×

মুক্তচিন্তা

শক্তির উৎসমুখ শারদীয় : মুক্ত করো ভয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫৩ পিএম

মহাভারতে নিঃসন্তান রাজা ভগস্বান পুত্র কামনায় ইন্দ্রের তপস্যা করেছিলেন। সন্তুষ্ট ইন্দ্রের কাছে শতপুত্র চাওয়া রাজা তাই পেলেন। আবার কিছুকাল পর ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করে প্রার্থনা পূর্ণ করলে ইন্দ্র জানতে চান : কেন আবার তাকে ডেকে আনা? এবার রাজা পুরুষ থেকে নারী হতে চাইলেন। ইন্দ্র এ প্রার্থনাও পূর্ণ করলেন। এবার স্ত্রী রূপিনী রাজা শত পুত্রের বর চাইলেন। সে ইচ্ছাই পূর্ণ হলো তার। রানী জন্ম দিলেন শত পুত্রের। কিছুকাল পর ইন্দ্র এসে রাজাকে বললেন যে কোনো শতপুত্র ত্যাগ করতে হবে তাকে। দেবরাজ ইন্দ্রকে বিস্মিত করে বললেন পিতৃকালীন শতপুত্রকে নিয়ে যেতে। বিস্মিত ইন্দ্র জানতে চাইলেন : তা কেন? এরা তো তারা বীর্যবাহী বংশের ধারক। ভগস্বান রাজা তখন বলেছিলেন, তিনি বুঝতে পেরে গেছেন কাকে বলে মায়ের মমতা। নারীর স্নেহ, সে ভালোবাসায় সন্তানরা বড় হোক এটাই তার কামনা। সন্তুষ্ট ইন্দ্র রাজাকে আবারো তার পুরুষ দেহ ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, রমণী জীবনের আনন্দ আর সুখ তাকে তৃপ্ত করে। তিনি সেভাবেই থাকতে চান।

গল্পটা বললাম এই কারণে, এর নারীপুরুষজনিত ব্যাখ্যা মূল বিষয় না। আসল কথা হলো মায়ের মমতা আর করুণাধারাই সন্তানের জন্য হিতকর। পিতা তার দায়-দায়িত্ব পালন করেন বটে কিন্তু তার দ্বারা সেভাবে প্রতিপালন অসম্ভব। যেভাবে জন্মদাত্রী মা করতে পারেন। সম্ভবত এ কারণেই আমরা দেবীরূপী মাকে স্মরণ করি। পূজা করি। যাতে আমাদের দুঃখ-বেদনা আর ভার লাঘবে এমন কাউকে পাই যাকে নির্ভর করে জীবন অতিবাহিত করা যায়। আমাদের শারদীয় দুর্গাপূজায় দেবীর যে রূপ তাতে জননী ভাব সুস্পষ্ট। এমন আকুল করা মা বন্দনার জাতিতে কেন ঐক্য আর বলের অভাব সেটাই বরং ভাবার বিষয়।

আমি যখন এ লেখা লিখছি করোনাকালে অন্যরকম পূজার আয়োজনে সাড়া জেগেছে। এখন কেবল পূজা না মহালয়া থেকে বিসর্জন বা সপ্তাহন্তের পূজা চালু হয়ে গেছে পাঁচদিনের পূজা আয়োজনে। একদিকে এবার যেমন অনাড়ম্বর আরেকদিকে এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তাদের প্রতি ভালোবাসা আর আন্তরিকতা জানিয়ে বলি, পূজার দুয়েকদিন আনন্দ করার পাশাপাশি আমাদের বিশ্বাস আর আচরণের দিকটা তুলে ধরা জরুরি। বিলুপ্তপ্রায় হিন্দু বাঙালির সম্মান আর মর্যাদা জ্বলছে টিমটিম করে। দেশ থেকে রক্তে বয়ে আনা ভীরুতা আর নিজেদের অপমান করার ধারা আমরা কিছুতেই এড়াতে পারছি না। পারিবারিক আড্ডা কিংবা মজলিসে আমরা মুখে বড় কথা বললেও মূলত শিরদাঁড়ার সমস্যা যায় না। তাই বারবার তাদের কাছেই নতজানু হই, যারা আমাদের সংস্কার আচরণ কিংবা বিশ্বাসকে মনে করা হাসি-ঠাট্টার বিষয়। যে কোনো সম্প্রদায় কিংবা জাতি আমাদের কাছে আদরণীয়। আমরা তাদের সম্মান ও ভালোবাসা জানাই। কিন্তু আত্মবিশ্বাস বা মর্যাদা বিকিয়ে তাদের কাছে নতজানু হওয়ার প্রবণতা ভয়ঙ্কর। ধারণা করি মহাভারতের ভাতৃঘাতী যুদ্ধ দেবতা বনাম দেবতার লড়াই আর রামায়ণে রাম বা রাবণ উভয়ে ছিলেন এক ধর্মাবলম্বী বলেই হয়তো আমরা নিজেদের অপমান করতে পছন্দ করি। একজন নামকরা ক্রিকেটার যিনি দেশের সম্মান ও গৌরব বাড়িয়ে তোলেন তিনি যখন পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট দেয়ার পর অপমান আর নির্যাতনের ভয়ে তা তুলে নিতে বাধ্য হন আমাদের মুখ বন্ধ থাকে। আমরা নিন্দা করতেও ভীত থাকি। বিষয়টা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িকতা নয়। বিষয় খুব পরিষ্কার। মনে রাখতে হবে আত্মসম্মান আর মর্যাদার শেষ রেখায় এসে দাঁড়ানো আমাদের সম্প্রদায় এখন করুণার শিকার। একদিন তারা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিতে পরিণত হলে আপনি বিদেশে বাংলাদেশের নামে গড়া সংগঠনের নামে যে পূজা করবেন তা শোনাবে হাস্যকর। ভেবে দেখুন আমরা শিরদাঁড়া সোজা রাখছি কিনা? নিজেদের মানুষদের অপমান আত্মকলহ আর ঈর্ষা-বিদ্বেষে যে পরিবেশ তাতে এটা স্পষ্ট দেবী দুর্গাও আমাদের বাঁচাতে আসতে চাইবেন না।

