×

সারাদেশ

আমরা আর বিচার চাই নিকো, আল্লাই সুবিচার কোইরবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৫৭ পিএম

আমরা আর বিচার চাই নিকো, আল্লাই সুবিচার কোইরবে

প্রতারণার শিকার কিশোরী খাদিজা ও তার মা শেফালি খাতুন।

আমরা আর বিচার চাই নিকো, আল্লাই সুবিচার কোইরবে

বিয়ের নাটক সাজিয়ে জোর করে যৌতুক আদায়কারী প্রতারক মাসুম।

ভুয়া কাবিনের মাধ্যমে কিশোরীর সাথে বিয়ের নাটক সাজিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে এক সঙ্গে বসবাস এবং মেয়েটির বাবার বসতভিটে বিক্রি করিয়ে জোর করে যৌতুক আদায়ের ঘটনায় গণমাধ্যমে খবর বেরোনোর পর গত কয়েকদিন ধরে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচারের কোনো লক্ষণই পাননি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার হোগলবাড়িয়া ইউনিয়নের বেগুনবাড়ি গ্রামের সেই অসহায় পরিবারটি। এরই মধ্যে তারা ছুটেছেন ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট, থানা-পুলিশ সবার কাছে।

একের পর এক নাজেহাল হয়ে ওই কিশোরী মেয়ের মা শেফালি খাতুন এ ঘটনার বিচারের আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন। প্রচণ্ড ক্ষোভে অভিমানে সাংবাদিকদের বলেছেন, 'এই দ্যাশে আমারে মুতুন গরিব অসহায় মাইনষের কুনো বিচার নাইকো। যার ট্যাকা নাইকো, ক্ষ্যামতা নাইকো তার জইন্যে আইন বিচার কিচ্ছু নাইকো। আমরা এখন আর বিচার চাই নিকো, আল্লার উপুরে বিচারের ভার ছাইড়ি দিনু, আল্লাই একদিন ইয়ার সুবিচার কোইরবে।' নিজের ভাষায় কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

দৌলতপুর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের জয়ভোগা গ্রামের আজমল হোসেনের প্রতারক ছেলে মাসুমের (২৫) সাথে বেগুনবাড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলামের কিশোরী মেয়ে জুলেখার বিয়ে হয় তিন বছর আগে। তখন জুলেখার বয়স ছিল ১৪ বছর। অভাব অনটনের কারণে অপ্রাপ্ত বয়সেই তার বিয়ে দেয় পরিবার। বছরখানিক আগে পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার এক মাস পর মারা যায় জুলেখা।

বাল্যবিয়ের কারণে স্ত্রী জুলেখা মারা যাওয়ার পরে মাসুম তার আরেক কিশোরী বোন (শ্যালিকা) খাদিজাকে ভুয়া কাজির মাধ্যমে ভুয়া কাবিনে কৌশলে বিয়ের নাটক সাজিয়ে সাকসেস হয়। দুই মাস যেতে না যেতেই যৌতুকের জন্য খাদিজার ওপর চাপ সৃষ্টি করে মাসুম। তার দাবি করা যৌতুকের টাকা দিতে কিশোরীর পরিবারকে বিক্রি করতে হয় শেষ সম্বল বসতভিটে। কিন্তু টাকা গ্রহণের পর মাসুম ভোল পাল্টায়। ৭ মাস এক সঙ্গে থাকার পরেও কিশোরী শ্যালিকা খাদিজাকে বিয়েই করেনি বলে দাবি করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় প্রতারক মাসুম। প্রতারণার শিকার খাদিজার ঠাঁই হয় অন্যের জমিতে কোনো মতে আশ্রয় নেয়া বাবা-মায়ের কাছে। তার অসহায় পরিবারটি সহায় সম্বল সবকিছু হারিয়ে এখন দিশেহারা। চাইলেও মিলছে না সুবিচার।

টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা পরিবারটি অর্থের অভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি। বিনা খরচে আইনি সহায়তা পেতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক সালিশ কেন্দ্রে একটি অভিযোগ করেন তারা। এ ঘটনায় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি ভোরের কাগজসহ আরো কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বিস্তর খবর বের হয়। এদিকে ঘটনাটি জানার পর থেকেই ওই পরিবারের পাশে দাঁড়ান এখানকার সাংবাদিকরা।

