×

জাতীয়

তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপিতে বিদ্রোহের সুর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৩৬ এএম

মুখ খুললেন তিন নেতা

অসুস্থতা ও মামলাজনিত কারণে আপাতত দায়িত্ব থেকে দূরে রয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হাজার মাইল দূরে থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। আর এ নিয়েই দলের সিনিয়র নেতাদের অভিমান। অনেকেই মানসিক যন্ত্রণায়। তারা মানতে পারছেন না তারেক রহমানের নেতৃত্ব। এ নিয়ে দলীয় হাইকমান্ডে বিভক্তিও দেখা দিয়েছে। অনেকে বিদ্রোহের আভাসও দিয়েছেন। তবে সরাসরি মুখ খুলছেন না কেউ। এই সুযোগে প্রতিপক্ষও বিএনপিকে ঘায়েল করার ছক কষছে। সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

সম্প্রতি কয়েকজন নেতার বক্তব্যে বিএনপিতে ভাঙন কিংবা বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে দলটির তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের কথায় বিদ্রোহের ইঙ্গিত রয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ‘টকশো’তে তারা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগার থেকে আপস করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি নিয়েছেন এবং তার উত্তরসূরি হিসেবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

তারা বলেছেন, নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই আপস করেছেন খালেদা জিয়া। তারেক রহমানকে খালেদা জিয়ার উত্তরসূরি মনোনীত করার সিদ্ধান্তও সঠিক নয়। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে রাজনীতি ছাড়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন তার একটিই কারণ তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। অথচ সেই জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচার করলেন না কেন?

আর মেজর অব. হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা নেতাকর্মীরা সরকারের সঙ্গে আপস করেছি। এ কারণে খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। খালেদা জিয়াই বিএনপির বর্তমান ও ভবিষ্যতের একমাত্র নেতা। তারপরে কে জানি না। শাহজাহান ওমর বলেন, তারেক রহমান কতটুকু দল চালাতে পারবেন আপনারাও দেখেন আমিও দেখি। লন্ডনে বসে কথাবার্তা-ভাব আদানপ্রদান করা কঠিন।

তাদের এ ধরনের বক্তব্যে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। কিন্তু অভিযুক্তরা এতে তোয়াক্কা করছেন না। এ বিষয়ে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর ভোরের কাগজকে বলেন, টকশোতে আমি অন্যায় কিছু বলিনি। আমি বলেছি, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এখন যারা আছেন তাদের বয়েস হয়েছে, অনেকেই অসুস্থ, ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। তাই স্থায়ী কমিটির শূন্যপদগুলোতে যোগ্য ও তরুণ নেতৃত্ব বসিয়ে নতুন পরিকল্পনায় দল পরিচালনা করলে ভালো হবে। তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলটা জিয়াউর রহমানের। আর আমাদের নেতা খালেদা জিয়া। অসুস্থ বা অন্যান্য কারণে তিনি হয়তো দলের দায়িত্ব থেকে দূরে আছেন তাতে সমস্যা নেই। তারেক রহমান তো ভারপ্রাপ্ত। তাকে নেতা হিসেবে মানার প্রশ্নই ওঠে না। আমি কারো দয়ায় রাজনীতি করি না।

সূত্র জানায়, এই তিন নেতার বক্তব্যের পরে দলের তৃণমূল থেকে ফোন আসে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানিয়েছে তৃণমূল। মির্জা ফখরুল আপাতত তাদের শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, কৌশলগত কারণেই তিন নেতার বিষয়ে এখন নীরব থাকতে চায় দল। নেতৃত্বের প্রতি হঠাৎ করে এই অবস্থান ব্যক্ত করার পেছনে হয়তো অনেক কারণ থাকতে পারে। হয়তো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ ও ভবিষ্যতে দলে আর জায়গা না পাওয়ার আশঙ্কা থেকে তারা এমন মন্তব্য করেছেন। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য ভূমিকার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি।

জানা গেছে, এই তিন নেতার বক্তব্যের পরে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে কেউ কেউ পদত্যাগও করতে পারেন। দলের ওপর দায় চাপিয়ে বিগত কয়েক বছরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খানসহ অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। এরপরেই গুঞ্জন ওঠে অন্তত পাঁচ থেকে সাত জন নেতা বিএনপি ছাড়ছেন। এদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের নাম ছিল।

এদিকে আরেকটি সূত্র জানায়, সমালোচনা করে দলের ভেতরে সংস্কারপন্থি একটি অংশ তারেক রহমানকে চাপে রাখতে চায়। তাছাড়া বিগত সময়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দল ভাঙার বিষয়ে প্রচেষ্টা ছিল। কিন্তু সেটি সফল না হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আবারো শুরু হতে পারে। আর শুরুটা হয়েছে সিনিয়র তিন জনকে দিয়ে। বিএনপির তিন জন ভাইস চেয়ারম্যান যেভাবে কথা বলেছেন, তা রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই বলার সুযোগ পেয়েছেন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানান, যারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এসব কথা বলতে পারেন তারা দল ভেঙে নতুন দলও গঠন করতে পারেন। তাই এদের বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়ার সুযোগ না পেয়ে তারা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিছুদিন আগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদকে স্থায়ী কমিটিতে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন জমিরউদ্দিন সরকার। তখন তারেক রহমান এক-এগারোর সময়ে সংস্কারপন্থিদের ভূমিকা উল্লেখ করে বিষয়টি নিয়ে আর কথা বলতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আত্ম সমালোচনায় দলের কোনো ক্ষতি হয় না। তারা যা বলেছেন, তা দলের ভেতরে ডেমোক্রেসির চর্চার নমুনা। তাছাড়া তাদের ক্ষোভ থাকতেই পারে। তবে তারা দলীয় ফোরামে এসব কথা বলতে পারতেন।

বিএনপিতে আত্মসমালোচনা নতুন নয়। বিএনপির নেতৃত্ব ও সিনিয়র নেতাদের নিয়ে হরহামেশাই প্রকাশ্যে কটূক্তি করেন দলটির শুভাকাক্সক্ষী গণস্বাস্থ্যের প্রধান নির্বাহী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি প্রায়ই গণমাধ্যমকে বলেন, খালেদা জিয়া ‘ইনভ্যালিড’। তার এখন দলের চিফ এডভাইজার হওয়া উচিত। আর তারেক রহমানকে দিয়ে হবে না। তাকে দলের উত্তরসূরি করা হবে খালেদা জিয়ার ভুল সিদ্ধান্ত।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে তৃণমূলে যে আবেগ তৈরি হয়েছে তা অভাবনীয়। তিনি ইতোমধ্যে তৃণমূলকে শক্তিশালী করেছেন। তার নেতৃত্বে দল যখন শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ তখন ঐক্য বিনষ্ট করার চেষ্টা চলছে। যারা এ ধরনের চেষ্টা করবেন তারা কোনোদিনই সফল হবেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App