×

সাময়িকী

জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৬:২১ পিএম

জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন

কবি তোফাজ্জল হোসেন

নাতিদীর্ঘ আকৃতির কিন্তু বড় মাপের, উদার মানুষ ছিলেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত থেকে অনন্য-গৌরবের অধিকারী হন। ১৯৫৩ সালে কবি-সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামের যে ঐতিহাসিক সংকলনগ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন সেই সংকলন গ্রন্থে যে দুটি গীতিকবিতা গৃহীত হয়েছিল তার প্রথমটি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। দ্বিতীয়টি লিখেছিলেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। যার প্রথম পঙ্ক্তি- ‘রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি, একুশে ফেব্রুয়ারি’। মাত্র সতেরো বছর বয়সের যে প্রদীপ্ত তরুণকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্মানের শিরোপা প্রদান করেছেন তিনিই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন নিপীড়িত মানুষের নির্ভীক ভাষ্যকার।

তোফাজ্জল হোসেন একই সঙ্গে ভাষা-সংগ্রামী ও কবি। তাঁর এই দ্বৈতসত্তার জন্য অনায়সেই তিনি ‘ভাষাসৈনিক’ উপাধিতে বিভ‚ষিত হওয়ার যোগ্য। কবি তোফাজ্জল হোসেন শুধু ভাষার জন্যই সংগ্রাম করেননি, তিনি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামেও অগ্রগামী ছিলেন। একজন প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে তোফাজ্জল হোসেনের কৃতিত্ব বাংলাদেশের মানুষ কোনোদিন ভুলবে না। কবি তোফাজ্জল হোসেন ১৯৩৫ সালের ৯ অক্টোবর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। আমিও জন্মসূত্রে কুমিল্লার সন্তান। তোফাজ্জল ভাই আমার চেয়ে দশ বছরের বড় হলেও আমরা দুজন বন্ধুর মতো মিশেছি। একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই-সংগ্রামে শামিল হয়েছি। কোনোদিন কোনো কারণে তোফাজ্জল ভাইয়ের মলিন মুখ দেখিনি। কবি তোফাজ্জল হোসেন একজন সদালাপী, পরোপকারী মানুষ ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ন্যাপের জনসংযোগ কর্মী হিসেবে বহুবার বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেছি, তার যে কোনো নির্দেশ পালন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন প্রয়োজনে যতবারই আমি সচিবালয়ে গিয়েছি, ততবারই তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। আলাপ করেছি, ঋদ্ধ হয়েছি। তিনি মাঝে মাঝে গোপন খবরও দিতেন। চাকরি জীবনে তিনি শীর্ষ পদ অলঙ্কৃত করেছেন বটে, তবে বঞ্চিতও কম হননি। রাষ্ট্র যেমন তাকে বঞ্চিত করেছে, তেমনি প্রবঞ্চনা করেছে সুযোগ সন্ধানী সহকর্মীরা। নানাভাবে বঞ্চিত হয়েও তিনি কোনোদিন অভিমান করেননি। সরে যাননি রাজপথ থেকে। পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন।

কবি তোফাজ্জল হোসেন ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে কবিতা লিখেছেন। তার কবিতাচর্চার কাল সুদীর্ঘ হলেও সৃষ্টিসম্ভার তেমন বিশাল ও বিপুল নয়। তিনটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ- ‘হৃদয় রক্তরাগে’, ‘একুশ ভুবনময়’, ‘নতুন যুগের ভোরে’, কিছু অগ্রন্থিত কবিতা ও কিছু উর্দু-রুশ অনুবাদ কবিতা- এই হলো তার সৃষ্টির পরিধি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক কবিতা (গানসহ) তিনি রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই তিনশ কবিতাই তিন হাজার কবিতার সমান আলো ছড়িয়েছে বাংলার জমিনে। বিচিত্র বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি তোফাজ্জল হোসেন। ১৯৫২ সালের প্রেক্ষাপটে যেমন তিনি একুশের কবিতা ও গান রচনা করেছেন, তেমনিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছেন কবিতার পঙ্ক্তিকে অস্ত্র বানিয়ে।

