×

মুক্তচিন্তা

মুখোশে ঢাকা ভোট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০১ পিএম

১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মধ্যেই আমেরিকার মিডটার্ম নির্বাচন হয়েছিল। ভোটকর্মী ও ভোটার সবার জন্যই সেই সময়ে মাস্ক বাধ্যতামূলক ছিল। মুখোশে আবৃত নির্বাচন বলে সেই নির্বাচনকে তকমা লাগিয়েছিল অনেকেই। শতাব্দী শেষে আবারো আমেরিকায় হতে যাচ্ছে মুখোশে ঢাকা ভোটযুদ্ধ। ভারতের বিহার বিধানসভার ভোটও হতে যাচ্ছে করোনাকালে। বাংলাদেশেও কয়েকটি উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তারপরই হয়তো স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সম্প্রতি ক্রোয়েশিয়ায় হয়ে গেল তাদের জাতীয় নির্বাচন। সেখানে ভোটের হার ছিল অনেকটাই কম। কিন্তু এই সময়ে হওয়া পোলান্ডের জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার এবারের ভোটে ভোট পড়েছে ৬৬ শতাংশ, যা গতবারের চেয়ে বেশি। আমেরিকায় আগামী নভেম্বরে ভোটের হিসাবটা কী হয় তা-ই এখন দেখার পালা। আমেরিকার ভোটের ঠিক পাঁচ দিন পর মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। করোনাকালীন নির্বাচনের ছবিটা মিশ্র। ক্রোয়েশিয়ায় কম ভোট পড়লেও পোল্যান্ডে বেশি পড়েছে। আমেরিকায় ঠিক কী হতে যাচ্ছে, তার ওপর এখন পৃথিবীর মানুষের চোখ। আমেরিকাতে মৃত্যু, অসুস্থতা আর সংক্রমণের ভয় প্রদত্ত ভোটের হার কমিয়ে দিতে পারে। প্রিয়জনকে হারিয়ে কিংবা ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বহু মানুষের কাছেই হয়তো ভোট দেয়াটা প্রাধান্য নাও পেতে পারে। ঠিক এমনটাই হয়েছিল তাদের ১৯১৮ সালের নির্বাচনে। তখন ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ, আগের বারের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। তখন অবশ্য স্প্যানিশ ফ্লুর প্রভাবের পাশাপাশি ২০ লাখ মার্কিন সৈন্য যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আমেরিকার এবারের নির্বাচনে বেশি ভোট পড়ার অর্থ হতে পারে ট্রাম্পের জন্য পরাজয়ের কারণ। সেখানে ভোট বাড়ার সাধারণ অর্থ হবে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছে অল্পবয়সি ভোটার, অশ্বেতাঙ্গ ও অল্প রোজগেরে ভোটার। এরা মোটের ওপর ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। অন্যদিকে ভোট কম পড়ার ফলও ট্রাম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আমেরিকান ভোটারদের ২৭ শতাংশই ৬৫ ঊর্ধ্ব, যাদের বেশিরভাগ রিপাবলিকান ভোটার। এই বয়সিদের মধ্যে করোনায় মৃত্যুর হার বেশি। সংক্রমণের কাতারেও এই বয়সিদের সংখ্যা বেশি। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটি বিশ্বাস এই বয়সিদের মনেও দোলা দিয়েছে। কাজেই এই বয়সি ভোটারদের এবার ভোট দিতে আসার সম্ভাবনা কম হতে পারে। আর সেই সুযোগটাই বাইডেন কাজে লাগাতে পারেন। মেইল-ইন ভোট নিয়ে এবার ট্রাম্প কারচুপির গন্ধ খুঁজছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প যা-ই বলেন, আমেরিকাতে মেইল-ইন পদ্ধতির ভোট ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়। আগে থেকে তারা ডাকযোগে বা নির্দিষ্ট ড্রপবক্সের মাধ্যমে ভোট দিতে পছন্দ করেন। ২০১৬ সালে মেইল-ইন ভোট ছিল ২৩.৬ শতাংশ। এবার করোনার কারণে এই অনুপাতটা আরো বাড়তে পারে। ভাইরাসের মোকাবিলা নিয়ে আমেরিকাতে চলছে রাজনৈতিক প্রচার। এখানে সমস্যায় পড়েছেন ট্রাম্প। করোনাকে প্রথমে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে অনেকেই মনে করেন, করোনা মোকাবিলায় ট্রাম্প ব্যর্থ। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতিটি নির্দয়তার দিক থেকে তুলনাহীন। ২০১৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন পাওয়ার অভিযান শুরু করেন মেক্সিকো থেকে আসা অভিবাসনকারীদের অপরাধী, মাদক কারবারি, ধর্ষক বলে চিহ্নিত করে। দাবি ছিল প্রেসিডেন্ট হলে তিনি মেক্সিকো সীমান্তে এক বিশাল প্রাচীর তুলবেন বেআইনি অভিবাসন ঠেকানোর জন্য। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি এ দেশে মুসলমানদের প্রবেশ করতে দেবেন না। