কবি ও স্বাপ্নিক
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৩৫ পিএম
স্কুল জীবন থেকে থেকেই, গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ছাপার হরফে দেখে একটি নাম মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। ‘ইত্তেফাকে’র সম্পাদক ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের (হাসান হাফিজুর রহমান- সম্পাদিত) অন্যতম লেখক দুজন আলাদা ব্যক্তি তা প্রথমে বহুদিন খেয়াল করিনি- প্রথমজন তফাজ্জল আর দ্বিতীয় জন তোফাজ্জল। মালিবাগে আমাদের ভাড়া বাসার পাশের বাসায় থাকতেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। তার ঘরেই সম্ভবত প্রথম দেখি সেই বিখ্যাত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলন। ওই সংকলনে তোফাজ্জল হোসেনের- ‘রক্ত শপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি একুশে ফেব্রুয়ারি দৃঢ় দুই হাতে রক্ত পতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরি একুশে ফেব্রুয়ারি তোমারে স্মরণ করি।’ গানটি পড়েছিলাম ষাটের দশকে, এসএসসি পরীক্ষার আগে। তখন সম্পাদক ও গীতিকার দুই আলাদা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পারিনি। ইত্তেফাক সম্পাদককেই ওই গানের লেখক ভাবতাম। আব্বার চাকরি সূত্রে ষাট-সত্তর দশকে আমরা থাকতাম ইত্তেফাক অফিসের উল্টোদিকে গভর্নমেন্ট হাউসে (পরে বঙ্গভবন)। কচি-কাঁচার আসরে প্রায়ই যেতাম দাদাভাইয়ের কাছে নিজের ও বন্ধুদের লেখা পৌঁছে দিতে। তার কাছেই শুনলাম এই গানের লেখক এডিটর সাহেব (মানিক মিয়া) নন। অন্য একজন কনিষ্ঠ কবি। কবি তোফাজ্জল হোসেনকে প্রথম দেখি সম্ভবত পাকিস্তান কাউন্সিলে (পরে বাংলাদেশ পরিষদ)। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র। পরিচয় জেনে বলেন, আমার শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান তার বন্ধু। তখন থেকে আমিও তাকে স্যারের বন্ধু হিসেবে সম্মান করতাম, তিনিও বন্ধুর ছাত্রকে বিশেষ স্নেহ করতেন। মনে আছে, আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে কাউন্সিলের লাইব্রেরি থেকে একটি দুষ্প্রাপ্য বই ধার দিয়েছিলেন। যখনই তার অফিসে গিয়েছি আপ্যায়ন করতেন, চা-সিঙ্গারা খাওয়াতেন, আমার ক্ষীণ দৃষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে সচেতন করতেন। খেলাধুলা করতে পরামর্শ দিতেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে তার গান পড়েছি বললে একটু লাজুক হেসে চুপ করে থাকতেন। বেশি কিছু বলতেন না। তিনি যে নিয়মিত কাব্যদেবীর আরাধনা করেন, জানতে দেননি। মনে হয়, প্রচারবিমুখতাই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজে একজন কবি ও গীতিকার ছিলেন। মৌলিক কবিতা ছাড়াও তরজমা করেছেন প্রগতিশীল রুশ ও উর্দু কবিতা। এই অনুবাদকর্মের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন : ঢাকায় রুশী বইয়ের মেলা থেকে পঞ্চাশ জন কবির একটি সংকলন সংগ্রহ করেন। ‘নিজে অল্প স্বল্প কাব্যচর্চার অনুসারী এবং ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ঐসব রুশ কবিদের কবিতাগুলো পড়ে নতুন আস্বাদ লাভ করি- বিশেষ করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিরাট রূপচ্ছন্দ ও মানবিকতার গুণাগুণে মুগ্ধতা আমাকে অভিভ‚ত করে।’ তার অনূদিত কবিতাগুলো ‘ভোরের কাগজে’ প্রকাশিত হলে পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়। প্রগতিশীল উর্দু কবিদের সম্পর্কে একটি ইংরেজি প্রবন্ধে উদ্ধৃত কবিতাংশও তিনি তরজমা করেন। ‘ভোরের কাগজে’ প্রকাশের পর রুশী ও উর্দু কবিতা-সম্ভার আগামী প্রকাশনী ২০১১ সালে প্রকাশ করে। অনূদিত উর্দু কবিতার কবিদের মধ্যে রয়েছেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ইকবাল ও গালিব প্রমুখ। ইকবালের সেই বিখ্যাত কবিতা বাঙালি কবির হাতে রূপ পেয়েছে : “ওঠো ওঠো ওঠো ওঠো দুনিয়ার গরিব ভুখারে জাগিয়ে দাও ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও- কিষাণ মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল সে মাঠের প্রতি শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও।”
তোফাজ্জল হোসেনের কলমে গালিবের রূপান্তর, ‘আমার কল্পনাকে আনন্দকে নিয়ে আমি গান গাই আমি সেই উদ্যানেরই নাইট্যাঙ্গেল যা এখনো রচিত হয়নি।’ তার স্বতন্ত্র একাধিক কাব্য সংকলন এবং কবিতা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। তবে তিনি নিভৃতচারী, আত্মমগ্ন। প্রচারের ডামাডোলে গা ভাসাননি। ফলে তার এই প্রচারবিমুখতার কারণে তিনি এখনো অনেকটাই স্বল্প পরিচিত, কম আলোচিত। তার চারিত্রিক বিশিষ্টতা শনাক্ত করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : তোফাজ্জল হোসেন নিভৃতচারী ছিলেন, স্বল্পবাক ছিলেন কিন্তু তার একটা প্রবল রসবোধ ছিল। নানা বিষয়ে অনেক কৌতুক করতেন, গল্প করতেন এবং নিজেকে নিয়েও কৌতুক করতে পারতেন। সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন : আমরা তাকে ভাষাসৈনিক বললেও সে ছিল এদেশের স্বাধিকার, স্বাধিকার পক্ষের এক মহান চিন্তক। তোফাজ্জল হোসেনের ঐতিহাসিক ভ‚মিকা সম্পর্কে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম চারণ করেছেন স্মৃতি: ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, আমি, সৈয়দ আহমদ হোসেন- আমরা মিলে প্রথম বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসি যে মুসলিম লীগের সেই স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলবার চিন্তা এবং সেখানে আমরা জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন মিলে সকলে একত্রিত হয়ে যে কাজটি করেছিলেন- আমাদের পরামর্শক হিসেবে তোফাজ্জল হোসেন সেদিন ভ‚মিকা রেখেছিল পরবর্তী সময়ে যখন ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট হয়েছিল তার পেছনেও তার চিন্তার যে অবদান সেসময়ে আমরা তোফাজ্জলের পরামর্শে কাজগুলো করেছিলাম...। তার এই ঐতিহাসিক অবদান সম্পর্কে অনেকেই জানি না। ওঃ ধিং ঃযব নবংঃ ড়ভ ঃরসবং, রঃ ধিং ঃযব ড়িৎংঃ ড়ভ ঃরসবং- সেই ক্রান্তিকালের ফসল তোফাজ্জল হোসেন।