×

সাহিত্য

নীলফামারীর শিল্পীরা মাছ বিক্রি ও নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০, ১১:০২ এএম

নীলফামারীর শিল্পীরা মাছ বিক্রি ও নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছে

মণিপুরী নৃত্য পরিবেশন করছেন শিল্পীরা। ফাইল ছবি।

ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের এক অপার সমন্বয় ঘটেছে নীলফামারীতে। যে শহরে দর্শনীয় স্থানের যেন কোনো অভাব নেই! এর মধ্যে ৫টি স্থাপনা সারাদেশেই জনপ্রিয়। এগুলো হলো নীল সাগর, তিস্তা ব্যারাজ, নীলকুঠির, চিনি মসজিদ ও কুন্দুপুকুর মাজার। এছাড়া কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নীলফামারীর ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়।

জানা যায়, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে নটখানায় নীলচাষের একটি বৃহৎ খামার ছিল। ১৮৪৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দে নীলচাষে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে নেমে আসে নিরীহ কৃষকদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার। ১৮৫৯-৬০ সালে কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলাকা ছেড়ে নীলকরেরা পালিয়ে যায়। সেই নীলখামার থেকে নীলখামারী আর বর্তমানে নীলফামারী নামের সার্থকতা লাভ করে। তাই জেলাবাসীর মুখে মুখে বহমান নীলখামারের নীলখামারী-নীল বিদ্রোহে আজ নীলফামারী।

এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, বুড়িখোড়া নদী, বুড়ি তিস্তা, ইছামতি, চাঁড়ালকাটা, সর্বমঙ্গলা, যমুনাশ্বরী, সালকী, কুমলাইসহ অনেক নদনদী।

ইতিহাস বলছে, দুই শতাধিক বছর পূর্বে এই অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করেন ইংরেজরা। এখানকার উর্বর মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এ জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারী, রামনগর, বাঙালি পাড়া বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। সেই সময় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে নীলফামারীতেই বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদিত হতো। উর্বর মাটির গুণে নীলকরদের ব্যাপক আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। এমন ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের শহর নীলফামারী আজ করোনার হানায় নীল হয়ে আছে ৭ মাস ধরে!

সূত্র জানায়, নীলফামারীতে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় পঞ্চশের মতো। সংস্কৃতি কর্মীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৮ শতাধিক। এদের মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ জনই নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত যারা নানা অনুষ্ঠান করে সংসার চালান। এছাড়া গ্রামগঞ্জে হাটবাজারে গান করে বেড়ান অনেকেই। তারা সবাই বেকার হয়ে গেছেন। আর প্রণোদনার জন্য তালিকা দেয়া হয়েছিল ৭০ জনের। এদের মধ্য থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে মাত্র ২৫ জন সংস্কৃতিকর্মীকে! এর মধ্যেও নয়ছয়ের কারণে প্রণোদনাবঞ্চিত হয়েছে প্রকৃত শিল্পীরা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ, সহায়তার পরও নীলফামারীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি একেবারে লণ্ডভণ্ড। নিরুপায় হয়ে কেউ করছেন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ, কেউ অটোরিকশা চালায় কেউবা মাছ বিক্রি করে। কেউ কেউ বিভিন্ন দোকানে সহকারীর কাজ করছেন। অনেকে আত্মসম্মানের ভয়ে ধার দেনা করে জীবনযাপন করছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হলেও তা-ও একেবারে অপ্রতুল। এই করোনাকালে বিপন্ন শিল্পী এবং সংগঠনগুলোকে প্রতি মাসে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা প্রণোদনা সহায়তা আহ্বান জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নীলফামারী জেলার সভাপতি আহসান রহিম মঞ্জিল ভোরের কাগজকে বলেন, নীলফামারীর শিল্পীদের পরিস্থিতি খুবই করুণ। সরকারি প্রণোদনাও এখানে অপ্রতুল। এর মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে জেলা পরিষদ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে প্রণোদনা পেয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু বাকিদের অবস্থা নাজুক। এছাড়া শিল্পীদের এমন দুর্দিনে সরকারের দেয়া ৫ হাজার টাকার প্রণোদনায় কী হবে? টিকে থাকার জন্য প্রতি মাসে শিল্পীদের ১০ হাজার টাকা করে প্রণোদনা সহায়তা দেয়ার দাবি জানাই। নয়ত মঞ্চের দরজা খুলে দিক। অন্তত কাজ করে শিল্পীরা প্রাণে বাঁচবে। নইলে যে নীতি-নৈতিকতার সংকট তৈরি হয়েছে তা কমবে না। বরং বাড়বে। কারণ শিল্পীরাই তো এসব রুখে দাঁড়ায়।

নীলফামারীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ৪২ বছর ধরে যুক্ত জলসিঁড়ি নাট্য সংসদের সভাপতি মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, নীলফামারীর শিল্পীদের পরিস্থিতি এতই নাজুক যে নিরুপায় হয়ে পেশা বদলে কেউ কেউ নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন, কেউ করছেন মাছ বিক্রি, কেউ চালাচ্ছেন অটোরিকশা। এমন পরিস্থিতি থাকলে শিল্পীদের অস্তিত্ব থাকবে না। তবে শুরুর দিকে নীল সাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আহসান হাবিব লেলিন শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ১০০ জন শিল্পীকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে বিকাশ করেছেন। তার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর ভাইও ২৫ জনকে ২ হাজার টাকা করে সহায়তা করেছেন। তাকেও আমাদের কৃতজ্ঞতা। কিন্তু করোনা থাবায় শিল্পীদের তো মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি করোনাকালীন দুর্দিনে শিল্পীদের অস্তিত্ব রক্ষায় নিয়মিত ভাতা দিন। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই।

নাট্যকর্মী গোলাম মোস্তফা বলেন, নীলফামারীর শিল্পীদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতম। তার ওপর সরকার ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দিচ্ছে ফকিরের মতো লাইনে দাঁড় করিয়ে! এটা খুব অসম্মানজনক। ৫ হাজার হাজার টাকা দিয়ে অসহায় দুঃস্থ শিল্পীর তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে! এটা মোটেই উচিত নয়। এতদিন শিল্পীরা দেশের জন্য কাজ করেছে, করবেও। এখন শিল্পীদের সরকার দেখবে। এটা শিল্পীদের মৌলিক অধিকার।

প্রকৃত শিল্পীরা প্রণোদনাবঞ্চিত হয়েছেন, এতে ব্যাপক নয়ছয় হয়েছে এমন ক্ষুব্ধ মন্তব্য করে এই নাট্যজন আরো বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। তাদের স্থায়ীভাবে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এমনকি তাদের নাতি-নাতনিদেরও দেয়া হচ্ছে। অথচ শিল্পীদের বলা হচ্ছে দুঃস্থ, অসহায়! যারা সারাজীবন শিল্পের পেছনেই জীবন শেষ করে দিচ্ছেন।

কবি ও ছড়াকার দৌলত জাহান ছবি বলেন, যারা বড় বড় বাড়িতে থাকেন তাদের কথা বলছি না। তৃণমূলের অনেক ছেলেমেয়েদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। যারা গান গেয়ে সংসার চালায়। তাদের সহায়তা পাওয়া জরুরি। এদের পাশে না দাঁড়ালে বাংলাদেশ টিকবে কি করে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App