×

সাহিত্য

সিরাজগঞ্জের শিল্পীদের অনেকেই চানাচুর বিক্রি করছেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৫৮ এএম

সিরাজগঞ্জের শিল্পীদের অনেকেই চানাচুর বিক্রি করছেন

ফাইল ছবি।

স্থবির জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ধারাবাহিক ১৯তম প্রতিবেদন।

দেশ-বিদেশে তাঁতশিল্পের সুনাম রয়েছে সিরাজগঞ্জের। কেবল তাই নয়, এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত কাছারিবাড়ি, কবি রজনীকান্ত সেনের বসতভিটা, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর বাড়ি, মুক্তির সোপান, নবরত্ন মন্দির, স্যানাল জমিদার বাড়ির শিবদুর্গা মন্দির, মকিমপুর জমিদার বাড়ির মন্দির, ধুবিল কাটার মহল জমিদারবাড়ি, আটঘরিয়া জমিদারবাড়ি, সুফি সাধক শাহ কামালের মাজার, হজরত মখদুম শাহদৌলার মাজার, ভোলা দেওয়ানের মাজার, হার্ডপয়েন্ট পার্ক, ইকোপার্ক, ভাসমান বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, মওলানা ভাসানীর বাড়ি, জয়সাগর দীঘি। আর এই জেলার ঐতিহ্য বয়ে চলেছে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম আর বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু এবং সিরাজগঞ্জ শহরের আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ইলিয়ট ব্রিজ। আছে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা ব্রিজ। যেখানে প্রতিদিন বিকালে ভ্রমণপিয়াসিরা ভিড় জমায়।

জানা যায়, বেলকুচি থানায় সিরাজউদ্দিন চৌধুরী নামে একজন জমিদার ছিলেন। তিনি নিজ এলাকায় একটি ‘গঞ্জ’ স্থাপন করেন। তার নামানুসারে নামকরণ হয় ‘সিরাজগঞ্জ’। কিন্তু দেশ-বিদেশে তাঁতশিল্পের জন্য গর্বিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজরিত কাছারিবাড়ি আর কবি রজনীকান্ত সেনের বসতভিটার সিরাজগঞ্জ শহর করোনার আঘাতে আজ প্রাণহীন হয়ে গেছে।

সূত্র জানায়, সিরাজগঞ্জে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। সংস্কৃতিকর্মীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় এক হাজারের মতো। এদের মধ্যে ১০০ থেকে ২০০ জনই নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত যারা নানা অনুষ্ঠান করে সংসার চালান। এ ছাড়া গ্রামগঞ্জে হাটবাজারে পালাগান করে বেড়ান অনেকেই। তারা সবাই বেকার হয়ে গেছেন। আর প্রণোদনার জন্য তালিকা দেয়া হয়েছিল ৩০০ জনের। এদের মধ্য থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হয়েছে মাত্র ৯০ জন সংস্কৃতিকর্মীকে!

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানা উদ্যোগ, সহায়তার পরও সিরাজগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। কেউ চলছেন অটো রিকশা চালিয়ে, কেউবা চানাচুর বিক্রি করে। কেউ কেউ বিভিন্ন দোকানে সহকারীর কাজ করছেন। অনেকে আত্মসম্মানের ভয়ে লজ্জায় চুপ হয়ে গেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হলেও তাও একেবারে অপ্রতুল। এই করোনাকালে বিপন্ন শিল্পী এবং সংগঠনগুলোর পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রণোদনা সহায়তা অব্যাহত রাখারও আহ্বান জানান সংস্কৃতিকর্মীরা।

জানতে চাইলে ৫০ বছর ধরে সংগীতের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার মিলন কুমার মণ্ডল ভোরের কাগজকে বলেন, আমার আয়ের একমাত্র উৎস সংগীত। আমার নেশাও সংগীত। কিন্তু করোনা আমার বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি এখন এক বেলা খেয়ে, আরেক বেলা না খেয়ে টিকে আছি। তিন মাস ধরে আমার বাড়ি ভাড়া বাকি। অতি দুঃখে আমার ছেলেদের বলেছি, গান না করতে। গান গাইলে আমার মতো না খেয়ে থাকতে হবে।

এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, আমার জীবনের অর্ধেক সময়ই সংগীতের পেছনেই কাটিয়ে দিয়েছি। জঙ্গিবাদবিরোধী গানের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও অনেক গান লিখেছি এবং গেয়েছি। অথচ আজ আমি নিঃস্ব! সংসার আর চলছে না। স্ট্রোক করে ১১ মাস ধরে বিছানায় পড়ে আছি। চিকিৎসার জন্য চার আনাও নেই! আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিকিৎসা সহায়তা এবং আমার জীবন বাঁচানোর জন্য সহায়তা চাই।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি হেলাল আহমেদ বলেন, করোনার হানায় বিপাকে পড়ে গেছে শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রাম, হাটবাজার ঘুরে ঘুরে অঞ্চলভিত্তিক ভাটিয়ালি, পালাগান, বাউল গান করে বেড়ানো শিল্পীরাও মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি চানাচুর বিক্রি এবং বিভিন্ন দোকানে সহযোগীর কাজ করছে। এসব শিল্পীর জন্য সরকারি প্রণোদনা সহায়তা দেয়া হলেও তা অপ্রতুল। করোনাকালীন এই সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সরকার সহায়তা না করলে শিল্পী তৈরি হবে না। উল্টো শিল্পী তৈরি না হয়ে জঙ্গিবাদ আর ধর্ষণের মতো নানা অপরাধ বেড়ে যাবে। এটা হতে দেয়া যাবে না।

নাট্যচক্রের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মুরাদ বলেন, করোনায় ধাক্কায় পেশাজীবী সংস্কৃতিকর্মীরা চরম সংকটে পড়ে গেছে। তাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না কষ্টে। এদের মধ্যে সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে মাত্র ৯০ জনকে। বাকিদের অবস্থা দুর্বিষহ। আমাদের দাবি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংস্কৃতি কর্মকাণ্ড করার অনুমতি দেয়া হোক। নইলে যারা এ পেশার সঙ্গে যুক্ত তারা হারিয়ে যাবে।

করোনায় বেকার হয়ে যাওয়া শিল্পীদের ধারাবাহিক প্রণোদনা অব্যাহত রাখা জরুরি উল্লেখ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ গৌড় বলেন, আমরা ৩০০ শিল্পীর তালিকা দিয়েছিলাম সরকারের কাছে। তাদের মধ্য থেকে মাত্র ৯০ জন শিল্পীকে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। বাকিরা কোথায় যাবে? হয়তো পেশা ছেড়ে দেবে। এতে এ অঙ্গনের চরম ক্ষতি হবে। এর প্রভাব পড়বে মারাত্মকভাবে। এর মধ্য দিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে তা পূরণ হবে কী?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App