×

মুক্তচিন্তা

হোয়াইট হাউসে কে থাকবেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫০ পিএম

জো বাইডেন মন্দের ভালো মাত্র। তার আমলও ট্রাম্পের আমল থেকে মৌলিকভাবে পৃথক হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তারপরও হিলারি ক্লিনটন তো বটেই, বার্নি স্যান্ডার্সও তাকে মনেপ্রাণে সমর্থন করছেন। কেননা সংকটকালে ট্রাম্প-বাইডেনের মাঝে সামান্য পার্থক্যও মূল্যবান। বাইডেনের বিজয় তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি, কিন্তু ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থেকে সরাতে পপুলার ভোটের চেয়েও তাদের বেশি শক্তির প্রয়োজন হবে।
মানুষকে আনন্দ দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জুড়ি নেই। রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকেই তিনি একর পর এক এতসব হাস্যকর কাণ্ড করেছেন যে বলে শেষ করতে দিস্তাখানেক কাগজ লাগবে। হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, অতএব সমস্যা ছিল না যদি না তিনি বহু অপকর্মেরও আধার হতেন। অহরহ মিথ্যা বলা, জাতিবিদ্বেষ প্রচার, ঠকবাজি, যুদ্ধোন্মাদনা কোনো কিছুতেই তিনি কম না, যার বিবরণ শেষ করতে আরো কয়েক দিস্তা কাগজ লাগবে। মিথ্যা বলা তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো, যা না করে তিনি থাকতেই পারেন না। তার মিথ্যা কথা ও বিভ্রান্তিকর বিবৃতির রেকর্ড শুনলে দুনিয়ার যে কারোরই মাথা ঘুরে যাবে, ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাব মতে ২০১৭ সাল থেকে এ বছর মাঝ জুলাই পর্যন্ত মাত্র চার বছরে এ সংখ্যা ২০ হাজার। বিবেকবান মানুষরা এ পর্যন্ত তার মাঝে ভালো কিছু খুঁজে পেতে চরম পরিমাণে ব্যর্থ হয়েছেন, না ক্ষমতায় থাকাকালে না আগে। কিন্তু লোক হাসানোর ক্ষমতারও একটা সীমা আছে। ট্রাম্প এখন সেখানে ঠেকে গেছেন। দিনে দিনে তার হাস্যকর কথা ও কাজগুলো খুবই একঘেয়ে হয়ে উঠছে। নিজ দেশে ও বাইরে মানুষ তার প্রতি বিরক্ত হচ্ছে এখন। তবে একঘেয়ে তিনি যতই হন, ক্ষতি করার ক্ষমতা তার মোটেও কমছে না। যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় তার ব্যর্থতা চরম। অথচ তিনি সবসময় গলা ফুলিয়ে এ কাজে তার সাফল্য বলে বেড়াচ্ছেন। এ সাফল্য নাকি আর কারো পক্ষেই সম্ভব হতো না। ঠিক, মুহূর্তে করোনা সংক্রমণ দূর করার এক বিরাট জাদুকরি শক্তি আছে তারÑ পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া, তাহলেই সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই শেষ হয়ে যাবে! বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের সবসময় বিদ্রƒপ করে বেড়াচ্ছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পূর্ব বিতর্ক মঞ্চে প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে খুব করে ভ্যাঙালেন মাস্ক পরার জন্য। তবে করোনা তাকে ছাড়ল না, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিকে কানে ধরে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকাল। জীবনে এই প্রথম তিনি একটা খবর দেখলেন যা ভুয়া নয়। গণমাধ্যমগুলো তার করোনা সংক্রমিত হওয়ার খবর প্রচার করল, কিন্তু তিনি বলতে পারলেন না, সব ফাঁকি, ফেইক। তবে অনেক মার্কিনি ও অমার্কিনি মানুষ এবার বলাবলি শুরু করল, ট্রাম্পের অসুস্থতা একটা ভানমাত্র, ফেইকÑ বাইডেনের সঙ্গে বিতর্ক মঞ্চে না পেরে পালানোর কৌশল। অবশ্য আবার লোক হাসিয়ে ফিরে এসেছেন বীরদর্পে। এবার বিতর্কে ভালো করার সুবর্ণ সুযোগ ছিল ট্রাম্পের। ২০১৬ সালে যিনি শক্তিশালী ও ঝানু রাজনীতিক হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে মোটামুটি লড়ে গেলেন, বাইডেন তার কাছে তুচ্ছ হওয়ার কথা। তাছাড়া সমকালের সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ ও মেধাবী বার্নি স্যান্ডার্সকে মোকাবিলা করার বিপদ থেকে তো ডেমোক্র্যাটরা তাকে আগেই বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেমন ভদ্রলোক যে এবার সব গুলিয়ে ফেললেন তিনি। বিশে^র যেসব মানুষের এই বিতর্ক সার্কাসের সামনে বসে থাকার অঢেল ধৈর্য ছিল তারা কেবল ট্রাম্পের একটি ক্ষমতা দেখেই চমকিত হলোÑ কথার মাঝে কথা বলা, অপমানসূচক শব্দ ও বাক্য ব্যবহার, আক্রমণাত্মক ভঙ্গি ও প্রতিপক্ষকে ভ্যাঙানো। বাইডেন একসময় বাধ্য হলেন তাকে ‘ভাঁড়’ ও ‘শাটআপ’ বলতে। