×

সাময়িকী

সৎ সুন্দর অমায়িক মানুষটির কথা ভুলবার নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৭:০৫ পিএম

সৎ সুন্দর অমায়িক মানুষটির কথা ভুলবার নয়

তোফাজ্জল হোসেন (জন্ম : ৯ অক্টোবর ১৯৩৫ মৃত্যু : ৫ ডিসেম্বর ২০১৫)

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক তোফাজ্জল হোসেন বয়েসে আমার চেয়ে সম্ভবত পাঁচ বছর বড়। তার জন্ম কুমিল্লা জেলায় ১৯৩৫ সালে। তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেছেন ছেলেবেলায়। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী। তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে মেট্রিক পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫১ সালে আমি সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। Brother James ছিলেন- হেডমাস্টার। তবে তোফাজ্জল ভাইয়ের সাথে আমার স্কুলে পরিচয় হয়নি। মেট্রিক পাস করে তোফাজ্জল হোসেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নামে পরিচিত।

১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের বেশ পরে ঢাকায় মুকুল ফৌজ চালু হলো। আমাদের পরিবার কলকাতায় থাকাকালে মুকুল ফৌজ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে আমার বাবা হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী পার্ক সার্কাস ময়দানে মুকুল ফৌজের সমাবেশে নিয়ে যেতেন আমার বড় বোন সেলিনা আর আমাকে। আমরা তখন খুব ছোট। ঢাকায় যখন মুকুল ফৌজ শুরু হয় আমরা তাতে যোগ দেই। আমার বাবার বন্ধু বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের আর শিল্পী কামরুল হাসান ছিলেন মুকুল ফৌজের নেতৃত্বে। মুকুল ফৌজের তৎপতার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন পিনু ভাই, জিনু ভাই, রফিক ভাই- এখন যিনি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এই নামে সুপরিচিত। তোফাজ্জল ভাই তখন মুকুল ফৌজে ছিলেন এবং এই সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

তোফাজ্জল হোসেন স্কুল জীবন থেকেই ফুটবল খেলতেন। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পর তার এই খেলার প্রতি আগ্রহ কমেনি। আমার বাবা ১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি অফিসের পর, খেলার মাঠে যেতেন। অনেক সময় আমাদের নিয়ে যেতেন। একবার তোফাজ্জল ভাইকে দেখেছি ফুটবল লিগ খেলায় অংশ নিতে। তিনি আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের পক্ষে খেলছিলেন। তিনি ফুটবল খেলা, মুকুল ফৌজ, ব্রতচারী আন্দোলন এসব কিছুর সঙ্গেই জড়িত ছিলেন সেই সময়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আহমদ হোসেন ছিলেন তার ছাত্র জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গী।

নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালে ঢাকায় বুলবুল একাডেমি অফ ফাইন আর্টস (বাফা) প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার মা আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, ফুপু শামসুন নাহার মাহমুদ, সৈয়দ আজিজুল হক, মোহাম্মদ মোদাব্বির, অজিত গুহ, ডক্টর নন্দী, নুরুল হুদা, অজিত সান্যাল, বদরুন্নেসা আহমেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন- বাফার সাথে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সের যারা তাদের মধ্যে ছিলেন আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আহমদ হোসেন, আমার বোন সেলিনা বাহার। এরা ছিলেন বাফার ফাউন্ডার মেম্বার। আর ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন, কামাল মাহমুদ আর আমিও ছিলাম। বাফা প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৫৬ সালে বাফা কাউন্সিল গঠিত হয়।

৬০ সদস্যের কাউন্সিলে ছিলেন ২৩ জন ফাউন্ডার মেম্বার এবং রেগুলার মেম্বারদের মধ্যে তোফাজ্জল ভাই আর আমিও ছিলাম। প্রথম কাউন্সিল মিটিং হয় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সরকারি বাসভবনে। তৎকালীন গভর্নর এ কে ফজলুল হক বাফা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তোফাজ্জল ভাই, আমি এবং বাফার সঙ্গে শুরু থেকে যারা যুক্ত সবাই উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। ১৯৬০-এর দশকের প্রথমদিকে যখন পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল পুনর্গঠিত হয়, তখন আমরা অনেকেই এর সঙ্গে যুক্ত হই। তোফাজ্জল ভাইও আমাদের সঙ্গে ছিলেন সেই সময়।

দীর্ঘদিন তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাক ও আরো কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেছেন। ঢাকা USIS প্রেস সেকশনেও অনেক বছর তিনি কাজ করেন। বাফা, আর্টস কাউন্সিল, USIS-এর নানান অনুষ্ঠানে তার সাথে দেখা হয়েছে আমার অনেকবার। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে এবং পরে তিনি পাকিস্তান কাউন্সিল আবাসিক পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।

পরে এই সংস্থার নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ পরিষদ। সেখানে তার সাথে কাজ করেছেন লেখক ফখরুজ্জামান চৌধুরী। এই সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেছি, দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অনেকবার। তোফাজ্জল হোসেন পরে বদলি হয়ে অন্য কয়েকটি সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। ঢাকাতে বিভিন্ন সময় তার সাথে নানান জায়গায় দেখা হয়েছে আমার। তার বন্ধুত্বপূর্ণ অমায়িক ব্যবহার ভুলবার নয়। ১৯৭৩ সালে আমি ওয়াশিংটনে ভয়েস অফ আমেরিকাতে যোগদানের পরে তার সাথে দেখা খুব কম হয়েছে। ১৯৮০-র দশকে তিনি একবার ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। প্রায় ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। সেই সময় বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি আমরা একসাথে। ঢাকায় গেলে দেখা হয়েছে অনেক সময়। শেষ দেখা ‘ভোরের কাগজ’ আয়োজিত আমার চাচা বিশিষ্ট সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীর স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। সেখানেই শেষ দেখা তোফাজ্জল ভাইয়ের সাথে। তার মৃত্যুর সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। খবর পেয়ে শহীদ মিনারে যাই। বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিকদের একটি সভা হয়েছিল। অনেকেই ছিলেন সেখানে। ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রফেসর আনিসুজ্জামান। সবাই বক্তব্য রাখলেন। আমাকেও কিছু বলতে বলা হলো। এই সৎ, সুন্দর, অমায়িক মানুষটির প্রতি আমিও শ্রদ্ধা জানালাম। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App