×

জাতীয়

ধর্ষণের সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৮ এএম

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন সংশোধনের উদ্যোগ ধর্ষণের বিচারে হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষিত

সিলেটের এমসি কলেজে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচারের দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক’ ও ছাত্রসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন। আন্দোলনকারীরা মানববন্ধন, গণঅবস্থান, বিক্ষোভ-সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিল অব্যাহত রেখেছে। এসব কর্মসূচি থেকে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডের দাবি জোরালো হয়েছে। এ অবস্থায় জনগণের দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে সরকার। গতকাল বৃহস্পতিবার সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও।

আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই প্রস্তাব তোলা হবে। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একাত্ততা প্রকাশ করে আইনজীবীরা বলেন, এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ শেষ হলে জেল থেকে বেরিয়ে অনেক সময় একই অপরাধে আবারো জড়ায় অপরাধীরা। তাই মৃত্যুদণ্ড অপরাধের মাত্রা কিছুটা হলেও কমাবে।

ধর্ষণের সাজা বাড়ানোর উদ্যোগ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সরকারের এ ঘোষণা (মৃত্যুদণ্ড করা হবে) ধর্ষক তথা অপরাধীদের ওপর একটা মানসিক চাপ তৈরি করবে। আইন দ্রুত সংশোধন করে যাবজ্জীবন থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতে শিশু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তারপরও ধর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু দাবি উঠেছে, সেহেতু এটাকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আইনুন্নাহার বলেন, আমাদের দেশে হত্যা ও এসিড নিক্ষেপের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলে অসুবিধা কোথায়? সরকার যেহেতু এ বিষয়ে চিন্তা করছে, এক্ষেত্রে আমি বলব, এতে অন্তত দু-একটা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলে মানুষ খুশি হবে।

এদিকে বুধবার উচ্চ আদালত বলেছেন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনা কেউ প্রতিপালন করেন না। বরং আদেশ দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মাইন্ড (মন খারাপ) করেন। ৩২ বছর আগের এক হত্যা মামলা নিয়ে আদেশের সময় এ মন্তব্য করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এর পাশাপাশি দুই ক্ষেত্রেই অর্থ দণ্ডের বিধান রয়েছে। এ আইনের মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৭ দিন থেকে ১ মাস এবং মামলা নিষ্পত্তির জন্য ৬ মাস সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও বাস্তবে ওই সময়ের মধ্যে রায় দেয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের এক একটি ঘটনা কিছু দিন পর পর সারাদেশকে নাড়া দিয়ে গেলেও এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির নজির কম।

ধর্ষণের বেশির ভাগ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ধামাচাপা পড়ে যায়। তাছাড়া ঠিকমতো ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়া, সামাজিক জড়তা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আর এই ৮ মাসে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। তবে অনেক অভিযোগ থানা পর্যন্ত না পৌঁছানোয় প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে অধিকারকর্মীদের ধারণা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ধর্ষণের ঘটনায় ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে আসামির শাস্তি হয়েছে মাত্র ৬০টি ঘটনায়। এসব কারণে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি রয়েছে বিভিন্ন সংগঠনের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের শুরুতে কলেজ গেটে বিপদগ্রস্ত এক নারীকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে গাড়িতে ধর্ষণের চেষ্টার সময় গণধোলাই দিয়ে বিবস্ত্র করে ফেলার দৃশ্য সোস্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি করে। গত বছর আশুলিয়ায় ‘হুজুরের সেবা কর বেহেস্ত পাবি’, এমন প্রলোভনে ফেলে এক মাদ্রাসাছাত্রীকে তারই শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম আবদুল্লাহ আল মামুনের (৪২) ধর্ষণ, একই দিন গাজীপুরের গাছা থানাধীন শরিফপুর এলাকায় ধর্ষণের পর শিশু তাফান্নুম তাহিকে (৫) ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা, গত বছরের জুলাইয়ে ‘হুজুরের সেবা কর, বেহেস্ত নিশ্চিত’ এমন কথার প্রলোভনে ফেলে ধর্ম পরায়ণ এক কিশোরী ছাত্রীকে ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার একটি মসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদের ধর্ষণ, গত বছর শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের (ইউপিইএইচডিপি) প্রকল্পের পরিচালক যুগ্ম সচিব আবদুল খালেক (৫৩), অন্তর (৩৫), আবু বক্কর প্রধান (৪৫), রবিউল ইসলাম রবি (৩৮) ও মিল্টনের (৪০) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, চলতি বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ, অসুস্থ স্বামীকে রক্ত দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে স্ত্রী ধর্ষণ, সিলেটের এমসি (মুরারী চাঁদ) কলেজের ছাত্রাবাসে এক স্ত্রীকে স্বামীর সামনে থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ, গির্জায় কিশোরীকে আটকে রেখে ফাদারের ৩ দিন ধর্ষণ, সর্বশেষ নোয়াখালীতে গৃহবধূকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ওই নারীর বিবস্ত্র ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের একের পর এক ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উকিল নোটিস পাঠিয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদক মোহাম্মদ ফুয়াদ হোসেন। সেখানে ধর্ষণের দ্রুত বিচারে বিশেষ আদালত গঠন এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে সমর্থন জানিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও আইন সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজার বিধান করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ধর্ষণের ঘটনায় হাইকোর্টের ৬ নির্দেশনা : নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বিচারে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই ৬টি নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এগুলো হলো-

১. মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্ধারিত সময়ের (বিচারের জন্য মামলা পাওয়ার দিন থেকে ১৮০ দিন) মধ্যে যাতে দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করা যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া।

২. শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা পরিচালনা।

৩. ধার্য তারিখে সাক্ষীর উপস্থিতি ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতি জেলায় মনিটরিং কমিটি গঠন এবং প্রতি মাসে সুপ্রিম কোর্ট, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো।

৪. ধার্য তারিখে রাষ্ট্রপক্ষ সঙ্গত কারণ ছাড়া সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে মনিটরিং কমিটিকে জবাবদিহি করতে হবে।

৫. মনিটরিং কমিটি সাক্ষীদের ওপর দ্রুত যাতে সমন জারি করা যায়, সে বিষয়টিও তদারকি করবেন।

৬. ধার্য তারিখে সমন পাওয়ার পর অফিসিয়াল সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে না এলে ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ এবং প্রয়োজনে বেতন বন্ধের আদেশ দেবেন। এছাড়া আদালত অবিলম্বে সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের তাগিদ দেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App