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন তিনি হোয়াইট হাউসটি কিছুতেই ছাড়বেন না, নির্বাচনে হার বা জিত যাই হোক না কেন। সুতরাং ক্ষমতা হস্তান্তরটা শান্তিপূর্ণ ও তেলতেলে হওয়ার সম্ভাবনা কম, যা মার্কিন ইতিহাসে একটি বড় ব্যতিক্রম। করোনা সংকটকালে দেশটিতে শান্তি ছিল না, কারণ লোকজন ঘরে বসে থাকতে পারেনি, রাস্তায় বেরিয়ে তাদের মিছিল করতে, পুলিশের মুখোমুখি হতে ও গুলি খেতে হয়েছে। শাদা ও কালো সব রঙের মানুষই একত্রিত হয়ে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে রুষে উঠেছে। এখন অনেকেই ভয় পাচ্ছে কিংবা কল্পনা করছে গৃহযুদ্ধটুদ্ধ বাধে কিনা, যদি ট্রাম্প সাহেব পরাজিত হয়েও মসনদ ছাড়তে রাজি না হন। সাংবাদিক-লেখক এলিজাবেথ ড্রু লিখেছেন (ঞযব ঘবীঃ ঈরারষ ডধৎ?, ২ অক্টোবর ২০২০, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট), ‘প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে ট্রাম্প যা করলেন তা গণতন্ত্রের প্রতি তার হুমকির সাম্প্রতিক উদাহরণ। তার রূঢ় আচরণ, কথা বলতে ক্রমাগত বাধা দেয়া, বাজে মন্তব্য ও বিকৃত উপস্থাপন হচ্ছে তাকে জবাবদিহি করার উপায়গুলো ধ্বংস করার অবিরাম প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ।’ ডযু ঘধঃরড়হং ঋধরষ : ঞযব ঙৎরমরহং ড়ভ চড়বিৎ, চৎড়ংঢ়বৎরঃু ধহফ চড়াবৎঃু গ্রন্থের লেখক (জেমস এ রবিনসনের সঙ্গে যৌথভাবে) ড্যারোন এইসমোগলু লিখেছেন (ওং অসবৎরপধ এড়রহম ঋধংপরংঃ?, ১৫ জানুয়ারি ২০২০, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট), ‘নিশ্চিত যে, দ্বিতীয় ট্রাম্প আমল মার্কিন প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করবে।’ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিৎজ লিখেছেন (ঞযব জবঢ়ঁনষরপধহ ঞযৎবধঃ ঃড় ঃযব জবঢ়ঁনষরপ, ২ অক্টোবর ২০২০, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট), ‘এবারকার নির্বাচনে আমেরিকার গণতন্ত্রই হুমকির মুখে।’ এটা ‘এখন শূন্যে ঝুলছে’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাবেক জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েলের মতে, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচন যে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ^কে বিপদের মুখে ফেলবে তা প্রশ্নাতীত। তাছাড়া ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, একটি হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রকে এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সাংবিধানিক সংকটে এবং হয়তো নাগরিক বিশৃঙ্খলার মাঝে ফেলে দিতে পারে।’ (ঞযব এষড়নধষ জরংশ ড়ভ ঃযব টঝ ঊষবপঃরড়হ, ২৬ আগস্ট ২০২০, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট) জনমত জরিপে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন। সে তো হিলারি আরো বেশি ছিলেন। ব্রিটেনে ব্রেক্সিটবিরোধীরাও ব্রেক্সিটপন্থিদের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল হলো জনমত জরিপের উল্টা। বিতর্কমঞ্চে হারজিত বা ভালোমন্দ করার ওপরও এ নির্বাচনের ফল নির্ভর করছে না বললেই চলে। অতএব বাইডেনদের খুশিতে নাচার কিছু নেই। তাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। আর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাইডেনকে ইলেক্টোরাল কলেজ ও গণভোট দুই ক্ষেত্রেই জিততে হবে। কেবল গণভোটে বিজয় হিলারি ক্লিনটন ও আল গোরের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। তাহলেই চিন্তা করা যেতে পারে হোয়াইট হাউস থেকে ট্রাম্পের শান্তিপূর্ণ প্রস্থান। উভয়ক্ষেত্রে বড় রকম জয়লাভ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে এবার নির্বাচনে ভালো কিছু আশা করা কঠিন। তবে আগে থেকেই অনেকে হিসাবে রাখছেন যে, জো বাইডেন মন্দের ভালো মাত্র। তার আমলও ট্রাম্পের আমল থেকে মৌলিকভাবে পৃথক হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তারপরও হিলারি ক্লিনটন তো বটেই, বার্নি স্যান্ডার্সও তাকে মনেপ্রাণে সমর্থন করছেন। কেননা সংকটকালে ট্রাম্প-বাইডেনের মাঝে সামান্য পার্থক্যও মূল্যবান। বাইডেনের বিজয় তাই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি, কিন্তু ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস থেকে সরাতে পপুলার ভোটের চেয়েও তাদের বেশি শক্তির প্রয়োজন হবে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সামনে এখন সেটাই চ্যালেঞ্জ। আলমগীর খান : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App