খবরভিত্তিক একটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান সেতু আহমেদ গত ১২ অক্টোবর খাদিজা ও তার মা শেফালি খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তারের দপ্তরে যান। কিন্তু সে সময় ইউএনও কুষ্টিয়ায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিংয়ে থাকায় সেতু তাকে মোবাইল ফোনে তার জন্য অপেক্ষা করার কথা জানালে তিনি এসিল্যান্ডকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর আগে ওইদিনই ব্র্যাকের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে উভয়পক্ষকে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বসার কথা থাকলেও প্রতারক মাসুম সেই বারও সেখানে যায়নি। ফলে ব্র্যাক থেকে ফিরে তারা উপজেলা পরিষদে আসেন।

[caption id="attachment_247637" align="alignnone" width="1920"] বিয়ের নাটক সাজিয়ে জোর করে যৌতুক আদায়কারী প্রতারক মাসুম।[/caption]

সহকারী কমিশনার (ভূমি), নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আজগর আলীর দপ্তরে গেলে তিনি ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে শোনেন। তাদের নিজ দপ্তরে বসিয়ে রেখে অভিযুক্ত মাসুমের বক্তব্য শোনার জন্য এক ঘণ্টার ভেতরে তাকে হাজির করতে দপ্তর সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় মোবাইল ফোনে মাসুমকে দ্রুত এসিল্যান্ডের কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য জানান সেখানকার অফিস সহকারী রনজিত কুমার। এসিল্যান্ড দুপুরে খাবার খেতে না গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন। কিন্তু ব্র্যাকের মতো এসিল্যান্ডের কার্যালয়েও হাজির হয়নি প্রতারক মাসুম। এ সময় এসিল্যান্ড সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে একটি অভিযোগ জমা দিয়ে রাখার পরামর্শ দেন তাদের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হবে এবং প্রয়োজনে নিজেও ব্যক্তিগতভাবে পাশে থাকবেন বলে অসহায় পরিবারটিকে আশ্বস্ত করেন এসিল্যান্ড আজগর আলী।

পরে ক্যামেরাম্যান সেতু আহমেদ ইউএনও শারমিন আক্তারের সাথে দেখা করে পুরো ঘটনা খুলে বললে তিনি তাৎক্ষণিক ব্র্যাকের সালিশ কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা ফারজানা ইয়াসমিনকে মোবাইল ফোনে ভুক্তভোগী পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে থানায় মামলা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ তাদের নীতিমালা অনুযায়ী থানায় মামলা করার নিয়ম নেই বলে ভুক্তভোগীদের সাফ জানিয়ে দেন। এরপর এ ঘটনায় সাংবাদিকদের পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারী সেতু পুনরায় ইউএনওকে ব্র্যাকের অপারগতার কথা জানান। জবাবে ইউএনও এক রকমের নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তাকে বলেন, আমার যেটা বলার বলে দিয়েছি তারা না করলে আমি কী করবো। এখন ব্যস্ত আছি বলেই মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন ইউএনও।

পরেরদিন ১৩ অক্টোবর দৌলতপুর থানার ওসি (তদন্ত) নিশিকান্ত সরকারকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানানো হলে তিনি ইতিবাচক সাড়া দিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারকে থানায় পাঠানোর কথা জানান। ওইদিন বিকেলে মামলার এজাহার লেখার জন্য খাদিজার মায়ের হাতে ৫শ টাকা ধরিয়ে দিয়ে মা-মেয়ে দুজনকে থানায় পাঠানো হয়। কিন্তু ওসি নিশিকান্ত নিজে ঘটনা না শুনে থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই তপন সিংহের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেকেন্ড অফিসারও তাদের খুব একটা পাত্তা দেননি। তিনি এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দিয়ে তাদের থানা থেকে বিদায় করেন।

বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) ওই অসহায় পরিবারের মা-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ক্যামেরাম্যান সেতু আহমেদ সরকারি ব্যবস্থাপনায় আইনি সহয়তাকারী সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহযোগিতা নিতে কুষ্টিয়ায় যান। অন্যদিকে একটি অসহায় পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে বারবার হয়রানির শিকার হওয়ায় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে অবগত করা হয়। পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত বিষয়টি আমলে নিয়ে বিস্তারিত জানার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে মামলা গ্রহণ এবং আসামি মাসুমকে দ্রুত গ্রেপ্তারের জন্য দৌলতপুর থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।

