×

সারাদেশ

পানি নামছে, তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২০, ১০:৫৫ এএম

পানি নামছে, তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

নাটোরের সিংড়ায় নদীর ভয়াবহ ভাঙনে জীবনের শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে নিঃস্ব কৃষক জহির আলমের পরিবার। ছবিটি শোলাকুড়া এলাকা থেকে তোলা। -ভোরের কাগজ

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে যমুনা নদীর পানি বেড়ে সিরাজগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গাইবান্ধায় সব নদনদীর পানি কমতে শুরু করলেও করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি এখনো বিপদসীমার অনেক উপরে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে পানি কমতে থাকায় গাইবান্ধা ও জামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। নিচে এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-

সিরাজগঞ্জ: 

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে যমুনা নদীর পানি বেড়ে সিরাজগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চলতি বছরের বন্যায় এর আগে জেলার সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালী ও উল্লাপাড়ার প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এবার পুনরায় যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় আবারো তারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানিয়েছেন। পানিবন্দি এসব মানুষের মধ্যে অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থান ও বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে শুরু হয়েছে তীব্র নদীভাঙন। বিশেষ করে জেলার শাহজাদপুর উপজেলার এনায়েতপুর থানাধীন ব্রাহ্মণ গ্রাম, আরকান্দি, পাকুরতলা, ঘাটাবাড়ী, কুঠিপাড়া এলাকায় যমুনা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতভিটা, ফসলি জমিসহ বহু স্থাপনা। হুমকির মুখে রয়েছে এনায়েতপুর কাপড়ের হাট, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু স্থাপনা।

দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর):

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ভয়াবহ নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এতে করে জেলার দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ী-রাজীবপুর ও কাঠারবিল-বাঁশতলী সড়ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। হুমকির মুখে পড়েছে হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের সাপমারি, জবেদ মোড় ও সবুজপুর এলাকা। সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের সাপমারি ও জবেদ মোড় নদীভাঙনের দৃশ্য। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেতে থাকায় দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ী, রাজীবপুর যাতায়াতের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ সড়কের জবেদ মোড় এলাকা ব্রহ্মপুত্র নদে ধসে যাওয়ায় ওই সড়কে যানবাহন যাতায়াতে হুমকির মধ্য রয়েছে। অপরদিকে কাঠারবিল বাজার থেকে বাঁশতলী বাজার সড়ক সাপমারি এলাকায় মহারানী খালে ধসে যাওয়ায় মোটরসাইকেল ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। নদীভাঙন আতঙ্কে রয়েছে সাপমারি, জবেদ মোড় ও সবুজপুর গ্রামের মানুষ। হাতিভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান নুর ছালাম জানান, গত কয়েক দিনে ব্রক্ষপুত্রের পানি বাড়তে থাকায় দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ী সড়কের জবেদ মোড় সড়ক পানির স্রোতে আংশিক ধসে পড়েছে। আর কিছু অংশ ধসে পড়লে দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ী-রাজীবপুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অপরদিকে কাঠারবিল-বাঁশতলী সড়ক বিচ্ছিন্ন থাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহেদ হোসেন জানান, হাতিভাঙ্গা ইউনিয়নের জবেদ মোড় ভাঙন এলাকায় নদী শাসন ব্যবস্থা না থাকায় সড়কটি ধসে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডে রিপোর্ট করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া জানান, দেওয়ানগঞ্জ-সানন্দবাড়ী, রাজীবপুর সড়কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সড়কটি ভাঙনের বিষয় আমি শুনেছি। বিষয়টি উপজেলা প্রকৌশলীকে অবগত করা হয়েছে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডে রিপোর্ট করা হয়েছে।

কুষ্টিয়া:

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পদ্মা নদীতে বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত ১০ দিনে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নে বেশ কিছু ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রায়টা-মহিষকুন্ডি নদী রক্ষা বাঁধসহ ভারত থেকে আসা বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। এভাবে নদীভাঙন অব্যাহত থাকলে এসব স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে মরিচা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম। স্থানীয়রা জানান, এ বছর বন্যার পানি গত বছরের মতো বৃদ্ধি না পেলেও পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।

মরিচা ইউনিয়নের ভুরকা-হাটখোলা থেকে কোলদিয়াড় পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ৪ ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, বাগানসহ অনেক স্থাপনা। ফসলি জমি হারিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। গত কয়েক দিনে শত বিঘা জমি নদীর পেটে চলে গেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ভাঙনের ফলে নদী থেকে মাত্র ৫০০ ফুট দূরে রয়েছে ভারত থেকে আসা ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। যে কোনো সময় সঞ্চালন লাইনের খাম্বা নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে রায়টা-মহিষকুন্ডি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ভরাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভুরকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় কান্দিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোলদিয়াড় মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাটখোলাপাড়া জামে মসজিদ, জুনিয়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জুনিয়াদহ বাজার।

এদিকে নদীভাঙনের তীব্রতা নিরূপণ ও নদীভাঙন রোধকল্পে পরিকল্পনা করতে সম্প্রতি নদীভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছে আমলা পানি উন্নয়ন ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহেদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম। আমলা পানি উন্নয়ন ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহীদুজ্জামান বলেন, নদীভাঙন রোধে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ভাঙন এলাকায় দ্রুত জিও ব্যাগ ফেলাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। দৌলতপুর আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট আ ক ম সরওয়ার জাহান বাদশাহ বলেন, তাৎক্ষণিক নদীভাঙন রুখতে নদীপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জিও ব্যাগ ফেলাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা:

গাইবান্ধায় সব নদনদীর পানি কমতে শুরু করলেও করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি এখনো বিপদসীমার অনেক উপরে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে জেলার গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী, সাদুল্লাপুর উপজেলা এবং সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার চরাঞ্চলের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।

এদিকে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। তিস্তার ভাঙনে হরিপুর ঘাট ও লাল চামার, ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে ফুলছড়ি উপজেলার এড়েন্ডাবাড়ী ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট এলাকায় নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান জানান, এসব এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীভাঙন রোধে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভাটি কাপাশিয়া এলাকায় তিস্তার তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এখানে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৪৫টি বাড়িঘর ও আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে এখানে কোনো প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা হচ্ছে না। নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান আরো বলেন, আগামী বছর নতুন ডিপিপি তৈরি করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভাটি কাপাশিয়া এলাকায় ভাঙনরোধে কাজ করা হবে।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা পানিতে ডুবে থাকায় সেখানে ৮ দিন ধরে চিকিৎসা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্বরের বিভিন্ন কার্যালয় ও রেজিস্ট্রি অফিসে পানি থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সেবা নিতে আসা জনগণ। বন্যার পানিতে গোাবিন্দগঞ্জ-দিনাজপুর ভায়া ঘোড়াঘাট আঞ্চলিক মহাসড়ক ডুবে থাকায় এই সড়কে ৭ দিন ধরে সব ধরনের ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৫টি ওয়ার্ড এখনো পানির নিচে। গোবিন্দগঞ্জ-ঘোড়াঘাট আঞ্চলিক মহাসড়কের ৩টি পয়েন্ট পানিতে ডুবে থাকায় কোনো যানবাহন চলাচল করছে না। বন্যার পানিতে জেলায় ১৬ হাজার ১২৫ হেক্টর জমির রোপা আমন, ৫৫৫ হেক্টর শাকসবজি ও ১৮০ হেক্টর জমির মাষকলাই নিমজ্জিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, বন্যার্তদের জন্য নগদ ৪ লাখ ৮০ হাজার এবং শিশুখাদ্য বাবদ ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া গো-খাদ্য হিসেবে গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী ও সাদুল্লাপুর উপজেলার জন্য ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় এবং ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App