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য বেআইনি হলেও ট্রাম্প এসব ঘোষণা দিতে পিছপা হননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পরই তিনি নির্দেশ দেন, পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু মুসলিম প্রধান দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। প্রবল প্রতিবাদ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীর আনা মামলার জেরে আদালতের আদেশে এই নীতি বাতিল হয়। বর্তমানে করোনার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতির অজুহাতে কর্মসূত্রে অভিবাসন বন্ধ করেছেন ট্রাম্প। তিনি আমেরিকার দুয়ার আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাতে তার ভোট বেড়েছে, আবার কমেছে। কতটা বেড়েছে বা কমেছে তা-ই বলে দেবে আগামী নভেম্বরের নির্বাচন। ট্রাম্পের ২০১৬ সালের জয় এবং ব্রেক্সিট দুনিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দেয়া দুটি ঘটনার পেছনে যে কোম্পানি, সেই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নিজেদের কাজটিকে বর্ণনা করে ‘ডেটা ড্রিভেন বিহেভিয়র চেঞ্জ’ বলে। তাদের কাজটা তাদের কাছে সহজই। যদি দেখা যায়, কারো মনে মুসলমানদের প্রতি ভয়, তবে তার নিউজফিডে বারবারই আসতে থাকবে মুসলমান সন্ত্রাসবাদের বাড়াবাড়ি নিয়ে ভিডিও, অনেকের কমেন্ট এবং ব্লগ। কীভাবে মুসলমানরা দখল করে নেবে গোটা পৃথিবীকে সেই বিষয়ে ভুয়া তথ্যসমৃদ্ধ নিউজ। সবাই ভাবতে থাকে, সে যা ভাবছে সবাই তা-ই ভাবছে। বিপদের গন্ধ পেলে মানুষের প্রতিক্রিয়া তীব্রতর হয়, তার আচরণ পাল্টে যায়। আমরা প্রায়ই যা ভাবছি যে হাতের মুঠোয় বিশ্ব নিয়ে ঘুরছি, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া আসলে আমাদের মগজ নিয়ে খেলছে। আমরা হয়ে পড়ছি সোশ্যাল মিডিয়ার হাতের পুতুল। এটা ক্যাপিটালিজমের নতুন আবিষ্কার ‘এক্সট্র্যাকশন’। কোনো দাম না দিয়েই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের মতো ফেসবুক এবং ইন্টারনেট একইভাবে আমাদের মনোযোগ এক্সট্র্যাকশন করছে আমাদের মগজ থেকে। আমেরিকার মানুষকেও তারা তাই করছে। সেই খেলায় এই নতুন ক্যাপিটালিজম এবার ট্রাম্প না বাইডেনকে বেছে নেবে তা-ই সামনে দেখার পালা। সারা পৃথিবীই এখন তাকিয়ে আছে আমেরিকার নির্বাচনের দিকে। এদিকে ট্রাম্পকে করোনাও ছুঁয়ে গিয়েছে। সেখানেও তিনি করেছেন অনেক নাটক। মাস্ক নিয়ে করেছেন হাসি-ঠাট্টা। কিন্তু তারপরও তার হাতে আছে কিছু গোষ্ঠীভুক্ত ভোটার। সবাই যেখানে দেখেন ট্রাম্পের পাগলামি, সেখানে তারা দেখেন ট্রাম্পের দৃঢ়চেতা মনোভাব। এই গোষ্ঠীর কাছে ট্রাম্প যা-ই করুক, তারা আছেন ট্রাম্পের পেছনে। মানবতার কথা বলেন না বলেই তাদের কাছে ট্রাম্পের কদর বেশি। অন্যদিকে অভিবাসনকারী, কালো আর ব্রাউন ভোটাররা বসে আছেন জোটবেঁধে বাইডেনকে তুলে ধরার জন্য। আমেরিকানরা মাস্ক পরে আবারো একবার তাদের যুদ্ধে নামতে যাচ্ছে। যুদ্ধের ময়দান এবার নানা কারণে খণ্ড-বিখণ্ড টেকনোলজি ক্যাপিটালিজম কী খেলা খেলছে তা-ও স্পষ্ট নয় এখনো। সব মিলিয়ে কারো জন্যই এবারের আমেরিকার ভোটযুদ্ধ সহজ হবে না। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো কয়েকদিন। ইতোমধ্যে করোনার নেগেটিভ রেজাল্ট পাওয়ার আগেই ট্রাম্প হাসপাতাল ছেড়ে হোয়াইট হাউসে। প্রচারণার জন্য মুখিয়ে আছেন তিনি। বাইডেন, কমলা হ্যারিসও কম যাচ্ছেন না। ট্রাম্পের গত চার বছরের কার্যকলাপ আমেরিকার বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে বিচার করছেন। মাস্ক নিয়ে বাইডেনকে তামাশা করে কথা বলা ট্রাম্প নিজেই যখন করোনায় আক্রান্ত, তখনো তার উগ্র সমর্থকরা তার কথার তালেই নাচছেন। অন্যরা কোমর বেঁধে নামছেন। মিথ্যাবাদী, পাগল প্রকৃতির মতো একজন মানুষ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কীভাবে পুনরায় পাস করেন তা ভেবে ভেবে অস্থির হচ্ছেন এই শ্রেণির আমেরিকানরা। বেশ জমে উঠেছে খেলা। অগ্রিম ভোট এবং জনসাধারণের গতি-প্রকৃতি দেখে অনেক পর্যবেক্ষকই মন্তব্য করেছেন, এবার হয়তো আমেরিকাতে নতুন ইতিহাস রচিত হবে। দুবার পরপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসার স্বপ্ন ট্রাম্পের পূরণ না-ও হতে পারে। তবে এটাও অনেকের চিন্তায় এসে গেছে যদি তেমনটাই হয়, ট্রাম্প কি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন সহজভাবে? নাকি মেইল-ইন ভোট নিয়ে ট্রাম্পের শুরু করা বিতর্ক আরো তীব্র হয়ে প্রচার পাবে ভবিষ্যতে? সেই সুযোগটাই কি তিনি নেবেন? মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App