটখাটো ত্রুটি সংশোধন করাতে পারছেন না। কেউ আসছেন বাংলাবান্ধা থেকে; কেউ আসছেন সুদূর দক্ষিণের সুন্দরবনঘেঁষা কোনো উপজেলা থেকে। কিন্তু ইসির কর্মকর্তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দিনের পর দিন ঘুরপাক খাচ্ছেন আবেদনকারীরা। কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এমনকি ছোটখাটো কর্মী বা গার্ডের দুর্ব্যবহারে অনেক সময় অফিসারের টেবিল পর্যন্ত যাওয়াও দুষ্কর হয়ে উঠে। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের এসব ছোটখাটো ভুল সংশোধনের জন্য অনৈতিকভাবে অর্থ লেনদেনে তারা বাধ্য হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি কার্ড দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কার্ডে তথ্য ভুল থাকায় তাদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় চাকরি হচ্ছে না, কেউ বেতন পাচ্ছেন না, কেউবা ব্যাংকের নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে টাকা তুলতে পারছেন না। পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় অনেক হতদরিদ্র ভিজিএফসহ বিভিন্ন ত্রাণ নিতে পারছেন না। এ রকম অসংখ্য সমস্যায় সম্মুখীন সাধারণ মানুষ।

একাত্তরে নির্যাতিতা মুক্তিযোদ্ধা মোছা. মনোয়ারা, যিনি মাধবপাশার সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গলের বাসিন্দা। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট প্রকাশিত গেজেটের ১২৬ নম্বরে বীরাঙ্গনা হিসেবে তার নাম প্রকাশিত। কিন্তু তার এনআইডি কার্ডের সঙ্গে জন্ম সনদে ‘জন্ম তারিখ’ ভুল থাকায় দীর্ঘদিন ধরে তিনি সরকার প্রদত্ত ভাতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০১৭ সালের ৩ মার্চ জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য নিয়মানুযায়ী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার মাধ্যমে সংশোধনের আবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার জন্ম তারিখ সংশোধন না হওয়ায় তিনি বীরাঙ্গনা হয়েও সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এ বিষয়ে মোছা. মনোয়ারা বলেন, আমি এক গেজেটভুক্ত বীরাঙ্গনা, আমার নাম সরকারি গেজেটে ১২৬ নম্বরে রয়েছে। এসব কাগজপত্রসহ ২০১৭ সালে জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদন করি। গত ৩ বছরে বেশ কয়েকবার নির্বাচনী কর্মকর্তা, ইউএনও থেকে জেলা প্রশাসক- সবার কাছে গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে অনুনয়-বিনয় করলেও আমার এনআইডি আজও সংশোধন হয়নি। তিনি ঢাকার নির্বাচন ভবনে এনআইডি অনুুবিভাগের ডিজির সঙ্গে দেখা করতে ঢাকার আগারগাঁওয়ের অফিসে গেলেও দেখা করার অনুমতি মেলেনি। বীরাঙ্গনা হয়েও স্বাধীনতার এত বছর পরও রোগাক্রান্ত অবস্থায় তিনি রেললাইনের পাশে ঝুপড়িতে বাস করছেন বলে আক্ষেপ করেন।

শুধু মনোয়ারা নন; এনআইডি সংশোধনের বিষয়ে এমনি হাজারো গ্রাহক ভোগান্তিতে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাতক্ষীরার সুমন মোস্তাফা, তার জন্ম ১৯৯৮ সালে, এসএসসি সার্টিফিকেট রয়েছে। কিন্তু তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুলক্রমে তা দেখানো হয় ১৯৯৬ সাল। এই সংশোধনীর জন্য নিজ উপজেলায় আবেদন জমা দিয়েছেন ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। সংশোধনীর জন্য দলিল হিসেবে দিয়েছেন এসএসসি পাসের সার্টিফিকেট, জন্ম সনদ, পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ ও চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র। আবেদন জমা দেয়ার সময় কার্ড দেয়ার সম্ভাব্য তারিখ দেয়া হয় ওই সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কিন্তু আবেদন জমা দেয়ার ৪ বছরের বেশি সময় পার হলেও তার আবেদনের অবস্থা কী এখনো তিনি জানেন না। বিগত ২-৩ বছরে অন্তত ২০-২৫ বার উপজেলা অফিসে এবং ৮-১০ বার আগারগাঁওয়ে ইসির এনআইডি উইংয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে ঘুরেও কারো কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।