পরে উপজেলা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ভুক্তভোগীদের পুনরায় দৌলতপুর থানায় ফিরিয়ে আনা হয়। এবার বুঝি সব হয়রানির অবসান ঘটবে, ইতিবাচক কিছু একটা ভাগ্যে জুটবে- এই আশায় বুক বাঁধে অসহায় মা-মেয়ে। বেলা সাড়ে ১১টায় থানায় গিয়ে বিকেল ৫টার পরে বের হন তারা। দৌলতপুর থানার ওসি জহুরুল আলম তখনো ছুটিতে থাকায় ওসি (তদন্ত) নিশিকান্ত সরকার প্রতারণার শিকার খাদিজা ও তার মা শেফালি খাতুনের মুখ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শোনেন। একপর্যায়ে এ বিষয়ে ওসির মোবাইলে কল এলে তিনি বারবার স্যার সম্বোধন করে তাৎক্ষণিক মামলা গ্রহণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মামলার এজাহার লেখেন। ভুল হওয়ায় সেই এজাহার সংশোধন করা হয়। কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক এগিয়ে চললেও শেষ মুহূর্তে এসে আইনগত জটিলতার কারণ দেখিয়ে অপারগতা প্রকাশ করে আদালতের আদেশ ছাড়া এ ব্যাপারে থানায় মামলা গ্রহণ সম্ভব নয় বলে তাদের জানিয়ে দেন ওসি।

এভাবেই একের পর এক নাজেহাল হয়ে খাদিজার মা শেফালি খাতুন ক্ষোভে দুঃখে এখন আর বিচার চাচ্ছেন না। বিচারের ভার আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে জানান, যার টাকা নেই ক্ষমতা নেই তার জন্য দেশে আইন বিচার বলে কিছু নেই। বিচার চেয়েও কোনো লাভ নেই। বিচার হোক না হোক আর কোথাও দৌড়াদৌড়ি সম্ভব না। এদিকে উপজেলা প্রশাসন থেকে তলব করা হলেও সেই নির্দেশ অমান্য করে, ব্র্যাকের সালিশকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে প্রতারক মাসুম গায়ে বাতাস লাগিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মাসুম যেসব অপরাধ করেছে তার নামে প্রতারণা থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন, ভুয়া কাবিনে বিয়ের নাটক সাজিয়ে জোর করে যৌতুক আদায় এবং দীর্ঘদিন ধরে এক সঙ্গে থাকায় ধর্ষণের মামলাও হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এরই মধ্যে অনত্র বদলি হয়ে যাওয়ায় ওসি (তদন্ত) নিশিকান্ত সরকারের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। দৌলতপুর-ভেড়ামারা সার্কেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ মো. আল বেরুনী এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।

দৌলতপুর থানার নবাগত ওসি (তদন্ত) শাহাদাৎ হোসেন বলেন, এখানে এসে যতদূর শুনলাম ঘটনাটি বেশ কয়েক মাস আগের। কিন্তু কিশোরীকে কবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কবে ফেরত পাঠানো হয়েছে সেই তারিখ নির্দিষ্ট করে তারা (ভুক্তভোগীরা) বলতে পারেননি। তাই এই মুহূর্তে তারা যে মামলা (বিয়ের নামে ধর্ষণ) দিতে চান সেটা গ্রহণ করার সুযোগ নেই। ডাক্তারি পরীক্ষায়ও এখন ধর্ষণের আলামত মিলবে না। আবার কিশোরী বয়সে বিয়ের নামে যৌতুক আদায়ের বিষয়টি নিয়েও আইনি জটিলতা রয়েছে। তবে আদালতের আদেশ পেলে মামলা গ্রহণ করা হবে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি), নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আজগর আলী বলেন, ভিকটিম ও তার পরিবারের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে বুঝেছি ঘটনাটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এই অপরাধ মোবাইল কোর্টে বিচার্য নয়। তা না হলে ওইদিনই (১২ অক্টোবর) আমরা অ্যাকশনে যেতাম। কিন্তু কোনোভাবেই এই অপরাধ আমলে নিয়ে মোবাইল কোর্টে বিচার করা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগী পরিবারটির ন্যায্য বিচারের স্বার্থে আমরা তাদের থানা কিংবা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার মাধ্যমে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছি। বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নিশ্চয় তারা ন্যায়বিচার পাবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App