×

সাময়িকী

একান্ত হিতৈষী বড় ভাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০৬:৪৮ পিএম

একান্ত হিতৈষী বড় ভাই

তোফাজ্জল হোসেন

আমার বাল্যকালটা খুবই বর্ণিল। ১৯৪৮ সালের কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে আমি আব্বার সঙ্গে কলকাতা থেকে ঢাকা এলাম। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে কমলাপুর ঠাকুরপাড়ায় এসে নামলাম। আব্বা বাড়ি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। ঠাকুরপাড়া তখনো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। ব্রাহ্মণরা ছাড়া আর কেউ সেখানে থাকতেন না। একটু দূরে ছিল কায়স্থপাড়া। সেখানকার কেউ ঠাকুরপাড়ায় আসতেন না। ঠাকুরপাড়ায় আমরা চতুর্থ মুসলিম পরিবার। সাত বছর বয়স থেকে সেখানে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে আমি বড় হয়েছি। আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরে ছিল অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়দের বাড়ি, যার সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাবিত্রীদি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। আমাদের পাশের বাড়িতে আসেন এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা ‘মুখ ও মুখোশে’র পরিচালক আবদুল জব্বার খান। ১৯৫২ সালে কায়স্থপাড়ায় চরে আসেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। কমলাপুর জাহাজ বাড়ির পাশে থাকতেন নাট্যকার অভিনেতা আলী মনসুর। কমলাপুর বাজারের মাঝামাঝি থাকতেন সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যার দুই পুত্র হীরু ও মঞ্জু যথাক্রমে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও রাজনীতিবিদ আনোয়ার হোসেন। কমলাপুর বাজারের কাছাকাছি ছিলেন কবি জসিমউদ্দীন। তার কয়েক বাড়ি পরে থাকতেন তখনকার নামকরা ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। কমলাপুর ঠাকুরপাড়া, কায়স্থপাড়া, বাজারসহ বৃহত্তর কমলাপুর এলাকার নানা পরিমণ্ডলের গুণীজনদের এই পরিচিতি তুলে ধরার কারণ হচ্ছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক থেকে ষাট দশকের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান তুলে ধরা। এতে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে একটি সময়ের মানচিত্র অঙ্কন করা যেতে পারে। আমি যাদের কথা উল্লেখ করেছি, তাদের প্রায় সবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তারাও পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজধানী ঢাকার অগ্রযাত্রার পথ নির্মাণে বৃহত্তর কমলাপুরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শহরতলি থেকে শহর হয়ে ওঠার দৃশ্য অবলোকন করতে করতে আমারও বড় হয়ে ওঠা।

কমলাপুরের একপ্রান্তে মতিঝিল কলোনি তখনও তৈরি হয়নি, বিশাল এলাকাজুড়ে ইটগুলো রাখা ছিল। কমলাপুর স্টেশন হয়েছে আরও অনেক পরে। মতিঝিল ও কমলাপুরের এ প্রান্তের মাঝামাঝি রাস্তার একদিকে ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন, আমার তোফাজ্জল ভাই। তাকে নিয়ে আজকের এই স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধ। তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে কবে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল, তা এখন মনে নেই। তবে সালটা হবে ১৯৫৬। স্কুলের শেষবর্ষের ছাত্র হলেও আমি তখন দৈনিক ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরের লেখক, কচি-কাঁচার মেলার প্রথম আহ্বায়ক। আর তোফাজ্জল ভাই দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক। আমাদের বাড়ি থেকে তার বাড়ির দূরত্ব আধা কিলোমিটারেরও কম। আর ততদিনে কমলাপুর বাজারের রাস্তা বাদ দিয়ে কায়স্থপাড়ার মাঝখান ধরে তোফাজ্জল ভাইয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। ফলে তার সঙ্গে যোগাযোগ আমার অবধারিতই ছিল। ঠাকুরপাড়ায় বসবাসের সুবাদে সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের যে কৃতী মানুষদের আবহে আমি বড় হয়েছি, তারা আমার কৈশোর ও তারুণ্যের দিনগুলোকে সত্যি রোমাঞ্চকর করে তুলেছিলেন। তোফাজ্জল ভাই ছিলেন তাদের অন্যতম।