আবার বিশেষ প্রয়োজন বিধায় করোনা মহামারি উপেক্ষা করে সুদূর রাজশাহী থেকে ঢাকার আগারগাঁওয়ের অফিসে এসেছেন আজমল হক। নাম ও পিতার নামের সংশোধনীর জন্য দুদিন ঘুরেও কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি মেলেনি বলে প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ জানান তিনি। বাংলাবান্ধার নমিতা সরকার, স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি পুনরায় বিয়ে করেছেন, কিন্তু এনআইডি কার্ডে মৃত স্বামীর নাম থাকায় নানা সমস্যা। শ্বশুর বাড়িতেও অশান্তি। আবেদন করার দুবছরেও তা সমাধান হয়নি। আসছেন আর ফিরে যাচ্ছেন। এ রকম হাজারো গ্রাহক এনআইডির জন্ম তারিখ, নাম, বাবা-মায়ের নাম বা স্বামীর নাম ভুল বা সংশোধন, ঠিকানা পরিবর্তন প্রভৃতি সংশোধনের আবেদন করে এমন ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন। আবার কেউ কেউ অর্থ দিয়ে ভিন্ন পথে এনআইডি সংশোধন করতে সমর্থ হলেও অনেকে অর্থ দিয়ে ঠকেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন বহু ফাইল সংশোধনের জন্য দেশের বিভিন্ন উপজেলা-জেলা অফিসে জমা পড়ে। তা প্রধান কার্যালয়ে আসে। অধিকাংশের ত্রুটিগুলো বয়স বা নাম সংশোধনভিত্তিক। তার স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় তাদের এনআইডি সংশোধন করা যাচ্ছে না। তবে মৌলভীবাজারের বীরাঙ্গনা মোছা. মনোয়ারার ফাইলটি তার টেবিলে আছে বলে স্বীকার করেন ডিজি। তিনি বলেন, দেখছি এ বিষয়ে কি করা যায়। বীরাঙ্গনার এনআইডি ফাইলে কোনো ভুল বা অসঙ্গতি না থাকলেও কেন তা সংশোধন হচ্ছে না? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তিনি দেননি। তিনি বলেন, বিভিন্ন মতলবে অনেকে দ্বৈত ভোটার বা নাম-বয়স পাল্টে মামলা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এনআইডি করছে। এগুলো ঠেকাতে আমরা সতর্কভাবে চলছি। তবে সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেলে সেটি সংশোধনযোগ্য বলে জানান ডিজি। তবে অর্থ লেনদেনের কোনো ঘটনা তার জানা নেই। এমনটি প্রমাণ হলে ওই কর্মীকে শাস্তির আওতায় নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে ইসির যুগ্ম সচিব ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল বাতেন জানান, বর্তমানে করোনা সংক্রমণের জন্য ইসিতে রোস্টারভিত্তিতে এনআইডি বিভাগের কিছু অস্থায়ী কর্মী কোনো কোনো কর্মকর্তার অধীনে কাজ করছেন। তবে এত বেশি আবেদন সময়মতো দেখা অসম্ভব। কিছু কাগজপত্রেও অসঙ্গতি থাকে। এর মধ্যেও আমরা যেসব আবেদন সংশোধনযোগ্য তা সংশোধন করছি। তবে কাজের চাপ বেশি থাকায় সব ফাইল সময়মতো ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠে না বলেও স্বীকার করেন আবদুল বাতেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App