×

সাময়িকী

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এদের প্রাপ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৮:৩৫ পিএম

ওরা নববিবাহিত তরুণ-তরুণী। সন্ধ্যালগ্নে বেরিয়েছিল বেড়াতে। বড় রাস্তায় এসে হঠাৎ করেই স্বামীপ্রবরের ধূমপানের ইচ্ছা জাগে। স্ত্রীকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কাছেই দোকানে সিগারেট কিনতে যায়। অনুমান করি, তরুণীটি হয়তো বলেছিল, আমার একা থাকতে ভয় করছে। তেমনি অনুমান, ‘ভয়ের কি আছে। সামনেই তো এমসি কলেজের ছাত্রাবাস। ছাত্ররা থাকতে ভয়ের কারণ নেই।’ এমনি কিছু কথা।

অতএব সিগারেট কিনতে যাওয়া। এমন এক সময় ছিল, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দল-নির্বিশেষে বা নির্দলীয় আদর্শনিষ্ঠ ছাত্রসমাজের ভাষা আন্দোলন থেকে সরকারবিরোধী জাতীয়তাবাদী প্রগতিবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য যে মানুষ বয়স-নির্বিশেষে গর্ব ও অহংকারের সঙ্গে স্মরণ করছে, আপদে-বিপদে ছাত্রসমাজকে ভরসা হিসেবে বিবেচনা করেছে। সে ইতিহাস বিবেচনায় পূর্বোক্ত অনুমানভিত্তিক কথাগুলো লেখা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই রাজনীতির পক্ষ সমর্থন করেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সে ঐতিহ্য ভেঙেচুরে দিয়েছে কিছুসংখ্যক ছাত্রনামধারী দুর্বৃত্ত। ক্রমে তাদের সংখ্যা বেড়েছে।

ওরা পারে না এমন কাজ নেই। অছাত্র জনোচিত সব কাজ ওদের এখতিয়ারে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি থেকে সবরকম অনৈতিকতা ও দুর্নীতির শিরোমণি ওরা। এমনকি খুনও ওদের দুর্বৃত্তপনার বাইরে নয়। ইদানীং ওদের রাশ টানার কথা দেখছি সংবাদপত্রের শিরোনামে। কিন্তু রাশ টানা শুরুতেও হয়নি, এখনো হচ্ছে না। হলে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ঘটনা ঘটতে পারত না। আমি জানি না ওই তরুণ দম্পতি, বিশেষ করে তরুণ স্বামীর দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে কিনা। থাকলে দিনের পর দিন নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাদি তার গোচরে থাকার কথা। আর সেক্ষেত্রে, আমার আনুমানিক কথাগুলো সত্য হোক, না হোক, ওভাবে তরুণী স্ত্রীকে ছাত্রাবাসের সামনে রাস্তায় একা দাঁড় করিয়ে রেখে সিগারেট কিনতে যেত না, কিংবা সন্ধ্যালগ্নে বেড়াতে বেরোত না নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বরং স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই দোকানে যেত সিগারেট কিনতে। \ দুই \ তার ওই অবিবেচনার ফলে অঘটন, যা ঘটার তাই ঘটে গেল। সিগারেট কিনে ফিরে এসে দেখে দুচারজন তরুণ তার স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করছে। একা একটি তরুণীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাত্রনামধারী ওই কয়েক দুর্বৃত্তের শিকার ধরার লালসা জেগে ছিল। অথবা একটু দূর থেকে তরুণীকে অরক্ষিত অবস্থায় দেখে পরিকল্পিতভাবেই কয়েকজন এসে প্রাথমিক মহড়া শুরু করে। এরপরের ঘটনাবলি তো দৈনিক পত্রিকাগুলোতে বিশদ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। এই সামাজিক নৈরাজ্য, দলীয় ছাত্রদের সর্বপ্রকার দুর্বৃত্তপনার মধ্যেও কিছু ইতিবাচকতার আলো জ¦লতে দেখা গেছে। সেখানটাতেই ভরসা। দরকার সেই বৃত্তটিকে ব্যাপক আকার ও বলিষ্ঠ চরিত্রদান।

এর আগে মূল ঘটনার সামান্য কিছু দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃত করা যাক। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘সিলেটে ধর্ষণের শিকার তরুণী ও তার স্বামীকে এমসি কলেজ ফটকের সামনে থেকেই ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আসামিরা। ঘটনাস্থলে শুরুতে চারজন। দুজন স্বামী-স্ত্রীকে আটকে রাখেন। একজন গাড়ি চালিয়ে (তাদের) ছাত্রাবাসে নেন। আরেকজন গাড়ির পিছু পিছু মোটরসাইকেলে করে যান।’ ‘তুলে নেয়ার পর গাড়ি থেকে ছাত্রাবাস পর্যন্ত তিনটি স্থানে তরুণীকে নির্যাতন করা হয়।’ কর্মশেষে যথারীতি তারা তরুণীর স্বামীকে স্ত্রীসহ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর তারা আনন্দ-বিনোদনে সময় কাটায়। ঘটনাক্রমে বোঝা যায়, সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক সম্পন্ন করা হয়।