মানবিক বোধের কবি তোফাজ্জল হোসেনের কবিতায় বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। অন্তত আমি লক্ষ করি। স্বভাষা ও স্বদেশপ্রেম তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার প্রধান সুর- এ কথা নিঃসন্দেহে উত্থাপন করা যায়। দেশপ্রেমের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত থাকে, যেমন- প্রকৃত-সমাজ-বিজ্ঞান-দর্শন-জীবন। দেশপ্রেমের পূর্বশর্ত আত্ম-উৎসর্গের মনোবৃত্তি। দেশের প্রয়োজনে যে-কবি জীবন উৎসর্গ করার সাহস করেন না, তার পক্ষে দেশপ্রেমিক কবি হওয়া সম্ভব নয়। কবি তোফাজ্জল হোসেন বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম- উনিশ শ’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনিশ শ’ একাত্তর সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও উনিশ শ’ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে স্লোগান ধরেছেন। মৃত্যুর ভয় কখনোই তাকে বিচলিত করেনি। কেননা স্বাধীনচেতা এই কবি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন- ‘স্বাধীনতা এক রক্ত গোলাপ ফুল বিশ্বে কিছুই নয় তার সমতুল\’ উদ্ধৃত পঙক্তি দ্বয়ের ‘রক্তগোলাপ’ শব্দটির প্রতি দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায় তার প্রকৃত মনোভাব দেশের প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা ছিল কবি তোফাজ্জল হোসেনের। তার ‘একুশ ভুবনময়’ গীতিকবিতা গ্রন্থের একটি গীতিকবিতায় তিনি বলেছেন- ‘একটি দেশের ভালোবাসা মোর হৃদয়-পরতে মাখা একটি দেশের মানচিত্রই আমার হৃদয়ে আঁকা। এ দেশ আমার বিশ্বভুবন সোনার বাংলাদেশ রক্ত কণায় সদা জাগ্রত মূর্ত অনিঃশেষ।’

উপরিউক্ত ছয় ছত্রে মাতৃমাটির প্রতি যে নিবিড় মমত্ব ব্যক্ত হয়েছে- তা বর্ণনাতীত। দেশাত্মবোধক কবিতায় কবি তোফাজ্জল হোসেন যেসব চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তা আবেগে মাখানো, আদরে জড়ানো। একটি সুন্দর দেশ আকাক্সক্ষা করে কবি যেসব শব্দসৌরলোক সৃষ্টি করেছেন কবিতাপাঠক তা দেখে চমকিত হতে বাধ্য। কবি তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো ‘প্রতিবাদ’। তিনি পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, শোষণ-নির্যাতন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কবি তোফাজ্জল হোসেনের সমসাময়িক অনেক কবির কবিতায়ই দেশপ্রেম-প্রতিবাদ-সংহতির আহ্বান লক্ষ করা যায়। এমনকি ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের বহু কবিই ওই সব লক্ষণাক্রান্ত। তারপরেও তোফাজ্জল হোসেনের কবিতা কবিতাপ্রেমীদের আকর্ষণ করে, তপ্ত মনে তৃপ্তি এনে দেয়। এ কথা ঠিক যে, তোফাজ্জল হোসেনের কবিতার আঙ্গিকে ও বিষয়ে কোনো নতুনত্ব নেই, কিন্তু উপস্থাপনায় ও কাব্যকলায় তার পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত।

আধুনিক কবিতার একটি প্রধান প্রবণতার নাম ‘সংক্ষেপণ’। খণ্ডতায় বিশ্বাস করে বলেই হয়তো আধুনিক যুগে ‘খণ্ড কবিতা’ বেশি দেখা যায়। দীর্ঘ কবিতা, শ্লেষধর্মী কবিতা- এ যুগের মনোরঞ্জনে ব্যর্থ। তোফাজ্জল হোসেন বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতা লেখেছেন, যেগুলোর গঠনশৈলী আঁটোসাঁটো এবং অলঙ্কারসমৃদ্ধ। ‘নতুন যুগের ভোরে’ কাব্যগ্রন্থে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা আছে। এগুলো পাঠ করলে সহজেই কৈশোরে ফিরে যাওয়া যায়, ফিরে পাওয়া যায় কৈশোরের নিরাবিল সারল্য। বাংলার বাউলেরা সহজ প্রেমের যে বাণী প্রচার করেন, ‘নতুন যুগের ভোরে’ গ্রন্থে সেই সহজ প্রেমের ভাব ও মাধুরী অনুভব করা যায়।

আমরা আজকাল কবিতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এটা খুবই অশুভ লক্ষণ। অতিবিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস যখন চ‚ড়ান্ত রূপ ধারণ করে তখন মানুষের মনে এক ধরনের বিকার লক্ষ করা যায়। আমরা এখন বিকারগ্রস্ত-মহামারির যুগে বসবাস করে মানবিকবোধ হারাতে বসেছি। আমাদের এখন জরুরি দরকার কবি তোফাজ্জল হোসেনের মতো ত্যাগী কবি পুরুষদের লেখা পাঠ করা। আমাদের মনে রাখা দরকার- যারা আলোর বাহক তারাই কেবল আলো দিতে পারে।

তোফাজ্জল ভাই একজন সার্থক পিতা ছিলেন। তার পারিবারিক পরিমণ্ডল কবিতা-সংগীত-শিল্পকলার নান্দনিকতা দিয়ে সাজানো। অর্থাৎ তার স্বজন-পরিজনদের মানসগঠনেও তোফাজ্জল ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কবি তোফাজ্জল হোসেন আমার পরমাত্মীয় ছিলেন, তিনি ছিলেন জনারণ্যে মিশে পাওয়া অনন্য-স্বজন। আমার স্মৃতিতে তিনি ও তার বেশ কিছু কবিতা অমর হয়ে থাকবে। জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা জানাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App