×

অর্থনীতি

পাটপণ্যের সুদিন ফিরেছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৪ এএম

বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়েছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বড় উল্লম্ফন

করোনা মহামারির মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের রপ্তানি খাত। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি এক সময়কার ‘সোনালি আশ’ পাটে ভর করে প্রতি মাসেই রেকর্ড গড়ছে রপ্তানি বাণিজ্য। তবে তৈরি পোশাকের চেয়েও করোনাকালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বড় উল্লম্ফন ঘটেছে পাটে। যে সময়টাতে পাটে এমন প্রবৃদ্ধি, ঠিক সে সময়ে সরকারি ২৫ পাটকল বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাটখাতের ৪৫ শতাংশই ছিল সরকারি পাটকলগুলোর আওতায়। তবে বেশিরভাগ পণ্য রপ্তানি করা হয় বেসরকারিখাতের মাধ্যমে। তাই বেসরকারি পাটকলগুলো সচল থাকায় পাট খাতে এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে না। এছাড়া কৃষকরা কাঁচা পাটের দামও অনেক ভালো পাচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।

সরকারি পাটকলগুলো বন্ধে এ খাতে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, সরকারি জুটমিলগুলো ট্র্যাডিশনাল পণ্য উৎপাদন করত। এছাড়া দেশের চাহিদা পূরণ করাই ছিল বিজেএমসির প্রধান লক্ষ্য। তবে অধিকাংশ পণ্য রপ্তানি করত বেসরকারি জুটমিলগুলোই। এখন সরকার এ খাতে নজর বাড়িয়েছে। ফলে আগের বেসরকারি জুটমিলগুলোর পাশাপাশি নতুন করে অনেকেই যুক্ত হচ্ছেন। এজন্য গত জুলাই মাসে সরকারি জুটমিলগুলো বন্ধ হলেও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং গত জুলাই মাসে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তারা বলেন, সরকারি মিলগুলো বন্ধ হলেও এখনো এসব মিলে অঘোষিত এক লাখ বেল পাটপণ্য রপ্তানির আদেশ রয়েছে। এছাড়া গত বছরের তুলনায় কাঁচা পাটের দামও অনেক বেড়েছে।

গত বছর ১৩০০-১৪০০ টাকা দাম হলেও এবার প্রায় ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে কাঁচা পাট। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) অতিরিক্ত সচিব ও চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ ভোরের কাগজকে বলেন, বিজেএমসির মজুতে থাকা পণ্য থেকে সুদানে পাটের তৈরি পাতলা চট রপ্তানি শুরু করেছে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও সিরিয়াতেও রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের চাহিদা পৃথিবীর সর্বত্র বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য বর্জনের অবস্থানে পাটের তন্তু ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এজন্যই বিশ্ব ব্যাণিজ্যে পাটের চাহিদা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তবে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেলের মতে, সরকারি কারখানা বন্ধে একটু হলেও প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, বিজেএমসি পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি করতো। আমরাও তাদের কাছ থেকে নিয়ে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতাম। তাই প্রথম দিকে একটু প্রভাব পড়বেই। তবে বেসরকারি পাটকলগুলো সক্রিয় হলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন সোহেল। তিনি বলেন, আবার সরকার বলছে, বন্ধ মিলগুলো পিপিপির মাধ্যমে দ্রুত চালু করা হবে। দেখা যাক কী হয়।

পাট উৎপাদনে বিশ্বে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও রপ্তানিতে শীর্ষে। অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পাটের মানও ভালো। বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় এবং উৎপাদন হয় ৭৪ দশমিক ৪০ লাখ টন। দেশের প্রায় ৫০ লাখ কৃষক পাট চাষের সঙ্গে জড়িত। মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা ৩-৪ ভাগ আসে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচা পাটের ৯০ শতাংশ রপ্তানি করে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সংকটেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এদিকে চলতি বছর পাটের উৎপাদন কম হয়েছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ মিলগুলোর উৎপাদন ঠিক রাখাও জরুরি। এ কারণে চাহিদার বিপরীতে কাঁচা পাটের জোগান নিশ্চিতে প্রতি টন পাট রপ্তানির ওপর ২৫০ মার্কিন ডলার হারে রপ্তানি শুল্ক আরোপের দাবি জানিয়ে আসছেন পাটশিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তবে এ দুটি দাবির বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কী হবে তা প্রধানমন্ত্রীর মতামতের ওপর নির্ভর করছে বলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে দেশেও কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়। এ ভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে প্রায় এক মাসের মতো সব কারখানা বন্ধ থাকে। এমন সময় গত জুলাই মাসে সরকার বিজেএমসির আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠায়। এ পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রপ্তানি হতো। তবে এর মধ্যেও গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাট খাত থেকে। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১২ শতাংশের মতো।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে সংকটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১০২ কোটি ডলার। আর পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। সে হিসেবে এক বছরে চামড়ার রপ্তানি যতটা কমেছে, তার তুলনায় পাটের রপ্তানি বেড়েছে সামান্যই। তারপরও করোনা ভাইরাসের কারণে গেল অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বড় সব খাতের রপ্তানি আয়ে ধস নামলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ে বরাবরই দেখা গেছে উল্টো চিত্র।

এ বিষয়ে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জাহিদ মিয়া বলেন, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এ সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রপ্তানি অনেক বাড়বে; এ মহামারির বছরেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।

মূলত, পাট এমনই একটি ফসল, যার আঁশ থেকে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার, কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, গয়না, অলংকারসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য, যা দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এছাড়া পাতা থেকে তৈরি হয় চা, পাটকাঠি জ্বালানি ও চারকোল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ চারকোল বা ছাই বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের ছাই রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। ছাইয়ের বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে। পাট বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)’ ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পাট পণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App