×

মুক্তচিন্তা

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিরোধে প্রয়োজন ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৩১ পিএম

আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। এই অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যা করে, সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনে চরম এক অস্বস্তি সৃষ্টি করে সমাজ টিকতে পারে না। দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর মনের ভেতর আতঙ্ক, অস্বস্তি ও বিষাদের ঘন ছায়া বিস্তার করে একটি দেশ কোনোভাবেই এগিয়ে যেতে পারে না। উন্নত রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে সবাইকে সমমর্যাদার একই ছায়াতলে এনে পথ চলতে হবে।

আগের ‘মুক্তচিন্তা’ কলামে (৩ অক্টোবর) লিখেছিলাম ‘অদ্ভুত আঁধার থেকে পরিত্রাণের আলো চাই’। লেখার বিষয় ছিল সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূ গণধর্ষণের মর্মবিদারক ঘটনা। তখন মনে করেছিলাম সহসা এরূপ বিষয়ে আর লিখব না। অন্য কাউকেও হয়তো আর এরূপ বিষয়ে লিখতে হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কেবল আমার নয় ধর্ষণের মতো বিষয়কে অবলম্বন করে সবারই ধারাবাহিক লেখা চালিয়ে যেতে হবে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে লেখা চালিয়ে যেতে হবে সব লেখকেরই। কারণ সব সময় ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলেও বিগত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এ লেখা (১০ অক্টোবর) পর্যন্ত কোনো দিনই বাংলাদেশে ধর্ষণের মতো নারকীয় ঘটনা থেমে থাকেনি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। ধর্ষণ যেন সংক্রামক কোনো এক ধরনের ভাইরাস! আর এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র! নোয়াখালী থেকে রংপুর, রংপুর থেকে যশোর, যশোর থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে সাভার, সাভার থেকে গাজীপুর, গাজীপুর থেকে বরিশাল। এককথায় কোথায় নয়? গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা আবার এমনও দেখতে পাই যে, সমাজের ভেতর ‘উটকো’ বিষয় যখন ঘটতে থাকে দীর্ঘদিন তারই পুনরাবৃত্তি চলে। ক্যাসিনো কাণ্ড কিংবা রিজেন্ট হাসপাতাল কাণ্ড তার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। আর সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস কাণ্ডের পর পর ঘটে যাওয়া সমগ্র বাংলাদেশের ধর্ষণ কাণ্ডগুলোকে সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করা যায়।

আমরা নিবিড়ভাবে লক্ষ করছি সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রায় মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত নিত্যই গণমাধ্যমের শীর্ষ খবরের বিষয়বস্তু ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা এবং কোথাও বা ধর্ষণ শেষে হত্যা। প্রায় ৮ মাস আমরা করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম আর এখন প্রত্যেকেই তার মা, বোন বা কন্যা শিশুটির নিরাপদ জীবন ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত জীবন কাটাচ্ছে। এই আতঙ্ক নিদারুণভাবে আমাদের এক অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। চরম অস্বস্তি নিয়ে আমরা আমাদের সামাজিক জীবনযাপন করছি। জানি না, এই আতঙ্ক আর এই অস্বস্তি থেকে কীভাবে নিজেদের মুক্ত করব! এ থেকে সমাজই বা কীভাবে মুক্তি লাভ করবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের বহু নারী ধর্ষিত হয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা। কিন্তু স্বাধীন দেশে নারীর প্রতি এই আচরণ কাম্য হতে পারে না।

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি অন্যায় আচরণের আতঙ্কের এক ঘোর অমানিশা চারদিক থেকে আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে। আকণ্ঠ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে মাঝেমধ্যে এও ভাবি যে, গণমাধ্যমে প্রচারিত ধর্ষণ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার খবর কি তাহলে প্রকারান্তরে নরপিশাচ ধর্ষকদেরই উৎসাহিত করে চলেছে? তা না হলে একইরূপ ধর্ষণের ঘটনা এত দ্রুত কী করে নোয়াখালী থেকে রংপুর, রংপুর থেকে যশোর, যশোর থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে সাভার, সাভার থেকে গাজীপুর কিংবা গাজিপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই? মনে হয় এক স্থানের একটি ঘটনা থেকে ‘অনুপ্রাণিত’(!) হয়েই অন্য স্থানের অন্য আরেকটি ঘটনা সংঘটিত করে সংঘবদ্ধ ধর্ষক চক্র।

ইতিবাচক দিক হলো ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের প্রতিবাদ, তারুণ্যের জাগরণ। সারাদেশে সাংস্কৃতিক জোটও প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। সুতরাং প্রতিবাদও শুরু হয়েছে বলা যায় সঠিক সময়েই, তারুণ্যের জাগরণও ঘটছে সঠিকভাবেই। জাগ্রত তারুণ্যের বিদ্রোহে শাহবাগ আবার উত্তাল হয়েছে। উত্তাল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র বাংলাদেশ। ঢাকার মতোই তারুণ্যের প্রতিবাদী গর্জন শোনা যাচ্ছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহেও। তারুণ্যের দাবি ধর্ষণের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে আইন সংস্কার। পাশাপাশি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার আইনের আওতায় ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতার সব প্রকার বিচার সম্পন্ন করার দাবিও বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে উঠে এসেছে। সাম্প্রতিককালের সামাজিক এই অবক্ষয় থেকে দেশকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে এসব দাবি পূরণেরও বিকল্প নেই। স্থিতিশীল সমাজকে রক্ষা করতে হলে এর বিকল্প চিন্তার অবকাশ কম। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে সংক্রামক ভাইরাসের মতোই ধর্ষণ ও নারীর প্রতি বিচিত্র পন্থায় অমানবিক নির্যাতন ও সহিংসতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক এরূপ উৎপীড়ন ও অন্যায় আচরণ থেকে নারী ও বিশেষ করে নারী শিশুদের রক্ষা করতে আইন সংস্কারসহ আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সর্বমহলকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখাতে হবে। আমরা অতীতে দেখেছি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সচেতন আন্দোলনের তীব্রতা আইন প্রণয়নে সহায়ক ভ‚মিকা রেখেছে। এবারো রাখবে বলে আশা করি।

শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভেতর যদি ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় বা উচ্চাকাক্সক্ষা অনুপ্রবেশ করে তাহলে এ কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় যে, জাগ্রত তারুণ্যের সোচ্চার আন্দোলন বিভ্রান্ত হবে। পূর্বেও আমরা এ দেশে বহু ইস্যুতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ভেতর রাজনীতির অনুপ্রবেশ এবং আন্দোলন নস্যাতের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। তাই সংগঠিত তরুণদের প্রতি অনুরোধ ‘সংহতি’ প্রকাশের নামে আগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ হতে সাবধান থাকতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের কাঁধে ভর করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রচেষ্টা অনেকেরই থাকে। ফলে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনটি শেষ পর্যন্ত কার্যত বিনষ্টই হয়ে যায়! সামাজিক যে কোনো আন্দোলনের গণগ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হলে একটি নিরপেক্ষ প্লাটফরম রক্ষা করতেই হয়। সংগঠকদের সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি ও গভীর পর্যবেক্ষণ রক্ষা করতে হবে। ইতোমধ্যে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদী সমাবেশ থেকে প্রথমত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরে প্রধানমন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত সরকার পতনেরও ঘোষণা করেছেন কেউ কেউ। সেসব ঘোষণায় উচ্চারিত শব্দচয়ন আমাদের শঙ্কিতও করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, উস্কানিমূলক এসব বক্তব্য আন্দোলন বানচালের ষড়যন্ত্রও হতে পারে! সামাজিক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের চেয়ে সরকার পতনের আন্দোলন অনেক বড়। চোরাগলির সেই ‘বড়’র গর্তে পড়ে সামাজিক আন্দোলন গতি হারিয়ে ফেলে, ফেলবেও। অর্থাৎ চলমান সংগঠিত আন্দোলন তার মূল লক্ষ্য হারিয়ে ফেলবে। তারুণ্যকে বলছি, আপনারা ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে যে প্রতিবাদী আন্দোলন করছেন তা যেন লক্ষ্যভ্রষ্ট না হয় সেদিকে সর্বাত্মক সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, আপনাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়ার সঙ্গে দেশের সব প্রান্তের মানুষ সহমত পোষণ করেছে। কিন্তু বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আপনাদের পা আটকে গেলে সেই সমর্থন থেকে বঞ্চিত হতেও সময় লাগবে না।

একদিকে দেশের সর্বত্র ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন তীব্রতা লাভ করছে তবু তার মধ্যেও আমরা দেখছি ধর্ষণ ও নারীর প্রতি অমানবিক আচরণ সক্রিয়ভাবে চলমান আছে। এমন ঘটনার পশ্চাতের মনস্তত্ত¡ই বা কী তারও অনুসন্ধান করতে হবে। ৯ অক্টোবর চট্টগ্রামেও ঘটল সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের প্রায় অনুরূপ আরেক ঘটনা! সেখানকার খবর হলো রিকশা থেকে গৃহবধূকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গণধর্ষণ! এসব দেখেশুনে মনে হয় ধর্ষণ একপ্রকার সংক্রামক ব্যাধি কিংবা বলা যায় বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল তরুণদের ‘দুঃসাহসিক অভিযান’-এ পরিণত হয়েছে! তা না হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কী করে ঘটে? এ প্রশ্নের উত্তর যেমন কঠিন তেমনি কঠিন এর উৎস অনুসন্ধান।প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার প্রশ্নে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আসন্ন মন্ত্রিপরিষদ সভায় ধর্ষণ আইন সংস্কারের বিষয়ে আইনমন্ত্রীকে প্রস্তাবনা তৈরি করে তা উপস্থাপনেরও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশারও তেমন কোনো ব্যবধান নেই বলেই আমাদের মনে হচ্ছে। তাই আমরা আশা করছি, সংস্কারের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নে এখন আর তেমন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে এও সবাই জানি, আমাদের দেশে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক আছে। তাই দ্রুত আইনের আওতায় ধর্ষণের বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রেখে আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। এই অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যা করে, সামগ্রিকভাবে জাতীয় জীবনে চরম এক অস্বস্তি সৃষ্টি করে সমাজ টিকতে পারে না। দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীর মনের ভেতর আতঙ্ক, অস্বস্তি ও বিষাদের ঘন ছায়া বিস্তার করে একটি দেশ কোনোভাবেই এগিয়ে যেতে পারে না। উন্নত রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে সবাইকে সমমর্যাদার একই ছায়াতলে এনে পথ চলতে হবে। কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার বিধান রেখে আইন প্রণয়ন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রæত বিচারের আওতায় এনে ধর্ষণরূপ সংক্রামক এই ভাইরাসকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে চিরতরে নির্মূল করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ‘অদ্ভুত আঁধার’ পেরিয়ে আলোর ঠিকানায় পৌঁছতে চাই আমরা।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App