বাংলাদেশে এখন পূজার জৌলুসের কমতি নেই। এই চোখ ধাঁধানো জৌলুসের একদিকে যেমন বর্ণ, রূপ, গন্ধ আরেকদিকে খাবার বা মাংস গোস্ত নিয়ে হাহাকার। আমি মনে করি সমাজ সংহতি আর ভালো থাকার স্বার্থে জবরদস্তি বন্ধ করা দরকার। তা না হলে পাকিস্তানের মতো একটি অকার্যকর সমাজে ক্লীব জাতি হিসেবে বাঁচা বা নিজের পরিচয় দিতে না পারার গ্লানি বহন করতে হবে আমাদের। অথচ আমরা যার পূজাকে শারদ উৎসব বলছি তার এই পূজা ছিল শক্তির অকাল বোধন। আর এই অকাল বোধনের মূল কারণ ছিল অসুর নিধন। রাবণ দেশপ্রেমিক রাজা। তার আমলে লঙ্কা ছিল স্বর্ণ লঙ্কা। তারপরও নারী অপমান আর চারিত্রগতভাবে বিশৃঙ্খল হওয়ার কারণে তাকে মরতে হয়েছিল। এ ইতিহাস আমাদের কী জানাতে চায়? কী এর মূল কাহিনী? দেবীকে কেন দরকার পড়েছিল রামের? তিনি স্বয়ং নারায়ণ বলেই রায় দেন ধার্মিকরা। এটা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না নারীশক্তির ভেতরই আছে মা, এতেই আছে জননী ও সংহারকারিণীর যৌথরূপ। সে কারণে পুরুষ বারবার তার কাছে ফিরে যায়। এই রূপটা এখন আবছা। এর আচরণগত দিকটা আমাদের যত প্রিয় আদর্শিক দিকটা তেমন না। তাই এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই শত বছরের হাজার বছরের পুরনো ধর্মে কিছু স্থবিরতা বা সীমাবদ্ধতা স্বাভাবিক। তার মানে এই না আমাদের শক্তি ও শৌর্যের ঘাটতি আছে।

বন্ধ করতে হবে আত্মঅপমান। আমি নিজের ব্যাপারেই জানি যে কোনো দেশে, যে কোনো সমাজে, যে কোনো পরিবেশে হিন্দুরাই নিজেদের ঠেকাতে যথেষ্ট। বাঙালি মুসলমান, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানরা যত বিভক্ত আর মতভেদে বসবাস করুক না কেন তারা নিজেদের বেলায় ঐক্যবদ্ধ। ইগো আর সংকীর্ণতার দেয়াল আমাদের রক্তাক্ত করলেও হুঁশ ফেরে না। তবে মুক্তি কোথায়? কেবল পূজা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুক্তি নেই। জাগতে হলে সম্মান, মর্যাদা আর বিবেককে জাগাতে হবে। দেবী দুর্গা বা তার সঙ্গে নিয়ে আসা পুত্রকন্যাদের যে ইমেজ তার দিকে চোখ রাখুন। তাতেই বলা আছে সচ্ছলতা, বিদ্যা, সাহস ও সিদ্ধি এসবের সম্মিলন না হলে আর যাই হোক আধুনিক বা অগ্রসর হওয়া যায় না। সে কারণেই তিনি দশভুজা হওয়ার পরও সবাইকে সঙ্গে নিয়া আসেন।

বাঙালি হিন্দুর সামনে যে সময় তাতে তার সর্বজনীনতার পাশাপাশি আত্মমর্যাদাও বড় বিষয়। তবেই শারদীয় হবে সবার যোগে জয়যুক্ত।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App