×

জাতীয়

বর্বরতায় স্তম্ভিত সারাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২০, ০৯:২৪ এএম

বর্বরতায় স্তম্ভিত সারাদেশ

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বর নির্যাতন এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ করে ছাত্র ইউনিয়ন। -ভোরের কাগজ

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এমন বর্বরতায় স্তম্ভিত সারাদেশ। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তাল রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। সবাই নির্যাতনকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। অকথ্য নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তৎপর হয়ে উঠেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় নয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে থানায়।

ওই মামলার প্রধান আসামিসহ দুইজনকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এছাড়া নোয়াখালী পুলিশ আরো দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে। নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব ও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, ঘটনার কয়েক দিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে নির্যাতিতার কাছে টাকা দাবি করে। দেয়া হয় কুপ্রস্তাব। কোনো সাড়া না পেয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় তারা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ওবায়দুল কাদের গতকাল সচিবালয়ে বলছেন, দেশে সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকার এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। সব অপরাধের ক্ষেত্রেই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এদিকে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি অনলাইন মাধ্যম থেকে সরিয়ে নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিটিআরসিকে বলা হয়েছে ভিডিওর একটি কপি সংরক্ষণে রাখতে। ২৮ অক্টোবর এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। একই সঙ্গে ভিকটিমের পরিবারকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় পুলিশ সুপারকে (এসপি)

নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তের জন্য সেখানকার স্থানীয় সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল, সমাজসেবা অফিসারসহ তিনজনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনারকে (এডিসি) এ বিষয়ে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে এ সংক্রান্ত বিষয়ে করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ (ভার্চুয়াল) এই আদেশ দেন। আদালতে শুনানি করেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, এডভোকেট জেড আই খান পান্না, ইয়াদিয়া জামান, তানজিম আল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এ এম জামিউল হক ফয়সাল।

অপরদিকে বেগমগঞ্জ মডেল থানার ওসি হারুনুর রশীদ জানান, নির্যাতনের শিকার ওই নারী বাদী হয়ে রবিবার রাতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করেন। সেখানে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ৭-৮ জনকে আসামি করা হয়। আসামিরা হলেন বাদল, মো. রহিম, আবুল কালাম, ইস্রাফিল হোসেন, সাজু, সামছুদ্দিন সুমন, আবদুর রব, আরিফ ও রহমত উল্যা। তাদের সবার বাড়ি বেগমগঞ্জে। আসামিদের মধ্যে রহিম ও রহমত উল্যাকে নোয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইন্সপেক্টর হারুনুর রশীদ বলেন, দাম্পত্য কলহের জেরে ওই নারী একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে তার বাবার বাড়িতে থাকছিলেন। দীর্ঘদিন পর গত ২ সেপ্টেম্বর তার সঙ্গে দেখা করতে সেখানে যান তার স্বামী। সেদিন রাত ৯ টার দিকে আসামিরা তাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে এবং ওই নারীর স্বামীকে মারধর করে পাশের আরেকটি ঘরে নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তারা ওই নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তাতে বাধা দিলে আসামিরা তাকে নির্যাতন করে এবং মোবাইলফোনে সেই দৃশ্য ভিডিও করতে থাকে। ওই নারীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা কাউকে কিছু জানালে হত্যার হুমকি দিয়ে চলে যায়।

এরপর ওই নারী কাউকে কিছু না জানিয়ে জেলা শহরের মাইজদীতে বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও আসামিরা মোবাইলফোনের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ‘কুপ্রস্তাব’ দেয়। রাজি না হলে সেই রাতের ভিডিও তারা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নারী তাদের কথায় রাজি না হওয়ায় আসামিরা রবিবার দুপুরে সেই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। পরে পুলিশ খবর পেয়ে বোনের বাসা থেকে ওই নারীকে সরিয়ে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়।

র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ জানান, র‌্যাব-১১ এর একটি দল সোমবার ভোরে ঢাকা থেকে প্রধান আসামি বাদলকে এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ওই চক্রের দলনেতা দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে দেলোয়ারের নাম মামলার এজাহারে নেই। তবে সেও ওই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার কাছে একটি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে এক নারীকে বর্বরভাবে নির্যাতন করে ভিডিও করা হয়। ৪ অক্টোবর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

নির্যাতনের ঘটনার ৩৩ দিন পর নয়জনকে আসামি করে গত রবিবার রাত ১টার দিকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ। পাশাপাশি ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। র‌্যাব-১১ এর একটি দল রবিবার রাত আড়াইটায় নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিটাগাং রোড এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে দেলোয়ার হোসেনকে (২৬) গ্রেপ্তার করে। এসময় চাঞ্চল্যকর নারী নির্যাতনের ঘটনায় সম্পৃক্ত ‘দেলোয়ার বাহিনী’র প্রধান দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীকালে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় ঢাকার কামরাঙ্গীরচর ফাঁড়ির গলি এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন বাদলকে (২০) আটক করা হয়।

র‌্যাব জানায়, আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে ‘দেলোয়ার বাহিনীর’ কয়েকজন সদস্য ওই গৃহবধূর ঘরে ঢুকে তাকে বিবস্ত্র করে বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করে। তখন ওই ঘটনার ভিডিও করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে পরবর্তীকালে টাকা দাবি করে। গত ৪ অক্টোবর ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ‘দেলোয়ার বাহিনী’ ওই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং নানা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। তাদের ভয়ে এলাকার লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা রয়েছে।

এর আগে অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এক আসামিকে রবিবার বিকাল ৪টায় এবং অপর আসামিকে রাত ১১টায় একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন, একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামের খালপাড় এলাকার হারিদন ভূঁইয়া বাড়ির শেখ আহম্মদ দুলালের ছেলে মো. আব্দুর রহিম (২০) ও একই এলাকার মোহর আলী মুন্সিবাড়ির মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে মো. রহমত উল্লাহ (৪১)। আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। নির্যাতিত ওই নারীর বাবা সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় এতদিন ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস হয়নি তাদের।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App