তোফাজ্জল ভাইয়ের পরিচয় কি? তাকে কোনো একটি অভিধায় আখ্যায়িত করলে ভুল হবে। ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সাহিত্য সাংবাদিকতাসহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাঁচ দশক ধরে ছিল তার অবারিত পদচারণা। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে সংগঠক হিসেবেও তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত তার ভ‚মিকা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এ সময়টা ছিল আন্দোলন ও সংগ্রামের এক গৌরবজনক পথপরিক্রমা। তোফাজ্জল ভাই হয়তো বাঙালি জাতির অগ্রযাত্রায় সম্মুখ নেতৃত্ব দেননি, কিন্তু যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি ছিলেন তাদের পাশে। ভাষা আন্দোলনের সময় তার বাসায় মিলিত হয়েছেন আন্দোলনকারীদের কয়েকজন। পারস্পরিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে তারা নির্ধারণ করেছেন আন্দোলনের কৌশল। যদ্দুর জানতে পেরেছি, এদের মধ্যে ছিলেন, আবদুল মতিন, আবদুল লতিফ, অলি আহাদ, সৈয়দ আহমদ হোসেন, আনিসুজ্জামান প্রমুখ ভাষা-সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলনে তোফাজ্জল ভাই ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যেদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে, সেদিনও তিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক। ভাষা আন্দোলনকে জীবন-মরণের যুদ্ধ বলে মনে করেছেন তিনি। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’র প্রথম সংকলনে তার গান অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কালজয়ী গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এবং তোফাজ্জল হোসেনের ‘রক্তশপথে আমরা আজিকে তোমাকে স্মরণ করি, একুশে ফেব্রুয়ারি’ দুটো গানেই সুর করেছিলেন শিল্পী আবদুল লতিফ। তোফাজ্জল ভাইয়ের গানটি প্রভাতফেরিতে গাওয়া হতো। বিস্ময়ের কিছু নেই যে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম ‘একুশ ভুবনময়’ যাতে ৩২টি কবিতাই একুশকে নিয়ে।