এ প্রতিবেদনের শিরোনাম : ‘ধর্ষণের পরও ছাত্রাবাসে ছিলেন অভিযুক্তরা।’ এতে করে বোঝা যায়, কতটা বেপরোয়া, কতটা আত্মপ্রত্যয়ী এই ছাত্রনামধারী দুর্বৃত্তরা। পেছনে বটগাছের ছায়া ও প্রশ্রয় না থাকলে এমন সাহস হতে পারে না। ওরা তাই কাউকে পরোয়া করে না, কোনো অপরাধে জড়িত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘আগে থেকেই অপকর্মে, ধর্ষণ কাণ্ডে জড়িতরা।’ এ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আমাদের অবাক করে। কারণ এদের কর্মকাণ্ডের ঘটনাগুলো যেমন ছাত্রাবাস এলাকার বাইরে সাধারণ মানুষের অজানা ছিল না, তেমনি কলেজ কর্তৃপক্ষেরও অজানা থাকার কথা নয়। প্রথমোক্তরা ভয়ে নীরব। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র বলে কথা। এদের মধ্যকার দুষ্টমতিদের ভয় পাওয়ারই কথা। মহিলাদের স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই থেকে বহুবিধ অপকর্মে লিপ্ত ছিল এরা। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ? ছাত্রদের কৃত অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণে তাদের ভয় কিসের, ভয় কাকে?

সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলতে, অপরাধীর বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা নিতে ভয় পাওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু এখানেই শিক্ষক-কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে যত দুর্বলতা! দুর্বলতা নীতির সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের, সুবিধাবাদের আপসে। আর তার ফলেই ছাত্রদের বিপথগামী হওয়ার পথ খুলে যায়।

সুবোধ ছেলেটি, ভালো ছাত্রটি বাড়ি থেকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষায়তনে ও ছাত্রাবাসে এসে কিছুসংখ্যক অসৎসঙ্গের টানে পথভ্রষ্ট, নীতিভ্রষ্ট হয়ে যায়, অভিভাবকদের অগোচরে এবং তা ছাত্ররাজনীতির দূষিত একাংশের প্রভাবে। কাজেই এর দায়টা শুধু ছাত্রদের নয় দায় প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষেরই প্রধানত। পরোক্ষ এর দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। \ তিন \ আজ যে দলবিশেষের কর্মী সাইফুর রহমান, অর্জুন লস্কর প্রমুখ জঘন্য অপরাধের দায়ে কাঠগড়ায়- এ ধারা বন্ধ করতে হলে গোড়ায় হাত দিতে হবে। গোড়ার গলদ ঠিক করা না হলে অপরাধের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। বাস্তবে তাই আমরা দেখছি।

অন্যক্ষেত্রে এসব অপরাধ বিষয়ে সমাজে যাই ঘটুক সিলেটের সমাজ ও অভিভাবকরা আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে এবং তা ঐতিহাসিক নজির। শহরের আইনজীবীরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেই ক্ষ্যান্ত হননি, তারা নজির হিসেবে এসব দুর্বৃত্ত অপরাধীর পক্ষে আদালতে দাঁড়াননি। তেমনি অবাক হয়েছি, অপরাধীদের দুয়েক পরিবারের অভিভাবকদের সঠিক ভ‚মিকা দেখে। তাদের একজন বলেছেন, ‘আমার ছেলে তো এমন ছিল না, কলেজে গিয়ে ছাত্রাবাসে থেকে নষ্ট হয়েছে।’

অর্থাৎ দায়টা কলেজ কর্তৃপক্ষের। সবচেয়ে বড় কথা ওই একজন আরো বলেছেন, ছেলে অপরাধ করেছে, সে জন্য বিচারে তার যা শাস্তি হয়, হোক। অর্থাৎ তার তাতে আপত্তি নেই। এটাও আমার বিশ্বাস একটি অসাধারণ উদাহরণ। এসব দেখে শুনে বাংলাদেশের শিক্ষা বিভাগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের চেতনায় দায়দায়িত্ব পালনের নীতিতে কি আঘাত পড়বে? তাদের কি মনে হবে, তারা শিক্ষার মতো একটি মহৎকর্মে, জাতি গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়োজিত? কিন্তু অর্থ, স্বার্থ, ক্ষমতা এগুলো বড় সুস্বাদু জিনিস, এগুলোর জন্য অনায়াসে নীতি-নৈতিকতাবোধ, দায়িত্ব কর্তব্যবোধ বিসর্জন দেয়া যায়।

দু-চারজন দুষ্ট বা দুর্বৃত্তকে শাস্তি দিয়ে এসব জঘন্য অপরাধের ধারাবাহিকতা বন্ধ করা যাবে না। দরকার গোটা সমাজের চরিত্র বদল, সেই সঙ্গে রাজনীতিরও সুস্থতা। তা না হওয়া পর্যন্ত ধর্ষকদের প্রাপ্য বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা হোক।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App