×

মুক্তচিন্তা

নগরীয় কৃষির অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২০, ০৮:৫০ পিএম

নগরীয় কৃষির অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের দাবি
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কৃষিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য জোগান। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। অপরদিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে করোনার মতো মহামারি। ফলে বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা পড়েছে চরম সংকটে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কৃৃষি গ্র্যাজুয়েট তৈরির কোনো বিকল্প নেই। যুগোপযোগী, আধুনিক ও প্রয়োগিক কারিকুলামের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব। সম্ভব কৃষিতে কৃত্তিম বুদ্ধিমতা, অটোমেশন, জিপিএস, ইন্টারনেট অব থিকস এবং প্রিসিশন এগ্রিকালচারের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষায়ক্রমে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। কৃষিকে অধিকতর লাভজনক করতে হলে কৃষিপণ্যের বিপণন ও প্রক্রিয়াজাত বাড়াতে হবে। কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কৃষিপণ্যের টেকসই বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রক্রিয়াজাত করে মূল্য সংযোজন করতে হবে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাস ও কারিকুলাম যুগোপযোগী করতে হবে। করতে হবে বাণিজ্যিক কৃষি কৌশলজ্ঞান সংবলিত সিলেবাস প্রণয়ন। কৃষির উন্নয়ন করতে হলে এর বিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এবং কৃষক ও কৃষি গ্র্যাজুয়েটরা কীভাবে সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করবে, তাও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। কৃষিকে কীভাবে নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত টেকসই করা যায় তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কারিকুলামে প্রয়োগিক শিক্ষার ওপর বিশেষ করে ইন্টার্নশিপের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষকের সঙ্গে ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েটদের ইন্টার্নশিপে বেশি করে যুক্ত রাখতে হবে। বাংলাদেশে কৃষি দ্রুত বাণিজ্যিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলকে এসব জায়গায় সম্পৃক্ত করতে না পারলে এগুলো বিদেশি বিশেষজ্ঞদের হাতে চলে যেতে পারে। কৃষিপণ্যকে কীভাবে বিভিন্ন পণ্যে রূপান্তর করে মূল্য সংযোজন করা যায় তা এ দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। সেটি কীভাবে করা যায় তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। কৃষিকে টেকসই করার প্রয়াসে কৃষির গ্র্যাজুয়েটদের বাণিজ্যিকীকরণ জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য কারিকুলামে মার্কেটিং, শিল্পোদ্যোগ, সাপ্লাই চেইন, যোগাযোগ ও নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা, কৃষি প্রক্রিয়াজাত, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুুক্তি জ্ঞানবিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। নগরীয় কৃষি হলো, কোন নগর ও তার আশপাশে খাদ্যশস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিতরণ ও বাজারজাতকরণের সব কার্যক্রম। শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনই নয়; শাকসবজি, ফলমূল, ভেষজ ও শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ, মাশরুম, মাছ ও জলজ প্রাণীর চাষ, হাঁস-মুরগি, পশু পালন এবং দুগ্ধ উৎপাদনসহ সব কার্যক্রমই নগরীয় কৃষির অন্তর্ভুক্ত। নগরীয় কৃষির উদ্দেশ্য হলো এক. নগরবাসীর জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা। দুই. নগরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। তিন. নগরবাসীর মধ্যে স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। চার. কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে নগরবাসীর আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। পাঁচ. নগরের বর্জ্য থেকে জৈব সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ছয়. বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, মাটি ও পানিদূষণের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করা। সাত. নগরের সব ভবনের ছাদ ও বারান্দায় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অব্যবহƒত জমিতে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা। আট. নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কল্পে রাস্তার ধার, ব্যালকনি ও ছাদ সবুজায়ন করা। এছাড়া নগরের তাপমাত্রা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায়ও নগরীয় কৃষি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবরোধের কারণে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র কিউবার খাদ্য, জ্বালানি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানির পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন অর্ধেক হ্রাস পায়। দেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। কিউবা পড়ে মহাবিপদে। এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য কিউবা তাদের বাগান, পার্ক, সরকারি অফিসের পরিত্যক্ত জায়গা, বাড়ি-ঘরের ছাদগুলোকে কৃষি কাজে ব্যবহার শুরু করে। তারা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সার বিশেষ করে কেঁচো কম্পোস্ট ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে দিকে নজর দেয়। সরকার নগরীয় কৃষি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। নগরীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উপকরণ সরবরাহ এবং সরকারি পরিত্যক্ত জায়গায় কৃষকদের আবাদ করার অধিকার দিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে। ফলে কিউবা অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য সংকট সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। বর্তমানে হাভানা নগরে ৮ হাজারের বেশি কৃষি খামার রয়েছে। এসব খামারের ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৩ লাখ ২২ হাজার মানুষ নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। তারা বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি ও ফলমূলের পাশাপাশি উৎপাদন করছে ডিম, দুধ ও মাংস। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন নগরবাসীর কাছে। সরবরাহ করছেন স্কুল, হাসপাতাল ও হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে। এসব খাবার তরতাজা, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, নিরাপদ ও বিষমুক্ত। এতে নগরবাসীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে। এ নতুন কৃষি ব্যবস্থার আরো সুবিধা হলো এটি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং কম কার্বন নিঃসরণকারী। এতে নগরবাসী হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস টাইপ২-এর মতো রোগ থেকে রক্ষা পায়। কিউবার এই নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাদের কর্মসূচিতে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫৪ ভাগের বেশি লোক নগরে বসবাস করে। যত দিন যাচ্ছে, নগরবাসীর সংখ্যা ও নগরীয় খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর কমপক্ষে ৮০ কোটি লোক বর্তমানে কোনো না কোনো নগরীয় খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। চীনের সাংহাইয়ে চাহিদার শতকরা ৬০ ভাগ শাকসবজি, ১০০ ভাগ দুধ, ৯০ ভাগ ডিম এবং ৫০ ভাগ মাংস উৎপাদিত হয় নগরীয় কৃষির মাধ্যমে। ব্যাংককে শতকরা ৬০ ভাগ জমি কৃষি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সেখানকার শতকরা ৭২ ভাগ মানুষ নগরীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত। ব্যাংকক, বেইজিং ও সিউলের বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোর মিনি পুকুরে ভোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মাছ উৎপাদন করা হয় নগরীয় কৃষির মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি লোক নগরে বসবাস করেন। ২০৩০ সালে সাড়ে ৮ কোটি এবং ২০৫০ সালে শতভাগ লোক নগরে বসবাস করবেন। নগরের বসবাসকারী এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন করা কোনো অবস্থাতেই সম্ভব হবে না। এজন্য জাতীয় কৃষিনীতিতে নগরীয় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকাণ্ডে নগরীয় কৃষিকে যুক্ত করতে হবে। কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে নগরীয় কৃষিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এটা এখন সময়ের দাবি, আগামী দিনের নগরীয় বাংলাদেশ বিনির্মাণের দাবি এটাকে কোনো অবস্থাতেই আর উপক্ষো করার সুযোগ নেই। নিতাই চন্দ্র রায় : কলাম লেখক ও কৃষিবিদ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App