স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ লিখতে গিয়ে আমার নিজের কথাই বাদ পড়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমরা একই এলাকায় থাকতাম এবং আমাদের কর্মস্থল ছিল ইত্তেফাক অফিস, সেহেতু অনেকদিনই তার সঙ্গে ইত্তেফাক ভবনে গিয়েছি। ষাটের দশকের প্রথমদিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়। আমার লেখক জীবনে যে তিনজন শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে আমি প্রেরণা পেয়েছি তারা হলেন দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান, দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সম্পাদক শামসুল হক ও তোফাজ্জল হোসেন। এরা প্রত্যেকেই মনে করতেন আমি কালক্রমে বড় লেখক হব। জীবনের নানারূপ মোহের কাছে বন্দি হয়ে আমি বড় লেখক হতে পারিনি। কারণ একজন কবি বা লেখকের একটাই ঘোর থাকতে হয়, তা হচ্ছে লেখা। আমার সম্ভবত তা ছিল না। তোফাজ্জল ভাইয়ের জীবনের বিস্তৃতি ছিল বহু ব্যাপক ও বিশাল। আমি আগেই বলেছি সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটি প্রতিষ্ঠানের কথা আমি বিশেষভাবে বলতে পারি। তা হচ্ছে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন এর নির্বাহী সদস্য। এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলায় মাহমুদ নূরুল হুদার সঙ্গে যে তিন বন্ধু সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়েছিলেন, তারা হলেন সৈয়দ আহমদ হোসেন, আনিসুজ্জামান ও তোফাজ্জল হোসেন। আমার ছোটভাই বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রথম ব্যাচের ছাত্র নৃত্যশিল্পী দুলাল তালুকদারের কাছে শুনেছি কোনো একটি প্রডাকশনের সময় তোফাজ্জল ভাই সর্বক্ষণ রিহার্সেলে উপস্থিত থাকতেন। এতে যে শিল্পীরা অনুপ্রাণিত হতেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও তার উপস্থিতি ছিল নীরব। তবু শিল্পীদের কাছে কাছে মনে হতো একজন অভিভাবক সামনে বসে আছেন। দুলালের মতে সৈয়দ আহমদ হোসেন, আনিসুজ্জামান ও তোফাজ্জল হোসেন- এই ত্রয়ী সহপাঠী ছিলেন এক বৃন্তে তিনটি ফুলের মতো। তাদের বন্ধুত্বের কোনো তুলনা পাওয়া ভার। তোফাজ্জল ভাই নিজে হয়তো রঙিন ছিলেন না, কিন্তু তার কর্মজীবন ছিল অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও কলম্বো পরিকল্পনা বৃত্তির অধীনে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। চাকরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্র তথ্য সার্ভিসে ও যুক্তরাজ্য তথ্য সার্ভিসে। দেশের কয়েকটি ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষক হিসেবে অনিয়মিত দায়িত্ব পালন ছাড়াও কুয়ালালামপুর এআইবিডির প্রশিক্ষক হিসেবে কয়েক দফা স্বল্পমেয়াদি দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন বিশ্বব্যাংক ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট এবং বিআইডিএস-এর ফেলো। ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন্স-এর সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপালন শেষে ১৯৬৭ সালে বিসিএস তথ্য (সাধারণ) সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন শেষে তথ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার সাহিত্যকর্মের কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গবেষণাধর্মী বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এসব গ্রন্থ হচ্ছেÑ ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী’, ‘শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’, ‘বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ’, ‘কাশ্মীর : ইতিহাস কথা কয়’, ‘জাতিসংঘ’ ও ‘সাফল্যের সন্ধানে’ (ভাষান্তর)। বিষয়বৈচিত্র্য ও গবেষণাধর্মিতার দিক থেকে এসব বই অনবদ্য সৃষ্টি। আমাদের সৃজনশীল সাহিত্য অঙ্গনে ও গবেষণানির্ভর বইয়ের প্রাঙ্গণে তোফাজ্জল হোসেন এক সমুজ্জ্বল নাম। আমার সঙ্গে তোফাজ্জল ভাইয়ের শেষ দেখা হয় গ্রিন রোডে তৎকালীন বাংলাবাজার পত্রিকার অফিসে ১৯৯৬ সালে। আমি তখন সরকারি চাকরিরত। দীর্ঘকাল পরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় আমি স্বভাবতই আবেগাপ্লুত ছিলাম। তিনি সেই পুরনো দিনের মতো আমাকে সস্নেহে কাছে ডেকে বসালেন। আমার খবরাখবর জানতে চাইলেন। আমাদের আলাপচারিতায় কীভাবে প্রায় একটি ঘণ্টা পার হয়ে গেল তা বুঝতে পারিনি। আমাকে দুপুরে খাবারের কথা বলেছিলেন। আমার হাতে তখন আর সময় ছিল না। আমার পথচলায় আমি যে সকল জ্ঞানীগুণীজনের সান্নিধ্য লাভ করেছি, তাদের অনেকের স্নেহলাভে নিজেকে ধন্য মনে করি। আমার কৈশোর ও তারুণ্যের অনেক স্মৃতিবিজড়িত তোফাজ্জল ভাই ছিলেন একান্ত হিতৈষী বড় ভাইয়ের মতো। আমার কোনো বড় ভাই নেই বলেই তার উপস্থিতি আমার জীবনে ছিল পরম শ্রদ্ধার আসনে। আজ যখন তার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে বসেছি, তখন একটি বাংলা শব্দ দিয়ে তার ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে চাই। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন একজন ‘পরিশীলিত’ মানুষ, যার বহুমুখী প্রতিভা ও গুণাবলী বর্ণনার শব্দচয়নে হয়তো দীর্ঘ তালিকা হতে পারে, কিন্তু তোফাজ্জল ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের মাধুর্য এই ‘পরিশীলিত’ শব্দের মধ্যেই নিহিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App