×

অর্থনীতি

জাপানি বিনিয়োগে নজর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৬ এএম

জাপানি বিনিয়োগে নজর

জাপানি বিনিয়োগ

বড় বিনিয়োগের আশা দেখাচ্ছে সূর্যোদয়ের দেশ। বিনিয়োগকারীদের কারখানা স্থাপনে বিশেষ ছাড় দেয়ার কথা ভাবছে সরকার। আরো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ চান জাপানি উদ্যোক্তারা।

জাপানের আরেক নাম হচ্ছে নিপ্পন। যার অর্থ হচ্ছে সূর্যোদয়ের দেশ। বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের দ্বার খুলতে যাচ্ছে সেই সূর্যোদয়ের দেশটি। করোনা মহামারির ধাক্কায় নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজতে শুরু করেছে জাপানের কোম্পানিগুলো। জাপানিদের কাছে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আপাতত জাপানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও। দেশটির বিনিয়োগ ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীদের কারখানা স্থাপনে বিশেষ ছাড় দেয়ার কথাও ভাবছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এজন্য সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে টেলিসংলাপও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে জাপানি উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও বিনিয়োগকারীরা আরো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ চায়।

জানা গেছে, উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়ানোসহ আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ ও সর্বশেষ ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের কারণে ভূরাজনীতিতে চাপে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। চীনের এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ বিনিয়োগের পথ খুঁজতে শুরু করেছে জাপানের কোম্পানিগুলো। জাপানিদের কাছে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, ওয়ান স্টপ সার্ভিস, গ্যাস বিদ্যুতের নিশ্চয়তা ও সস্তাশ্রম- এ চার কারণে জাপানি বিনিয়োগকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাংলাদেশ। রপ্তানিমুখী দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও একই প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা।

জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, জাপানি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, চীন থেকে বর্তমানে জাপান যত আমদানি করে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ জাপানের নিজস্ব বিনিয়োগ। জাপানের বিনিয়োগকারীরা চীনে বিনিয়োগ করে তা জাপানে রপ্তানি করে। এটাই হচ্ছে চীন থেকে জাপানের ৭০ শতাংশ আমদানি। এ ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ জাপান চীন থেকে সরিয়ে অন্য দেশে স্থানান্তর করতে চাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ।

মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বে অব বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট গ্রোথ বেল্ট’ বা ‘বিগ বি’ এর আওতায় বর্তমানে জাপান সরকার চাচ্ছে বড় আকারে বিনিয়োগ বের করে নিয়ে আসবে। সে হিসেবে মাতারবাড়ি প্রকল্পে বড়সড় আকারে তারা এসেছে। সেখানে অবকাঠামোর যে দুর্বলতা রয়েছে সেসব জায়গাগুলোতেও তারা বিনিয়োগ করছে। পাওয়ার স্টেশন বানাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটা অনেক বড় সুযোগ। বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েট করছে এবং শূন্য শুল্ক সুবিধা আস্তে আস্তে চলে যাবে- এরকম একটা অবস্থায় এ ধরনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো, রপ্তানি বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজে

লাগবে। তাই জাপানি বিনিয়োগ যেন আরো বাড়ানো সম্ভব হয় এজন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন। যেমন- ওয়ান স্টপ সার্ভিস, ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) এক্ট বাস্তবায়ন, ওএসএস অ্যাক্ট অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেঁধে দেয়া সেবাগুলো যেন দিতে পারি, প্রতিযোগিতা সক্ষমতার পরিবেশ আরো ভালো করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ব ব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচক বাড়ানোর পাশাপাশি জাপানি বিনিয়োগকারীদের সমস্যা সমাধানে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জাতীয় বৈষম্য দূর করা না হলে জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত হবে না বলেও মনে করেন তারা। চীন থেকে দূরে সরে যাওয়া জাপানি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আগে থেকে যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করছে তাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। কারণ, বিদ্যমান কোম্পানিগুলো নতুন জাপানি বিনিয়োগ আনতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, অধিক সম্ভাবনা ও লাভের কারণে আগামী দুই বছরে জাপানি কোম্পানিগুলো এশিয়া ও ওশেনিয়ায় তাদের ব্যবসা স¤প্রসারণ করতে চাইছে। সেখানে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে থাকবে। বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ স¤প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। আর ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ কোম্পানি একই অবস্থায় থাকবে। মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ কোম্পানি ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ কমানোর বিবেচনা করছে বলে জেট্রোর সমীক্ষায় বলা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৮৭টি জাপানি কোম্পানি তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চীন থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত করার বিষয়ে বিবেচনা করছে। জাপান সরকার এগুলোকে বাংলাদেশ বা ভারতে স্থানান্তরিত করলে তাদের ২২ দশমিক ১০ কোটি ডলার ভর্তুকি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।

জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার : বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আপাতত জাপানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকারও। দেশটির বিনিয়োগ ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি বিশেষ ক্ষেত্রে জাপানি কোম্পানি বা বিনিয়োগকারীদের কারখানা স্থাপনে বিশেষ ছাড় দেয়ার কথাও ভাবছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে। সে বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে নানাভাবে কাজ করছে সরকার। এজন্য সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে টেলিসংলাপও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ-জাপানের সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপ (জুম প্ল্যাটফরমে ভার্চুয়ালি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সহজ করা, করনীতির জটিলতা কমানো ও শুল্কবাধা দূর করার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। এর আগে গত ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক এবং  ৫ আগস্ট দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর টেলিসংলাপের পর একটি সারমর্ম তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জাপান দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়েছে।

ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন চান জাপানি উদ্যোক্তারা : জাপানি বিনিয়োগকারীরা বলছেন, বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ পেতে হলে ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন করতে হবে। এর মধ্যে ট্যাক্সেস বা করনীতি, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও ব্যবসার মুনাফার অংশ নিজ দেশে প্রত্যাবাসন পদ্ধতিগুলো আরো সহজ করতে হবে। পাশাপাশি যেসব জাপানি বিনিয়োগকারী এ মুহূর্তে এ দেশে বিনিয়োগরত আছেন, তারাও নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সেগুলো দূর করতে হবে। অবশ্য এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে করনীতি সহজ করা, বন্দরসুবিধা আরো উন্নত করা, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও কাস্টমস জটিলতা নিরসনে নেয়া উদ্যোগগুলোর অগ্রগতি চান জাপানি উদ্যোক্তারা।

আশা জাগাচ্ছে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল :  বাংলাদেশও জাপানি বিনিয়োগ পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে জাপানিদের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে, যার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি উন্নয়ন করছে জাপানের সুমিতমো করপোরেশন। জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২১ সালে কারখানা করার উপযোগী হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহায়তায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক দরজায় সেবা বা ওয়ান স্টপ সার্ভিসও চালু করেছে বেজা। যদিও তাতে বেশ কিছু সেবা যুক্ত করা এখনো বাকি। বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম জেট্রোর ঢাকা কার্যালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছেন, জাপান বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার যে কৌশল নিয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ খুবই আগ্রহী। এফবিসিসিআই চায়, জাপান কারখানা সরিয়ে বাংলাদেশে আনুক। চীন থেকে সরে যাওয়া কারখানা এ দেশে আনতে বাড়তি সুবিধা দেয়ার চিন্তা করছে সরকারও। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, চীন থেকে দূরে সরে যাওয়া জাপানি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নতুন করে বিনিয়োগের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আগে থেকে যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করছে তাদের সমস্যা সমাধান করতে হবে। কারণ, বিদ্যমান কোম্পানিগুলো নতুন জাপানি বিনিয়োগ আনতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করবে।

আড়াইহাজারে জাপানি বিনিয়োগ হবে এশিয়ার বৃহত্তম : বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় জাপানি বিনিয়োগে এককভাবে এক হাজার একর অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) তৈরি করা হচ্ছে। সরকার-সরকার উদ্যোগে এটি বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এরপর পাঁচ বছর চলমান জাপানি বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত ৩ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় এসব কথা বলেন। ওই সভায় টিপু মুনশি বলেন, জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় অংশীদার। জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে আরো বাণিজ্য সুবিধা দিলে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে।

‘চীন থেকে বেরিয়ে’ বাংলাদেশে এলে ভর্তুকি পাবে জাপানি কারখানা : উৎপাদন কার্যক্রম চীন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে নিলে জাপানি মালিকানাধীন কারখানা ভর্তুকি পাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। নতুন গন্তব্যের তালিকায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও আছে বলে জানিয়েছে সম্প্রতি জাপানের অর্থনীতি বিষয়ক প্রভাবশালী পত্রিকা নিক্কে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের সরবরাহ শৃঙ্খলে বৈচিত্র্য আনতে সরকারি প্রোগ্রাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাংলাদেশ-ভারতকে তালিকায় যুক্ত করা হলো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App